ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

চলেই গেলি, শীলা!

প্রতীক ইজাজ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩, ২০১২
চলেই গেলি, শীলা!

শীলা আমার বন্ধু। আমার বোন।

আমার অভিভাবক। আমরা পরস্পরকে তুই বলেই ডাকতাম। যখন আমরা ভোরের কাগজের ‘অবসর’ ও ‘মেলা’র প্রদায়ক, শীলা তখন আমাকে খাইয়েছে, টাকা দিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে। যন্ত্রের এই শহরে শীলাই শিখিয়েছে, কিভাবে মানুষকে ভালোবেসে, বন্ধুতা দিয়ে, অনেক দিন, অনেককে নিয়ে, একত্রে বেঁচে থাকা যায়। এই প্রতিবেশ, সংবাদপত্র, এই নগরে শীলাই আমাকে টিকতে শিখিয়েছে। ওর অস্তিত্বের অস্থিমজ্জা নিয়ে আমি, আমরা, আজ এখনো বেঁচে আছি!

২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি। প্রদায়ক হওয়ার আশায় ভোরের কাগজে পা রাখি। তালিকায় তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা এক ঝাঁক মেধাবীর দুর্দান্ত প্রতাপ। সেই দলে শীলাই ছিলো সবার মধ্যমণি। মফস্বল থেকে আসা এই আমিকে, ওদের দলে প্রশ্রয় দিয়ে, মধুর বেঁচে থাকার প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতে শীলাই আমাকে শিখিয়েছে। ও হাসতো। পারতো হাসাতেও। সহকর্মীদের মাঝখানে বসে, হো হো করে হেসে, বুঝিয়ে দিতো, জীবনটা কত সুন্দর! কত মধুময়!!

রাগ হলে লাল হতো শীলার চোখ। মুখ ফুলে যেতো। আটকে যেতো কথা। এই যে, এখন যেমন, ওর জন্য, আমাদের, আমার, সবার চোখ লাল। মুখে কথা নেই। ভেতরে কেবলই অস্ফুট দীর্ঘশ্বাস। আর স্মৃতিতর্পণ। সেই মুখ, সেই চোখ, সেই শীলা। হয়তো কোনো একদিন, কোনো এক ভিড় থেকে অলক্ষে ডেকে উঠবে, শীলা নয়, শীলার ছায়া: ‘প্রতীক, এত শুকিয়ে গেছিন ক্যান? খাস নি?’

শীলা, এই যন্ত্রের শহরে ভীষণ অভাব আজ তোর, বন্ধু!

কোনোদিন কোনো প্রতিবেদন বা সাংবাদিকতার কোনো কিছু নিয়ে কারো সঙ্গেই কোনো হিংসা, দ্বেষ বা লজ্জাকর প্রতিযোগিতা ধাঁচে ছিলো না ওর। ও ছিলো নির্মল মানুষের ছবি। কোথাও আটকে গেলে বা না বুঝলে, অধিকার নিয়ে সামনে দাঁড়াতো আমাদের। পেশার জটিলতা স্পর্শ করতো না ওকে। কত সহজ, সরল থেকে সাংবাদিকতাকে অনুভব করা যায়, ভালোবাসা যায়, প্রবেশ করা যায় গভীরে, চেতনে-অবচেতনে, শীলাই আমাদের শিখিয়েছে। অন্তত আমাকে।

তখন বড় দুর্দিন আমার। ২০০০ থেকে ২০০৪ সাল। প্রথম দিকে মাস শেষে প্রদায়কের সামান্য ক’টি টাকা। পরে অনিয়মিত বেতন ভোরের কাগজে। থাকার জায়গা নেই। নেই ওয়াক্ত মেপে খাবারের নিশ্চয়তাও। নিয়মিত কেবল ভালোবাসা, হৃদ্যতা, ভেতরের টান। শীলা তখন থাকতো সাইদ ভাই (শীলার স্বামী দৈনিক কালের কণ্ঠের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) এটিএম সাইদুজ্জামান) ও আরশীকে নিয়ে কাঁঠালবাগান ঢালের নিচে একটি ফ্ল্যাটে। মাঝে মধ্যে রাতে কাজ শেষে ওকে এগিয়ে দিয়ে আসতাম আমরা। গল্প করতাম ফ্ল্যাটের নিচে দাঁড়িয়ে। কত প্রাণশক্তি ছিলো ওর। কত গল্প ছিলো ভেতরে। কে জানতো তখন, ভেতরের গোপন কুঠুরিতে বাস করা এক বাজখাঁই ক্যান্সার, একদিন শব্দহীন করে দেবে ওকে। দুমড়ে-মুচড়ে নিঃশেষ করে দেবে অদ্ভুত এক প্রাণশক্তি?

