বাংলাদেশে এর আগে এমন সরকারবান্ধব মিডিয়া ছিল কিনা আমার জানা নেই। বিশেষ করে প্রায় সব প্রধান মিডিয়া সরকারের প্রধান কর্মসূচি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমর্থক।
কিন্তু নানাকিছুতে মিডিয়ার এতো সব আনুকূল্য থাকা সত্ত্বেও সরকারি নেতারা যেন খুশি না! বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা! প্রায়ই তিনি মিডিয়াকে আক্রমণ-কটাক্ষ করে বক্তব্য রাখেন! সবশেষ সংসদ অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতাতেও তিনি বলেছেন, মিডিয়া যা খুশি সত্য-মিথ্যা লিখছে-বলছে! অনেকদিন তার মুখে কোনো একটা মিডিয়ার প্রশংসা শুনলাম না যে, অমুক মিডিয়া এ ইস্যুতে ভালো একটি রিপোর্ট লিখেছে বা করেছে! হিসাবে না মিললে মিডিয়ার বিরুদ্ধে প্রায়ই বলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতও। বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাকালে যা খুশি বলতেন ফারুক খান।
আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের হাতে মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকদের নিগ্রহ স্বাভাবিক-রুটিন ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে! আওয়ামী লীগসহ এর অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা নানা জায়গায় মিডিয়া ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যা-তা খিস্তি-খেউড় করেন! সব মিলিয়ে এসবের পরিণতি সরকার ও আওয়ামী লীগকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা কি ভেবেছেন শেখ হাসিনা অথবা আওয়ামী লীগের নেতারা? নাকি উনারা এবার আখেরের মতো ক্ষমতায় এসে গেছেন বা আগামীতে ক্ষমতায় আসতে তাদের আর মিডিয়া সাপোর্ট লাগবে না?
সর্বশেষ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারের সঙ্গে মিডিয়ার সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে। হত্যাকাণ্ডটির পর ঘটনাস্থলে পাইক-পেয়াদাসহ ছুটে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনকে ৪৮ ঘন্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বাকোয়াজি করতে কেউ হাতে-পায়ে ধরে নাই। এরপর বোঝা গেল, মন্ত্রীর বাকোয়াজিই সার! যখন দেখা গেল, ৪৮ ঘণ্টার আর শেষ নেই, তখন মন্ত্রী নতুন তত্ত্ব দিয়ে বললেন, হত্যা রহস্যের তদন্ত মনিটরিং করছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা! কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীর এতই অফুরন্ত অবসর যে, তিনি হত্যা রহস্যের তদন্তও মনিটর করেন, এমন আগে কখনো জানা যায়নি।
কিন্তু এরপর দেখা গেল, তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী বলে দিলেন, কারও বেডরুম পাহারা দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব না! এর মাঝে আদালতও এ ঘটনার রিপোর্ট প্রকাশের বিষয়ে রুল জারি করেছেন। অতএব, সাংবাদিকরা যতই আন্দোলন করেন, গলা ফাটান, কান্নাকাটি করেন না কেন, এ নিয়ে সরকার মনে করছে, কারও কোনো মাথা ব্যথা নেই!
প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দেশের সব সংস্থা মিলেও দেশের একটা খুনের ঘটনার কুল কিনারা করতে পারে না কেন? এর সহজ উত্তরটি হলো, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মেধাশূন্যতা, পেশাদারিত্বের অভাব। যোগ্য-মেধাবী-পেশাদার লোকজন আর উপযুক্ত জায়গায় যেতে বসতে পারছেন না। দলবাজ-তেলবাজ-ধান্ধাবাজদের দাপটে কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন যোগ্যরা। এ বক্তব্যগুলো যদি ঠিক না হয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে এর অন্য কারণ আছে! কারণটি কি, এর জবাবও সরকারকেই দিতে হবে।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে অভাবিত ঐক্যের ঘটনা ঘটে গেছে দেশে রাজনৈতিক কারণে বিভক্ত সাংবাদিক সংগঠনগুলোর মধ্যে! সাংবাদিকতা পেশা হলেও দেশের দু’দল সাংবাদিক নেতাদের কারও আপা-ধানমণ্ডি-গণভবন, আরেকদলের ম্যাডাম-গুলশান-নয়াপল্টন জপ না করে দিনের কাজ শুরু, অন্ন গ্রহণ-ত্যাগ হয় না। ইনাদের কেউ কেউ আবার নানা সুযোগ-সুবিধার ঘ্রাণে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি দলীয় ব্যানারে এমপি নির্বাচন করেন অথবা আগামীতেও করার ইচ্ছা, তারা কি করে অবিশ্বাস্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেলেন?
এ প্রশ্নের উত্তর জানতে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। জবাবে বলা হয়েছে, অনেক সাংবাদিক নেতার মধ্যেই আছে সাংবাদিকতার আইডেনটিটি ভাঙ্গিয়ে অর্জন করা কার কি আছে না আছে তা প্রকাশ হয়ে যাবার ভয়! আজকাল তরুণ প্রজন্মের সাংবাদিক পোলাপান অনেকে মহা পাজি কিসিমের! মুরুব্বি-টুরুব্বি নিয়ে অন্ধত্ব কম। রাস্তাঘাটে মুখের ওপর যা খুশি সত্য বলে দিতে এদের মুখে কিছু আটকায় না! সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিকদের ক্ষোভ তেমন একটি জায়গায় তেতে আছে!
সর্বশেষ সাংবাদিকদের অষ্টম ওয়েজবোর্ডের দাবিতে ঐক্য আরও দৃঢ় হয়েছে। তথ্যমন্ত্রীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায়! ১৯৯১ সালে দেশে চলতি কিসিমের গণতন্ত্র চালুর পর এসব সরকারের কোনো তথ্যমন্ত্রীকে এভাবে প্রেসক্লাবে অবাঞ্ছিত করার কোনো ঘটনা আছে কিনা মনে নেই। আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়পন্থী সাংবাদিক নেতারা অভিযোগ করেছেন, মালিকদের পক্ষ নিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী! অতএব প্রেসক্লাবের ডালপুরি খাওয়া তার জন্য হারাম!
ওয়েজবোর্ড অষ্টম হোক বা দশম হোক বাংলাদেশের কয়টা মিডিয়ায় তা কার্যকর হয় না হয় তা ওয়াকিবহালরা ভালোই জানেন। দেশের নব্বই শতাংশ বা এরও বেশি সাংবাদিক যে জীবন রক্ষার মতোও বেতন পর্যন্ত পান না। কোনোদিন পত্রিকা বা মিডিয়া অফিস থেকে এক পয়সাও পাননি, এমন অসংখ্য কাহিনীও আছে। এসব জানা সত্ত্বেও সাংবাদিক নেতারা যে বিষয়টি নিয়ে কখনো কেন আন্দোলন করেন না, কেন মুখ বুঝে থাকতে পারেন বছরের বছর, সে জবাবও কিন্তু আগামীতে তাদের পথেঘাটে দিতে হতে পারে। সর্বশেষ সপ্তম ওয়েজবোর্ড কার্যকর না হওয়া সত্ত্বেও একশ্রেণীর সংবাদপত্রকে টাকা খেয়ে সার্টিফিকেট ইস্যুর অভিযোগও কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে আছে। ওই সার্টিফিকেটের গুণে(!) ওই মালিকরা সরকার নির্ধারিত উচ্চমূল্যে সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকাও তুলে নিচ্ছেন! কোন কাগজের নামে কোন সুপারিশ করে কোন নেতা পত্র দিয়েছেন, অথচ সে কাগজের সাংবাদিকরা ওয়েজবোর্ড অনুসারে বেতন পাচ্ছেন না, তা তদন্ত করলেই এসবের গোমর বেরিয়ে আসবে।
অষ্টম ওয়েজবোর্ড চালু হলেও কি তেমন কাগজের ব্যবসা বাড়বে কোনো কোনো নেতার? বা বাজার অনুপাতে সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা দিতে অক্ষম মালিকদের এসব মিডিয়া দোকান চালু রাখতে কেউ কারও হাতে পায়ে ধরেছে নাকি? এসব অসাধু নেতা-মালিকদের চেনেন-জানেন বলেই সাংবাদিকদের আন্দোলনকে সরকারি নেতারা আমল-পাত্তা দিচ্ছেন না? পরতায় না মিললেই যা খুশি বলে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের নেতারা?
কিন্তু এসবের পরিণাম তাদের জন আর মিডিয়া বিচ্ছিন্নতার কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা তারা ভেবেছেন কি? শেয়ারবাজারের টাকা-পয়সা এক শ্রেণীর প্রভাবশালীরা কি লুটে নিয়ে যান নাই? তাদের প্রতি কি মায়ার কারণে সরকার এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি? ছাত্রলীগ নামধারীদের হাতে দাও-কুড়াল দেখলে কি মিডিয়া চোখ বন্ধ করে থাকবে? এসব মিডিয়ায় আসলে তাকে কি সত্য-মিথ্যা যা খুশি-প্রচার করা বলে? আর চোখের সামনে এসব ঘটনা মিডিয়া যথাযথভাবে তুলে না ধরলে জনগণের মধ্যে কী বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়, অফিসে কি কি ভাষার সব ফোন আসে, তা মিডিয়ার লোকজন ছাড়া কে জানেন?
