দুঃসংবাদটি প্রথম আলম ভাইয়ের কাছে পাই। আহমেদ নূরে আলম।
গতকাল (মঙ্গলবার) থেকে শুধু সাইদের কথা খুব মনে পড়ছে। সাইদুজ্জামান। শীলার স্বামী। আমার প্রিয় স্পোর্টস জার্নালিস্টদের একজন। এরা দু’জনে ভালোবেসে বিয়ে করে ঘর বেঁধেছিলেন। অলক্ষ্যে পিছু পিছু হেঁটে এসেছিল একটি কালো ছায়া। ঘাতক ব্যাধি। সে ঘাতক তছনছ করে দিয়ে গেছে তাদের স্বপ্নের ঘর। সাজানো সংসার। প্রিয়তমা স্ত্রীর অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে গত ছ’বছরের বেশি সময় ধরে সাইদ কী অকল্পনীয় কষ্ট-সংগ্রাম করেছেন, তার কিছুটা চোখে দেখেছি। শীলার মৃত্যুর মাধ্যমে সে কষ্ট-সংগ্রামের পালা শেষ হয়ে গেলো না। তাদের বাচ্চা দুটি ছোট। এদের এখন বাকি জীবন সাইদের একা একাই আগলে রেখে দেখভাল করে যেতে হবে। এরাই যে এখন তার কাছে ভালোবাসার মানুষ, শীলার রেখে যাওয়া স্মৃতি। আমরা আজ কাঁদছি কাল ভুলে যাবো, কিন্তু এই শোক তো সাইদকে বয়ে বেড়াতে হবে সারাজীবন! শীলার সঙ্গে তো আর দেখা হবে না কোনোদিন। সাইদের সঙ্গে যেদিন আবার দেখা হবে, কীভাবে বলবো তাকে? ভাবতে গেলে চোখ ভিজে ভারি হয়ে আসে।
শীলার প্রতি আমার আগ্রহ-আকর্ষণ ছিল অন্য একটা কারণে। রিপোর্টিং উপলক্ষে দেশের বাইরে গেলে সব জায়গাতে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের বিশেষ উপস্থিতি চোখে পড়তো খুব। শীলারা যখন জার্নালিজম শুরু করেন, তখনও ঢাকায় তাদের সংখ্যা অল্প কয়েকজন মাত্র। সম্ভবত মাহমুদা চৌধুরী, আফরোজা নাজনীন এরা ঢাকার রিপোর্টিংয়ে প্রথম মাঠ পর্যায়ের রিপোর্টিংয়ের সঙ্গে জড়ান। দৈনিকে কাজ শুরুর আগে বিচিত্রায় চলচ্চিত্র সমালোচনা লিখে সাড়া ফেলে দেন মাহমুদা চৌধুরী। সাপ্তাহিক সন্দ্বীপে রাজনীতিকদের ইন্টারভ্যু করে সাড়া ফেলেন আফরোজা নাজনীন। ঢাকার বাইরে একা লড়ে যাচ্ছিলেন চট্টলার সুমি খান। এদের দেখাদেখি পরে সাপ্তাহিক-পাক্ষিকের পাশাপাশি অনেক মেয়ে দৈনিক পত্রিকায় এসেছেন। মুন্নী সাহা, শাহনাজ মুন্নীদের পিছু পিছু প্রথা ভেঙে মিছিলের মতো হেঁটে আসেন, আইরিন নিয়াজি মান্না, ফারজানা রূপা, মনিজা রহমান, শীলা আফরোজাসহ আরও অনেকে। ক্যামেরা হাতে আসে ফারজানা খান গোধুলি। (সবার নাম এই মুহূর্তে ধারাবাহিক সাজিয়ে লিখতে পারছি না বলে দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী)। প্রথা ভাঙার কথাটা বলার কারণ আগে দেশের মিডিয়ায় মেয়েদের ধরাবাঁধা জায়গাটি মূলত ছিল পত্রিকার মেয়েদের পাতায়। নারীস্থানে! অথবা নিউজ ডেস্কে। যেন মেয়েরা শুধু রেডিও মনিটর করবে, অনুবাদ ইত্যাদি করবে। দৈনিকগুলো প্রথম রিপোর্টিংয়ে মেয়েদের নেওয়া শুরু করলেও কর্তাদের মাথায় থাকতো এরা মেয়েদের-বাচ্চাদের নানা বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করবে। শুরুতে শীলা তেমন শুরু করলেও পরে সচিবালয় বিটে কাজ শুরু করেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ প্রভাবিত নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় জেনারেল রিপোর্টিংয়ে মেয়েদের জায়গা করে নেওয়া যে কত সংগ্রামের তা জনকন্ঠের পাশের আসনে বসা নাজনীনের সংগ্রামে দেখেছি। এখন অবশ্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার নতুন উন্মেষের কারণে মূলধারার মিডিয়ায় মেয়েদের জায়গা অনেক বেড়েছে।
ঢাকার মিডিয়ার তরুণ রিপোর্টারদের সঙ্গে বরাবর বন্ধুত্বের একটি সম্পর্ক ছিল এবং এখনও আছে। আমি সবার বারী ভাই। সব কথা শেয়ার করা যায়। শীলার কাজ দেখতাম মিডিয়ায়, রিপোর্টের নানা ভেন্যু, রিপোর্টার্স ইউনিটিতে প্রায় দেখা হতো। রিপোর্টিংয়ে পরপর দুটি পুরস্কার তাকে আরও নিয়ে আসে লাইমলাইটে। সাইদ জনকণ্ঠের স্পোর্টসে যোগ দেবার পর আমাদের অফিসে যাতায়াত বাড়ে শীলার। আমাদের ভাইবোনের সম্পর্কটা তখন আরও গাঢ় হয়। আমাদের অফিসটায় এক ধরনের পারিবারিক আবহ ছিল। জনকণ্ঠের ক্রীড়া বিভাগের আরিফ রহমান শিবলি, আরিফুর রহমান বাবু, শেখ সাইফুর রহমান, মনিজা রহমান, সেকান্দার আলী, এহতেশামুল হক এদের সবার সঙ্গে সাইদের সখ্যের কারণে শীলাও হয়ে ওঠেন আমাদের এ পরিবারের সদস্য। আমাদের বোন। তার অসুস্থতা প্রথম ধরা পড়ার পর উদ্বিগ্ন হয়েছি। আমি তখন রোগীদের নিয়ে কাজ করি। এমন একটি ঘাতকব্যাধি কারও ধরা পড়লে একটি পরিবারে তা কী আতঙ্কের সৃষ্টি হয় জানি। অভাগা দেশ আমাদের! ঘাতক কোনো একটি রোগ ধরা পড়লে প্রথমে টাকার চিন্তায় রোগী আর পরিবারের সদস্যরা প্রায় অর্ধেক দমে-মরে যান! সীমিত আয়ের সাংবাদিক পরিবারে তাতে যে কী করুণ-নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাও জানি। আমরা সাংবাদিকরা সারাদিন আরেকজনের জন্য লিখি, আরেকজনের জন্য সাহায্য চাই। কিন্তু নিজেদের কষ্টের কথাগুলো লিখতে পারি না। হাত পাততে পারি না। শীলাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সাইদকে একাকী ডেকে জানতে চাইলাম, কোনো হেল্প লাগবে কিনা, আমি কিছু করতে পারি কিনা। সাইদ ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তার ভাইরা মোটামুটি স্বচ্ছল। তারাই সবকিছু করছেন। শুনে ভালো লাগে। আশ্বস্ত হই। কারণ আমাদের বিপদে যদি কারো কাছে হাত পাতা না লাগে, সেটিই স্বস্তির। শান্তির।
সেই আমাদের বোনটাকে গত ছ’বছরের বেশি একা একা টেনে নিয়ে গেছেন সাইদ। বিদেশ আসার পর থেকে দেশে স্পোর্টসের যার সঙ্গে যখন আলাপ হতো তার কাছেই বিশেষ করে আরিফুর রহমান বাবুর কাছে শুনতাম শীলার জন্য সাইদের সংগ্রামের কথা। ভারতের বাইরে ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরেই নিতে হয়েছে তিনবার! এসবের পেছনে মূল আর্থিক যোগানদাতা হিসাবে কাজ করেছেন সাইদের বড়ভাই। বসুন্ধরা গ্রুপও সহায়তা করেছে। সব সংগ্রাম পণ্ড! ঘাতকব্যাধির কাছে হেরে গেল সাইদের সমস্ত সংগ্রাম! কিন্তু আমার বোনটিকে যেভাবে সাপোর্ট দিয়ে গেছেন সাইদ, তা অতুলনীয়। শীলার মৃত্যু সংবাদ জানার পর বাবু ভাইকে ফোন করেছিলাম। ভালো লাগলো বোনটির মরদেহ যতক্ষণ ঢাকায় ছিল, বাবু ভাইসহ সবাই সারাক্ষণ ছিলেন সাইদের পাশে। সবার ভালোবাসার কান্নায় ভিজেছে আমার বোন শীলার শেষ যাত্রাপথ। শেষ শয্যা হয়েছে চাঁদপুরের গ্রামের মাটিতে। পারিবারিক গোরস্থানে। তোমাকে মনে থাকবে বোন। সাইদ, আরশি, উর্বশীর জন্য সমবেদনা।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১০১২ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০১২
- কে হায়, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
- ‘আমি মারা গেলে তোরা দেখতে আসিস’
- কোথায় হারিয়ে গেলে শীলা!
- চলেই গেলি, শীলা!
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর, মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।