কেবলই হারিয়ে যাচ্ছে কথার খেই। এত গল্প, এত স্মৃতি, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আলাদা করতে। পারছি না। কাঁদছি। এ কান্না ভেতরের, নিঃশব্দের। এ কান্না শীলার প্রতি আমাদের অবহেলার, প্রায়শ্চিত্তের। শেষের দিনগুলোয় তোকে আমরা ভুলেইছিলাম শীলা। বিশেষ করে, অকৃতজ্ঞ আমি, একদিনও তোকে দেখতে পর্যন্ত যাইনি। অভিমান ছিলো হয় তো ভেতরে। তাই বলে এই না যাওয়া- কী করে মেনে নিই বল? অন্যেরাও যায়নি। যেত না। না যাক। তুই তো বরাবরই এসবের উর্ধ্বেই ছিলি শীলা। কি, ছিলি না? তুই তো বলতি, প্রতীক, আমি সবাইকে নিয়ে থাকতে চাই।

শীলা, তোর কাছে এই জীবনে আমার অপরিশোধিত ঋণ। বিশ্বাস কর, তুই যদি বোন, বন্ধুর মতো সে সময় আমার পাতে ভাত তুলে না দিতি, আমি কোথায় খেতাম, কি খেতাম, বল। তখন তো আমাদের বেতন অনিয়মিত। পিনাকী ও আমি দুপুরে ছয় টাকায় গাজরের হালুয়া ও ছয় টাকায় দুটি তন্দুর রুটি আনতাম। জুটতো আরো সহকর্মী। খেতাম যতটুকু, পেতাম তার চেয়েও অনেক কম। মন খারাপের এক দুপুরে আদরমাখা কণ্ঠে তুই বললি, প্রতীক, তুই আমার বাসায় খেতে পারিস। যখন ইচ্ছে আসবি। আমি না থাকলেও কাজের মেয়েটাকে বলে রাখবো। তুই খাবি।

তারপর টানা কয়েকটা বছর আমি খেতাম ওর বাসায়। ও থাকতো না মাঝেমধ্যে। ফ্রিজ খুলে, খাবার বের করে, খেতাম পেট পুরে। প্রায়ই খাবারের ভাগ নিয়ে বনিবনা হতো না ওর ছোট ভাই, আমাদেরও, দিদারের সঙ্গে। ও তখন ফ্রিজে আলাদা করে রাখতো দু’জনের খাবার। আর ওর অবুঝ পরীর মতো একরত্তি আরশীর সঙ্গে খেলতাম।

আরশী তখন আমাকে আধো আধো বোলে ‘পরতিক, পরতিক’ বলে ডাকতো। এক সময় আরশীর জন্য কেমন করে ওঠে বুকের ভেতরটা। এই এখন যেমন হচ্ছে। নয় বছরের আরশী, আর পাঁচ বছরের উর্বশী, ওরা যখন মা বলে ডাকবে, তখন কই পাবো শীলাকে আমরা। কিভাবে অবুঝ দুটি শিশুর সামনে দাঁড় করাবো ওদের মা, আমাদের শীলাকে? আরশী, উর্বশী আর তোর, আমাদের, সব কিছুর পরম প্রশ্রয় আদ্যোপান্ত ভালো মানুষ সাঈদ ভাইকে রেখে, কেন তুই চলে গেলি শীলা? কেন? কেন বাজখাঁই ক্যান্সার তোর মতো নিষ্পাপ সরল মানুষটির শরীরেই বাঁধলো এমন সর্বনাশা বাসা?

এক সকালে ওর কান্না ভীষণ মন খারাপ করে দেয় এখনো আমাকে। তখন আমরা ভোরের কাগজে রিপোর্টিং এ। একটি বিশেষ প্রতিবেদনের জন্য সকালে বের হবো। আমি এসেছি মিরপুর থেকে। ও কাঁঠালবাগান ঢালে দাঁড়িয়ে। ওকে ডাকতেই ভয় পেয়ে গেলাম। মাটির দিকে মুখ করে কাঁদছিলো ও। আমি ডাকতেই চোখ তুলে তাকালো। লাল চোখ। চশমার কাচ থেকে ঠিকরে বের হচ্ছিলো বেদনা। জানতে চাইলাম-কি হয়েছে? ও বললো না। শুধু বললো, `আমি সবাইকে নিয়ে থাকতে চাই প্রতীক, দিদার, মা, সবাইকে নিয়ে, এক সঙ্গে। ` অভয় দিলাম: `হবে, পারবি তুই। ` তারপর অ্যাসাইনমেন্টে না গিয়ে গেলাম মধুর ক্যান্টিনে। চা খেলাম। গল্প করলাম। এক সময় স্নেহের মুখ তুলে বললো, `তোরা অনেক ভালো প্রতীক। `

শীলা, ভালো তুই। তোর ভালোতে কোনো রঙ নেই। স্বচ্ছ। এই ভালো শুধু তোর জন্যই তোলা থাক।

আড্ডাপ্রাণ মানুষ ছিলো ও। মিশতে পারতো নিবিড়ভাবে। অফুরন্ত ভালোবাসা নিয়েই টানতো মানুষকে।   চেনাজনদের দেখলেই ডাকতো গলা তুলে, বা পেছন থেকে কাঁধে থাপ্পড় মেরে বলতো, `কি খবর?` ছিলো অফুরন্ত প্রাণশক্তি। আরশী যখন পেটে, তখন সমান তালে কাজ করে তাক লাগিয়ে দিতো ভোরের কাগজের সবাইকে। ও ছিলো সহকর্মীদের প্রাণ। তখন ভোরের কাগজের চারতলার সেই অল্প পরিসর রিপোর্টিং কক্ষেই চলতো প্রকাশ্য ধূমপান। শীলার পেটে আরশী। ধোয়ায় ওর ভীষণ কষ্ট হয়। ও একদিন ধমক দিলো সবাইকে। ব্যস, সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। আর কক্ষে নয়। ধূমপান হবে নিচে। এরপর ও ভোরের কাগজ ছেড়ে দিলো। কিন্তু ওর প্রতি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে সেই থেকে ভোরের কাগজে ধূমপান শুরু হলো নিচে বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে।

শীলা যখন আমার দেশ-এ চলে গেল, যোগাযোগ অনেকটাই কমে এসেছিল ওর সঙ্গে। কিন্তু শীলার সঙ্গে দেখা হলেই চমকে যেতাম ওর অনুভূতি, ভালোবাসার প্রকাশে। ব্যাংকক থেকে চিকিৎসা নিয়ে দেশে এলো। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। ততদিনে ক্যান্সার বেশ ভালোই আসন গেড়েছে ওর শরীরে।

একদিন দেখা হলো ডিআরইউ প্রাঙ্গণে। ডাকলাম। সাড়া নেই। কাছে গেলাম। শব্দ নেই। প্রাঙ্গণের পাশে ইটের বেদিতে বসলো। নিচু মুখ। স্পষ্ট বেদনা। আমি সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম। বললাম, ‘শীলা, তোর কিচ্ছু হয়নি। দেখিস, তুই ভালো হয়ে উঠবি। ’ মুখ তুলে তাকালো শীলা। আমার মুখ থেকে হারিয়ে গেলো শব্দ। ওর চোখ বেয়ে তখন জল গড়াচ্ছে। চশমার কাচ ভেদ করে ঠিকরে বের হচ্ছে প্রগাঢ় বেদনা। হাত দুটি ধরে নীরব কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো শীলা, ‘আমি বাঁচবো না, প্রতীক?’ থেমে গেল চারপাশের হইচই। মানুষের কোলাহল। হুল্লোড়। হাতের তালুতে চোখের জল মুছতেই চোখে পড়লো ফুটফুটে দুটি মুখ-আরশী ও উর্বশী। দূর থেকে গাড়ির জানালা দিয়ে হাসিমুখ নিয়ে তাকিয়ে ছিলো, আমার বন্ধু, ওদের মা, শান্তসুবোধ শীলার দিকে।

প্pratik-Izazরতীক ইজাজ: সিনিয়র রিপোর্টার, সকালের খবর

বাংলাদেশ সময় ১৯৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৩, ২০১২

সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।