জীবনটা ঠিক কবে থেকে বিষিয়ে আছে? ১১ ফেব্রুয়ারি? ৮ জানুয়ারি? নাকি তারও আগে, ১৩ আগস্ট? কোনটা? এসব নিয়েই মনে মনে যখন বিষময় হিসেব কষা, তখন ৩ এপ্রিলও একটা তারিখ হিসেবে যোগ হলো। মাঝে ২৯ মার্চ হারালাম মিনার মাহমুদ ওরফে মিনার ভাইকেও।
গত বছর ১৩ আগস্টে তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীর ভাইকে হারানোর পর প্রথমে শোকগ্রস্ত হলেও পর মুহূর্তে বিদ্রোহ, ক্ষোভে ভরে উঠেছিল মন। নানা ঘটনা-অঘটনের মধ্য দিয়ে ক্ষোভ যখন অস্তমিত প্রায়, তখন নিখিল ভদ্রের পঙ্গুত্ব বরণ, দীনেশদার মৃত্যু আবারও নাড়া দিয়ে গিয়েছিল সেই ক্ষোভের আগুনে। এই মৃত্যু-উপত্যকায় বুঝি কোন শোকই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। একটা এসে আরেকটাকে সরিয়ে দিয়ে জায়গা করে নেয় কেবলই। এবং আসেও আরও বেশি মর্মান্তিক হয়ে। চেতনার সবগুলো পথ রুদ্ধ করে দিয়ে তেমনই একটা দিন এসেছিল...১১ ফেব্রুয়ারি সকালে।
কাছের, খুব কাছের বন্ধু রুনি-সাগরের ‘নাই’ হয়ে যাওয়া, ছোট্ট ছেলে মেঘ এর একা হয়ে যাওয়ার দিন। প্রিয় বন্ধুজন হারানোর চেয়েও, আমরা নতুন করে চিনতে শিখেছি এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, যে আমরা আসলে কেউ না। কোনো মূল্য নেই এই জীবনের। যে কেউ, যেকোনো সময় আমাদের মেরে অনায়াসে চলে যেতে পারে, কোনো আইন তাদের নাগাল পাবে না। কারণ, খুনিরা এই দেশে অনেক শক্তিশালী, তারা ক্ষমার যোগ্য। রাষ্ট্রযন্ত্রের নাকের ডগা দিয়ে তারা ঘুরে বেড়ালেও তাদের খোঁজা হয় টেবিলের ড্রয়ারে, আলমারিতে বা ঘরের দেয়ালে। তাই আমাদের বেঁচে থাকাটাই আজ চরম ঘৃণ্য অপরাধ একটা।
গতকালই কথা হয়েছে এটিএন বাংলার নাদিরা কিরণের সাথে, মেঘকে দেখতে যাবো আজ। গত দুই মাসে আমার মনে এতোটুকু শক্তিও হয়নি ওর কাছে যাওয়ার, কারণ ওকে আমি ভয় পাই। ওর চোখে তাকিয়ে আমি কী বলবো? তারপরও ভেবেছিলাম যাবো।
এরই মাঝে ভোরের কাগজ এর আঙ্গুর নাহার মন্টির ফোন।
‘দিদি, শুনেছো’?
–কথাটা কানে যেতেই আমি চুপ মেরে যাই। কারণ, আমি জেনে গেছি এর পরের লাইনটি কী হয় আজকাল। আমি শুনতে চাই না, আমি শুনতে চাই না আর কোন বিষন্নতা জাগানো খবর।
তারপরও অনুচ্চ স্বরে বলি, কি?
-‘শীলা আপা মারা গেছেন’।
ভিতর থেকে একটা ক্লেদমাখা ধ্বনি মনে হলো উচ্চারিত হলো আমার।
-‘চলে গেছে শীলা?’ মন্টি তখনও নিশ্চিত না। আমাকে খোঁজ নিতে বললো। আমি চাইছিলাম ও যেন তখনই ফোনটা রেখে দেয়, আমার আর ভাল লাগছিল না, ওকে ততক্ষণে অসহ্য ঠেকছিল।
মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্টে চোখ বুলালাম। ইচ্ছে করলো না ‘কনফার্ম’ হতে। কেন কনফার্ম হবো আমি? আর কী কনফার্ম হবো? শীলার মৃত্যুর খবর? আমাকে আর খোঁজ নিতে হলো না। শীলা-সাঈদ আর আমার এক কমন বন্ধু আছে ডাক্তার দীপু (রাশিয়া ফেরত)। ওই ফোন করে বললো, মিরপুর যাচ্ছে।
মনে পড়ে গেল, এই দীপুর ডাক্তার-স্ত্রী যেদিন আত্মহত্যা করলো ছোট ছোট দুটো মেয়েকে রেখে, সেদিন এই শীলাই অসুস্থতা নিয়েও দৌড়ে গিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল বন্ধুর। বাচ্চাদের আগলে রেখেছিল কিছুদিন। আর আজ দীপু যাচ্ছে শীলার বাচ্চাদের সান্ত্বনা দিতে। কে কাকে কখন কীভাবে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছি, কে বলতে পারবে?
সমস্ত শক্তি দিয়ে মনে করতে চাইলাম পিছনের দিনগুলো। শীলা....শীলা....শীলা। কী সুন্দর নাম, যেমন দেখতে, তেমনি তার বিনয়! দেখা হতেই একগাল হাসি। মনে কোন খেদ নেই, ক্ষোভ নেই, বিষন্নতা নেই। যেন রাজ্যের সব সুখ সে নিয়ে এসেছে এই পৃথিবীতে। কিন্তু কে জানতো এই সুখের আড়ালেই লুকিয়েছিল এক মহা অসুখ?
২০০১ সালের কথা। ও ভোরের কাগজে, আমি প্রথম আলোতে। দুজনেরই তখন নির্ধারিত/অবধারিত ‘নারী-শিশু’ বিট। কত কষ্টে, খুঁজে-খুঁজে নিউজ বের করে আনা। নির্যাতিত নারী-শিশুর খবরের অভাব নেই, কিন্তু অভাব ছিল নীতি নির্ধারক মহলে নারী-শিশুর উন্নয়নের খবরের। দুজনেই তখন মিরপুরে থাকি। সকাল থেকে হানা দিতাম সচিবালয়, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। তখন এগুলোই খবরের আধার ছিল। আমাদের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা থাকলেও, স্পষ্ট মনে আছে, শীলার সঙ্গে কোনোদিন আমার কোন বিষয়েই দ্বন্দ্ব তৈরি হয়নি। এতো হাসিখুশি মেয়ের সাথে দ্বন্দ্ব করে কোন দুর্ভাগা?
আজ সকালে শীলা আফরোজা নামের সেই মেয়েটিকে হারিয়েই আমি দুর্ভাগা হলাম। ভীষণ অপরাধবোধে ভুগছি শেষবেলায় একটিবারের জন্যও দেখতে যাইনি বলে। মন্টি আর আমি কতদিন বলাবলি করেছি, ভেবেছি, যাবো। কিন্তু হয়নি। এই পোড়ার দেশে ঘটনার তো অভাব নেই, কিছু না কিছু সবসময়ই আমাদের আটকে দিয়েছে। প্রিয় মুখখানি একটিবারের জন্যও দেখা হলো না। আজ মন্টি ফোন করে সেই কথাটিই বারবার বলছিল, `দিদি, কেন গেলাম না দেখতে?` এর কোন উত্তর কি আছে আমার কাছে? নেই।
ভোরের কাগজ ছেড়ে ও যোগ দিয়েছিল আমার দেশ পত্রিকায়। খবরটা শুনে চোখ কপালে তুলতেই শীলা বলে উঠেছিল, ‘দিদি, একটু বেশি বেতন পেলেই হলো’। তারপরেই খবর পেলাম একদিন শীলা অসুস্থ। জানলাম ব্রেইন টিউমারের খবর। ছোটবেলা থেকেই মাথাব্যথার সমস্যা ছিল। ব্যথা হলে পেইন কিলারই ছিল সম্বল। টানা তিনদিন ব্যথায় কাতর হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতেই জানলো, মূল সমস্যা আরও গভীরে। আমি ওর এই গল্প শুনে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। সেই ছোট্টবেলা থেকে আমিও যে মাইগ্রেনে ভুগছি। ওর চাপে পড়ে আমিও যাই ডাক্তারের কাছে। সব দেখেশুনে ডাক্তার তখন আমায় সিটি স্ক্যান করাতে বলেছিলেন। আমি আর যাইনি।
শীলা সেই যে অসুস্থ হলো, আর ভাল হলো না। আমরা দল বেঁধে তার বাসায় যাই সাহস জোগাতে। মুখে তার সেই চিরপরিচিত হাসি, প্রশান্তির সহজ প্রলেপ সারা চোখে-মুখে। এতো প্রশান্তি কোথা থেকে পেয়েছিল মেয়েটি?
পরে যখন প্রায়ই ফোন করে খোঁজ নিতাম, ওর কথায় একটাই আকুতি ভেসে আসতো, দিদি একবার আসো, দেখে যাও। তুমি তো আমার মেয়েদের দেখলে না। একবার আসো...আমার আর যাওয়া হয়নি। কতটা অসামাজিক হলেই আমার পক্ষে এটা সম্ভব হয়েছিল, এখন ভেবে নিজেকেই বার বার ধিক্কার দিচ্ছি।
একে একে সব কাছের মানুষ দূরে চলে যাচ্ছে। একজন করে যাচ্ছে, স্থান খালি হচ্ছে মোবাইল ফোনের কললিস্টে, ফেসবুকে তাদের প্রোফাইল থেকে যাচ্ছে আরও বেশি যন্ত্রণাদায়ক হয়ে। শীলাও আজ থেকে `ইনঅ্যাক্টিভ` হয়ে গেল ফেসবুকের বন্ধু তালিকা থেকে। অবশ্য গত ৬/৭ মাস ধরেই ও বিছানায় পড়েছিল, গত ১৬ অক্টোবর তাকে জানানো জন্মদিনের শুভেচ্ছাও সে নিতে পারেনি।
ব্রেন টিউমার নিয়ে যে কষ্টটা সে করলো, তাতে এখন সে অনেকটাই শান্তি পাবে আশা করি। কিন্তু মেয়ে দুটো? এমন সুন্দর দুটো মেয়েকে রেখে সে কোন শান্তিতে থাকবে, কে জানে??? কত স্মৃতি, কত কথা!
অসুস্থ হওয়ার পর প্রায়ই বলতো, রিপোর্টিংটা খুব মিস করছে সে। সে তখন খুব সম্ভবত ডেস্কে কাজ করছিল। রিপোর্টিং জীবনের অনেক পুরস্কার যার থলেতে, সে কী আর কোনো বন্ধনে আবদ্ধ থাকে? নাকি রাখা যায়? আজ চিরতরে বন্ধন ছিন্ন করে চলে গেছে শীলা। আর ফিরবে না।
দেখা হলেই বলতো শীলা, দিদি, নিজের জন্য নয়, মেয়েটার জন্য খারাপ লাগে...তারপর তো আরও একটি মেয়ে হলো....শীলাও ধীরে ধীরে আরও খারাপের দিকেই গেল...এখন একেবারেই.....ভাল থেকো শীলা। আমরাও আসছি।
সুপ্রীতি ধর, সাংবাদিক
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।