দেশে থাকতে ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে বেশি যাতায়াতের কারণে মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকদের কাজের ঝুঁকি-মজুরি না পাওয়ার দুঃখকষ্ট সরেজমিনে দেখতাম। তাদেরই একজন বরিশালের শওকত মিল্টন। সাহসী রিপোর্টিং এর কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাকর্মী, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে সমান গোছেরদের টার্গেটে থাকতেন শওকত মিল্টন। বেশি সমস্যা দেখলে ঢাকায় পালিয়ে চলে আসতেন। একবার বরিশাল থেকে তার পালানোর সময় পথের এক জায়গায় নৌকায় করে মাঝনদীতে তার লঞ্চে চড়ার প্রত্যক্ষদর্শীও ছিলাম। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় বিভিন্ন সময়ে মিল্টন বলতেন, যে দল যখন বিরোধীদলে থাকে সে তখন খুব মিডিয়া বান্ধব থাকে। ক্ষমতায় গেলে ওই দলটির নেতাকর্মীদের চোখ পাল্টাতেও সময় লাগে না।
গত বিএনপি আমলের বেশিরভাগ সময় জনকন্ঠের নড়াইল প্রতিনিধি রিফাত-বিন-ত্বহা এলাকাতেই থাকতে পারেননি। কিন্তু তারা যেহেতু ওয়েজবোর্ড অনুসারে বেতন পান না, তাই এলাকা ছাড়া হলে তাদের কি যে জীবন-দুর্গতির সৃষ্টি হয় তা ওয়াকিবহালরা জানেন। তারা মামলায় পড়লে দেখা দেয় আরও ভোগান্তির। মামলায় সম্পাদক-প্রকাশক থাকলে এক রকম, না থাকলে অফিস আরেক রকম আচরণ করে। সাংবাদিক নেতারাও তাদের নিরাপত্তায় সব সময় হাত বাড়িয়ে দেন না। এসব নানা বৈষম্য-বিশৃঙ্খলার মধ্যেও বেশিরভাগ সাংবাদিক বস্তুনিষ্ঠ কাজ করে যাচ্ছেন। এ কারণেই বলা হয়, দেশের অনেক কিছু যে এখনো ঠিকমতো চলছে, এখনো যে কিছু লোকজন চুরি-চামারি করতে সাবধানে থাকার চেষ্টা করে, এর কারণ মিডিয়া।
এখন সারা দুনিয়ার রাজনীতিসহ অনেক কাজকর্মও মিডিয়া ভিত্তিক ও কেন্দ্রিক। মিডিয়া লাগে বলে এখনও আওয়ামী লীগ অফিস-গণভবনে ‘সাংবাদিক প্রবেশ নিষেধ’ জাতীয় কোনো সাইনবোর্ড ঝুলানো হয়নি। কিন্তু কি কারণে শেখ হাসিনা বারবার মিডিয়ার বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে বলে যাচ্ছেন? মিডিয়া যে আজ অনেক স্বাধীন তা সময়ের দাবি। এই স্বাধীনতা হাসিনা-খালেদার হাতে না, বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের হাতে এসেছিল। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ-নিষিদ্ধের ধারাগুলো বাতিল করেছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন। শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া চাইলেই তা পুনর্বহাল করতে পারবেন না।
দুনিয়াও এখন অনেক বদলে গেছে। এটি ইন্টারনেটের উন্মুক্ত দুনিয়া। কারো কোনো কিছু এখন আর লুকোছাপার সুযোগ নেই। সরকারি টাকায় পরিচালিত বিটিভি-বাসস নিয়ে বছরের পর বছর বাংলাদেশে যে দলবাজি, টাকার মচ্ছব চলছে, দুনিয়ার আর কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে তা সম্ভব কি?
এই যে আমি এভাবে লিখছি, তা দেশে গণতান্ত্রিক সরকার আছে বলেই লিখছি। এরশাদের মতো সরকার থাকলে এমন স্বতঃস্ফূর্ত লিখতে পারতাম না। কাজেই মুখে ডিজিটাল ডিজিটাল বলা শেখ হাসিনা যদি বাস্তব বুঝে চেঞ্জ না হন, মিডিয়া নিয়ে তার চলতি ধারার কথাবার্তা বন্ধ না করেন, তাহলে এসবের ফল টের পেতেও তার সময় লাগবে না। এত পাঁচমিশালি উপদেষ্টা তার, এমন একজনও কি বুকের পাঠাওয়ালা উপদেষ্টা তার নেই, যে তাকে সত্য কথাগুলো সামনা সামনি বলার সাহস-যোগ্যতা রাখেন?
ফজলুল বারী: সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩২ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১২
সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর