ছেলেবেলায় কখন জানি মুখস্থ করেছিলাম, লুৎফর রহমান রিটনের একটি ছড়া! এরপর বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় সেটি অনেক মঞ্চে বক্তৃতার শেষে ব্যবহারও করতাম! ‘যতই দেখান তেলেসমাতি খেল/ তেলো মাথায় আর দেবো না তেল/ চোখ রাঙিয়ে যতই মারেন ফাল/ কাজ হবে না উল্টে গেছে কাল/ ভেল্কিবাজি যতই দেখান দাদা/ ধানের ক্ষেতে বুনবো না আর আদা/ বোঝেন না কেন পাল্টে গেছে দিন/ থাকতে সময় দিন নাকে খত দিন’।
ঢাকায় লুৎফর রহমান রিটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়।
এরপর প্রতিদিন নানা আড্ডায় রিটন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। টিএসসি, শাহবাগ বা বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রে প্রতিদিন এক-দু’বার ঢুঁ না মারলে যেন আমাদের পেটের খাবার হজম হয় না। বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের আবৃত্তির ক্লাসে মায়ের সঙ্গে আসতেন স্কুলছাত্রী মিথিলা। তার মা আর আমি দু’জনেই লুৎফর রহমান রিটনের ভক্ত। দু’জনে সেখানে প্রতিযোগিতা করে রিটন ভাইয়ের সঙ্গে নানান দুষ্টামি করতাম। তিনি মজার মানুষ। সারাক্ষণ যেকোনো পরিবেশ জমিয়ে রাখতেন। যে কোনো কিছু তার সঙ্গে শেয়ার করা যেত। যেমন রিটন ভাইয়ের সামনের দিকের স্বাস্থ্য একটু নাদুস নুদুস হচ্ছে! বুকের চাইতে পেটটা এগিয়ে!
``ব্যাপার কী রিটন ভাই?``-- জিজ্ঞেস করতেই ভুঁড়িতে আদুরে হাত বোলাতে বোলাতে হাসিতে চারপাশ কাঁপিয়ে জবাব দিয়ে বলতেন, ``বুঝলা না মিয়া, এইটা হইলো গিয়া টাকা হওয়ার লক্ষণ!`` এরপর আবার সেই চেনা হাসি। সেই মিথিলা বড় হন আমাদের চোখের সামনে। মিথিলা ফারজানা নামে যাকে এখন দেশের মানুষ চেনেন। জনপ্রিয় টিভি প্রেজেন্টার। রিটন ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলে এখনও সে দিনগুলোকে শেয়ার করি।
বিচিন্তা বন্ধ করে দিয়েছেন এরশাদ। আমি এখানে-সেখানে কাজ করি। কাজী নূরুজ্জামান সম্পাদিত `নয়া পদধ্বনি` নামের একটি পত্রিকায় লিখতেন ড. আহমদ শরীফ, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আব্দুল মতিন, বিনোদ দাশগুপ্ত, সৈয়দ আবুল মকসুদ, শাহরিয়ায় কবিরসহ একদল বুদ্ধিজীবী। আমি তাদের টিমের পুঁচকে জুনিয়র সদস্য। আমাকে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে এরশাদের বান্ধবী জিনাত মোশাররফকে নিয়ে একটি রিপোর্ট করতে হবে। এর কিছুদিন আগে খবর গ্রুপের `মনোরমা` পত্রিকায় জিনাতকে নিয়ে একটি ফটো ফিচার ছাপা হয়েছে। জিনাত কিভাবে হাসেন, কিভাবে ম্যাগাজিন পড়েন, কিভাবে সমাজসেবা করেন, এমন নানা অ্যাঙ্গেলের ছবি। এরশাদের সময় এমন নানাকিছু ছাপিয়ে তাবেদারি করতেন অনেকে। আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল খোঁজখবর নিয়ে লিখতে হবে ‘কে এই জিনাত মোশাররফ’। তথ্য মোটামুটি জোগাড় করে একখানা স্টোরি লিখেও ফেলি। কিন্তু জিনাতের ছবি জোগাড় করতে মনোরমার অফিসে গিয়ে রিটন ভাইয়ের সহায়তা নিতে হয়েছে। আমি নিষিদ্ধ পত্রিকার নিষিদ্ধ সাংবাদিক তখন। এরশাদের ক্ষমতায় থাকতে তার শীর্ষ বান্ধবীকে নিয়ে রিপোর্ট করা তখনকার সময়ের মোটামুটি দুঃসাহসিক কাজই মনে করা হতো। রিপোর্ট ছাপার পর গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন আমাকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে যায়। সেখান থেকে নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারার পর টিএসসির আড্ডায় ছোটখাটো একটি সংবর্ধনাও পাই রিটন ভাইয়ের উদ্যোগে।
এরপর দ্রুত আগাচ্ছিল সময়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রিটন ভাই লিখে যাচ্ছিলেন তার আগুনে সব ছড়া। এসব আবার টিএসসিসহ নানা অনুষ্ঠানে মঞ্চে গরম গরম আবৃত্তিও করছিলেন। তার ‘ঢাকা আমার ঢাকা’ সহ অনেক বিখ্যাত ছড়া ওই সময়েই লেখা। এরপর বাংলাবাজার পত্রিকাতে আমাদের অনেক অভিজ্ঞতা। ১৯৯৬-এর মে মাসে আমি জনকণ্ঠে যোগ দিই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দূতাবাসের চাকরি নিয়ে রিটন ভাই চলে যান জাপানে। এরপর আবার ২০০১-এর নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় ফিরলে তিনি আর দেশে ফিরতে পারেননি। চলে যান কানাডায়। আমি অস্ট্রেলিয়া আসার পর প্রথম তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় ফেসবুকে। এখনও ফ্রি থাকলে তার সেই হাসি আর জমিয়ে মজার গল্প শুনতে ফোন দিই। বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক বিদেশে চলে গেলে জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকেন। সে কারণেই হয়তো দেশের অক্সিজেন নিতে আজকাল মাঝে মাঝে দেশে যান প্রিয় লুৎফর রহমান রিটন! আর এমন তিনি কতদিন নিজের দেশে স্বাধীনভাবে যেতে পারবেন জানি না। হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ রিটন ভাই। বাঙ্গালি, বাংলাদেশ, বাংলা সাহিত্যের জন্য তোমাকে সুস্থভাবে বাঁচতে হবে আরও অনেক অনেক দিন।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০১২
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর