মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার ট্রাইবুন্যালে একাত্তরের নৃশংস খুনি, যুদ্ধাপরাধী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের(সাকা) চৌধুরীর বিচার শুরু হয়েছে। এ নিয়ে বুধবার সাকা চৌধুরী ট্রাইবুন্যালে কি ধৃষ্ট আচরণ করেছেন, এর বিস্তারিত বিবরণ জাতীয় পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য মিডিয়ায় আছে।
আমাকে একজন শহীদের সন্তান একদিন বলেছিলেন, ‘‘এদের বেহায়া-বেশরম লম্ফ-জম্ফ দেখে হাতটা মুষ্ঠিবদ্ধ হয়। নিশপিশ করে, ইচ্ছে করে দৌড়ে গিয়ে একটা সজোর থাপ্পড় মেরে আসি। এদের জন্য আবার কিসের এসব লম্বা বিচার!’’ আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বলি, ‘‘আমাদের এখন ধৈর্য ধরতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এই প্রথম রাষ্ট্র এই ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে বিচার শুরু করেছে। শত উস্কানির মধ্যেও আমাদের ঠাণ্ডা মাথায় এই বিচারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে হবে আষ্টেপৃষ্ঠে। ’’
১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকালে সাকা চৌধুরী হানাদার পাকসেনাদের সঙ্গে নিয়ে গহিরার কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ে যান। এরপর নূতনচন্দ্র সিংহের বাড়িতে যান। সেখানে মন্দিরে প্রার্থনারত নূতনচন্দ্র সিংহকে টেনে হিঁচড়ে বের করেন সাকা। তারপর পাক সেনাদের বলেন, তাকে হত্যার জন্য তার পিতা ফকা চৌধুরীর নির্দেশ আছে। এ সময় পাকসেনারা নূতনচন্দ্রকে গুলি করে। পরে সাকা নিজেই তাকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
একাত্তরের চট্টগ্রামে সাকার বাবা ফকা চৌধুরীর(ফজলুল কাদের চৌধুরী) বাড়ি গুডহিলস নামের জল্লাদখানায় সাকা যে প্রধান জল্লাদ ছিল তা ভুক্তভোগীরা জানেন। কতোজনকে যে সেখানে নৃশংস নির্যাতনের পর খুন করা হয়েছে সেই জল্লাদখানায়! আজকের রয়টারের সাংবাদিক নিজামউদ্দিন সহ আরও অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সেই নির্যাতনকারীদের সাকা সবসময় বলতেন, বাংলাদেশের নাম জন্মের মতো ভুলিয়ে দিতে হবে।
আমি একবার রাউজানের উনসত্তুরপাড়া গ্রামে সাকা বাহিনীর তাণ্ডবের স্মৃতি সেই বধ্যভূমি দেখতে গিয়েছিলাম। একাত্তরে হিন্দু-ধর্মাবলম্বী-প্রধান গ্রাম ছিল উনসত্তুরপাড়া। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর গ্রামটির বেশিরভাগ লোকজন প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে যান। যারা তখনও যেতে পারেননি তাদের ধরে নিয়ে এক পুকুরপাড়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে নৃশংস সাকা বাহিনী। এরপর সেই শহীদদের সেই পুকুরপাড়েই মাটিচাপা দেয়া হয়। সেটিই সে তল্লাটে এখন উনসত্তুরপাড়া বধ্যভূমি হিসাবে চিহ্নিত-পরিচিত। গত বিএনপি আমলে আমি যখন গ্রামটায় যাই, শহীদ পরিবারগুলোর স্বজনদের একটাই জিজ্ঞাস্য ছিল, তারা কী কোনোদিন স্বজন হত্যার বিচার পাবেন না? সত্যি বলতে কী তাদের সেদিন কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি।
কারণ আজকের মতো রাষ্ট্র যে এভাবে এ বিচারে সত্যি সত্যি উদ্যোগী হবে, তা আমরা তখনও ভাবতেই পারিনি। কারণ এই সাকাদের ক্ষমতার স্বাদটা প্রথম দিয়েছে স্বৈরাচারী এরশাদ। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে সাকাকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় তার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা করেছেন। সাকার পরিবারের সঙ্গে শেখ হাসিনার পরিবারের সম্পর্কও বরাবরই ভালো ছিল বলে শোনা যায়। সে কারণে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিঙ্কুকে ঠকিয়ে সাকা পরিবারের সদস্য ফয়জুল করিম চৌধুরীকে একবার মনোনয়ন দিয়ে এমপিও বানানো হয়। তোফায়েল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে সাকার ঘনিষ্ঠতার প্রচার ছিল। বাংলাদেশে এসব ব্যক্তিগত সম্পর্কের গুরুত্ব কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নীতি-আদর্শের উপরে গুরুত্ব পায়। তাই সেদিন উনসত্তুরপাড়ার মানুষজনকে সরাসরি কোন আশ্বাস দিতে পারিনি। শুধু বলেছি আমিতো এই বিচারের পক্ষে সবসময় লিখি, আমার লেখার কাজ আমি চালিয়ে যাব। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় সাকার নাম অন্তর্ভূক্ত হবার পর সবার আগে সেই উনসত্তুরপাড়ার বিচারপ্রত্যাশী গ্রামবাসীর কথা মনে পড়েছে। আর মনে পড়েছে চিরসত্য সেই কথাটি, ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ’ দেরিতে হলেও নড়ে!
চলতি ট্রাইবুন্যাল, প্রসিকউশন, তদন্ত টিম গঠনের পর থেকে এসবকে বরাবর কথার তুড়িতে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সাকা। নানাভাবে বলার চেষ্টা করেছেন তার গায়ে হাত দিয়ে সরকার আদৌ হাত পোড়াবার চেষ্টা করবে কীনা! তার গায়ে হাত দিলে চট্টগ্রাম অচল করে দেওয়াসহ নানান হুমকি-ধামকিও দেখানো হয়েছে! চট্টগ্রাম পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে, বরাবরের মতো এমন উদ্ভট কথা বলার চেষ্টাও হয়েছে। এভাবে সাকা বরাবর বোঝাতে চেয়েছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা অস্তিত্বের চেয়ে তার সত্তাটি অনেক বড়! কিন্তু কার্যত প্রমাণ হয়েছে এর সবই সাকার স্টাইলের বাগাড়ম্বর-অশ্বডিম্ব! বাংলাদেশ তার জায়গাতেই ঠিক আছে। সাকার মতো কোনো বাংলাদেশবিরোধী যুদ্ধাপরাধীর গ্রেফতারে অচল হয় না বাংলাদেশের এক ইঞ্চি! চট্টগ্রামও বাংলাদেশেই আছে, ইন্ডিয়া হয়ে যায়নি। মানুষ বরঞ্চ তার মতো খুনি-যুদ্ধাপরাধীর গ্রেফতারে দেশ-বিদেশের নানা অঞ্চলে মিষ্টি বিতরণ করেছে।
সেই সাকা শুরু থেকে তার স্বভাবজাত ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দিয়ে কোর্টে-জেলখানায়-হাসপাতাল সহ নানা জায়গায় বিশেষ একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির মতলবে আছেন। নানা জায়গায় একই কোরাস গাইছেন রাজাকার পত্মী সাকার স্ত্রী এবং তার সন্তানেরা। এদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা আর সাহসের নাম বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। চট্টগ্রামে খালেদা জিয়া নিজের মহাসমাবেশের মঞ্চে সাকার পত্মী ও সাকার সন্তানদের বক্তৃতা দিতে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে নিজের সাম্প্রতিক ছদ্ম নিয়তটাকে আরও খোলাসা করেছেন! এসবের আস্কারা ও প্রশ্রয় পেয়ে সর্বশেষ পল্টন ময়দানে বিচার নিয়ে কটাক্ষ করেছেন রাজাকার সাকার পত্মী! বুধবার ট্রাইবুন্যালে একই রকম ধৃষ্ট আচরণের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন সাকা আর তার আইনজীবী! এরা কিন্তু এমন ঔদ্ধত্যের মাধ্যমে বরাবর নিজেদের আইনের ধরাছোঁয়ার উর্ধ্বে দেখানোর পাঁয়তারা করে যাচ্ছে। তারা সাকার সঙ্গে কাশিমপুরের কারাগারে যাওয়ার পর জেলার সহ লোকজন তাদের কাছে লাখ লাখ টাকা উৎকোচ দাবি করেছেন মর্মে উদ্ভট অভিযোগ করে পানিঘোলার চেষ্টা করেছিল সাকার স্ত্রী-সন্তানেরা। কিন্তু তা ধোপে টকেনি।
বুধবার ট্রাইবুন্যালে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে সাকা আর তার আইনজীবী জানান দিয়েছেন, বিচার প্রক্রিয়া চলার পুরো সময়টায় তারা এমন হৈ হল্লার মাধ্যমে একটা কিছু ঘটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবেন! আমাদেরও বিচার করনেওয়ালাদের নিয়ত হয়েছে তারা এই কুখ্যাত খুনিদের বিচার নিরপেক্ষ-আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে করে যাবেন। কিন্তু ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল, বসনিয়া-আর্মেনিয়ার গণহত্যা সহ এমন সব ট্রায়ালের বৃত্তান্ত ঘেঁটে দেখলে দেখা যাবে, এই ট্রাইবুন্যাল বড় বেশি সহিষ্ণু ও স্বচ্ছ।
এদেশে সকাল-বিকাল যেখানে ছিঁচকে সন্ত্রাসীদের ক্রসফায়ারের নামে শর্টকাট বিচার চলে, আর দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, গণহত্যায় সক্রিয় জড়িতদের বিচারে রাষ্ট্র নিয়ত করেছে উদার-নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক মানের বিচারের! যাই হোক আমরা চাই দ্রুত বিচার। এসব আত্মস্বীকৃত খুনি-যুদ্ধাপরাধীর বিচার যখন চলছে তখন বিচারালয়ের দিকে আমাদের সতর্ক চোখ বাড়াতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে কোনো উছিলায় এরা যেন ট্রাইব্যুনাল বা আশেপাশের কোথাও যাতে কোনো অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে না পারে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, প্রজন্ম একাত্তর, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মতো সংগঠন গড়ে তুলতে পারে এর জন্যে পৃথক নজরদারি স্কোয়াড। এই স্কোয়াডের সদস্যরা ট্রাইব্যুনালসহ দেশের এলাকায় এলাকায় ঘাতকচক্র আর তাদের দোসরদের ওপর নজরদারি বাড়াবেন। এই ঘাতক, তাদের দোসরদের সামাজিকভাবে বয়কট, এসব আসামি-দোসররা ট্রাইবুন্যালে ঢুকতে-বেরুতে তাদের উদ্দেশে ঘৃণা-থু থু নিক্ষেপ কর্মসূচিও চলতে পারে। কিন্তু এর সবকিছু হতে হবে সুশৃংখল। ঘাতক দালাল ও তাদের দোসরদের পাতা ফাঁদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে আমরা যেমন জিতেছি, এ যুদ্ধেও জিতবো। মুক্তিযুদ্ধে আমরা যেমন ছিলাম নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ, এ যুদ্ধেও তেমন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আমাদেরই। ঘাতকচক্রের ভরসা বিএনপিনেত্রী খালেদা জিয়াও এক্ষেত্রে তাদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেবার নৈতিক সাহস হারিয়েছেন। এক্ষেত্রেও স্পষ্ট হয়েছে বিজয়ের ইঙ্গিত। এ বিজয় মুঠোবদ্ধ করে আমাদের শহীদমাতাদের কাছে পৌঁছাতে হবেই হবে। এই বিচারের আশাতেই যে এখনও বেঁচে আছেন আমাদের অনেক শহীদমাতা। জাগো বাহে---!!
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।