এক সময়কার ‘ইউনিফাইড’ আওয়ামী লীগ এখন ‘ফ্র্যাকশন ও ফিকশনের’ নিপুণ সমন্বয়। দলের অভ্যন্তরে রাজনীতিচর্চা, নেতৃত্ব তৈরি ও দলীয় কর্মকাণ্ডে মনোযোগী হবার বদলে চলে গ্রুপিং-পাল্টা গ্রুপিং।
নেতৃত্ব দলীয় কর্মকাণ্ডে ও রাজপথের অবদানে নির্ধারিত হয় না। নেতৃত্ব মনোনীত হয় রাতের অন্ধকারে বেডরুমে-ড্রইয়িংরুমের রঙিন আসরে। নেতৃত্বের জন্যে এখন চাই কেবল ‘নিশ্চুপ ও নীরব’ মিটিমিটি হাসির যোগ্যতা।
কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্য্যন্ত খালি ফ্র্যাকশন। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে মরিয়া। ক্ষমতাসীন হবার পর এই কোন্দল আরো চরমে উঠেছে। বিরুদ্ধপক্ষকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ জামায়াত কিংবা ‘মাইনাস ওয়ান’ ষড়যন্ত্রকারী আখ্যা দেয়া এখন নৈমিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ মাত্র। দলের নেতৃত্বকে নিরাপদ রাখার একমাত্র উপায় হচ্ছে চোখ-কান বুঁজে থেকে মূল নেতৃত্বের কাছে নিজের বশংবদ পরিচয় নিশ্চিত করা।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতারা সাংগঠনিক ও তৃণমূল পর্যায়ের কোন্দল-দলাদলিতে বিনোদন খুঁজে পান। আওয়ামী লীগে যোগ্যতার ভিত্তিতে মনোনয়ন হয় না। মনোনয়ন প্রাপ্তির তরিকা দু’টি: আত্মীয়তা ও গ্রুপিং এবং নগদে কেনা। সাম্প্রতিক দু’তিনটি মেয়র নির্বাচনে গ্রুপিং ও নগদ নারায়ণের জোরে কেন্দ্রীয় নেতারা একবার এই প্রার্থীকে সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য দেন। পরক্ষণেই অন্য কেন্দ্রীয় নেতা জানান, এখনো মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়নি। নারায়ণগঞ্জে নির্বাচনে তৃণমূলনেতৃত্ব ও জনমতের প্রতিফলন বুঝতে অক্ষম কিংবা না বুঝতে চাওয়া আওয়ামী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গ্রুপিংয়ের প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েও হঠাৎ নীরব হয়ে যায়। ভাগ্যিস নির্বাচিত আইভী ‘বেইমানি’ করেন নি। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের গ্রুপিংকে অস্বীকারকারী আকরাম সাহেবের বিরুদ্ধ দলীয় খড়্গ ঠিকই কাজ করেছে।
পাশ্চাত্য গণতন্ত্রে দু’টি প্রবাদ বেশ জনপ্রিয়। ‘পিপল স্টপড লিসেনিং টু গভরমেন্ট’ আর ‘গভরমেন্ট স্টপড লিসেনিং টু পিপল’। হালের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্যে দু’টি প্রবাদই প্রযোজ্য। আওয়ামী লীগের অর্জন ও সাফল্য জনগণের মাঝে মার্কেটিং করার কাজে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ ব্যর্থ। মধ্যবিত্ত জনগণের মধ্যে আওয়ামীলীগের কোনো ইতিবাচক ইমেজ আছে বলে মালুম হতে চায় না। ‘প্রোডাক্ট’ যতোই ভালো হোক, মার্কেটিংয়ের ব্যর্থতার কারণে বাণিজ্য সফল হয় না। গেলোবার আওয়ামী লীগের নেতিবাচক ইমেজ হয়েছিলো ছোটখাটো সংশোধনযোগ্য ‘ভুলের’ কারণে। লক্ষ্মীপুরের তাহেরের তাণ্ডব, হালের ‘নখদন্তহীন’ জয়নাল হাজারী, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ’র দুই গুণধর পুত্রের ‘নিরীহ’ তৎপরতা আর মায়া-পুত্র দীপুর ‘আবেগী আবদার’ আওয়ামী লীগের সকল সাফল্য ভাসিয়ে নিয়েছিলো। আশ্চর্য, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বিনা স্বার্থেই কেবল অহংবোধের কারণে ওদের ‘কীর্তিগুলোকে’ নিজের স্কন্ধে টেনে নিয়েছিলেন। অহংবোধে ডুবেছিলো নৌকা।
এবারে হাজারী ও হাসনাত আবদুল্লাহ পুরোপুরি উপেক্ষিত। লক্ষ্মীপুরের তাহের-পুত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমায় ধন্য। মায়া মন্ত্রিত্বে না হলেও রাজপথে-মহানগরের নেতৃত্বে সরব। মায়া-পুত্ররা এখন বেশ ‘ম্যাচিওরড’। আগের মতো ‘আবেগী আবদারের’ বদলে কর্পোরেট স্টাইলে ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। যারা কর্পোরেট আবদারের শিকার হয়েছেন বা হচ্ছেন তারা জানেন, মায়া মেয়র হলে কী কী খেসারত দিতে হবে! চাঁদাবাজির অংক বেড়ে কোথায় ঠেকবে? বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপনের আয় কার পকেটস্হ হবে?
এইমাত্র (০৫ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় বিকাল ০৪টা ৫১ মিনিট) ঢাকার একটি ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সূত্র ফোনে জানালেন, বস্তির ভোটব্যাংক নিশ্চিত করতে একটি মহল বস্তিবাসীদের মধ্যে আতংক সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। বস্তিবাসীদের বোঝানো হচ্ছে, আওয়ামী প্রার্থী না জিতলে বস্তিগুলো উচ্ছেদ করা হবে। উল্লেখ্য, ঢাকা উত্তরের ভোটার তালিকার সাত শতাংশ বস্তিবাসী। )
অর্থাৎ সব মিলিয়ে ঢাকার মেয়র নির্বাচন নিয়ে বড়ই বেকায়দায় আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিরোধী বিএনপি দ্বিধা-বিভক্ত ঢাকার মেয়র নির্বাচনে কোনো প্রার্থী দেবার সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি। যদি প্রার্থী নাও দেয়, বিএনপি কাউকে না কাউকে সমর্থন দেবে। সেক্ষেত্রে মান্না বিভিন্ন ‘রসায়নে’ সম্ভবতঃ হবেন তাদের সেরা পছন্দ। এরই মধ্যেই উত্তরে ‘বেয়াড়া’ মান্না বিনা খরচায় প্রচারণায় নির্বাচনী মাঠ দখলে রেখেছেন। মান্নাকে সামাল দেবার জন্যে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নিয়ে ভাবছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। মান্নার অতীত দুই সহযোগী কমরেড ডাকসুর আক্তারুজ্জামান আর জাসদের শিরীন আখতারকে ‘লেলিয়ে’ দেয়ার পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে। পরিকল্পনাটির সাফল্যের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ বলে মনে হয়। জাতীয় পার্টির সমর্থনও একটা বিরাট ফ্যাক্টর হবে।
এরশাদের বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, কৌশলগত কারণে জাতীয় পার্টি প্রার্থী দিলেও সেই প্রার্থী হবে দুধ-ভাত। ‘মোরাল’ সমর্থন থাকবে মান্নার প্রতি। এদিকে ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী প্রার্থী হয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক মন্ত্রী ও ‘দীপু-পিতা’ মায়া।
এরই মধ্যেই নিরীহ মধ্যবিত্ত শ্রেণী মেয়র নির্বাচনের হিসাব-নিকাশে মনোযোগী হয়ে উঠেছে। নয়া মেয়রের নেতৃত্বে রাজধানীর বিদ্যমান সমস্যার সমাধান হবে নাকি চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি সহ অন্যান্য ‘আনুষাংগিক’ রাজনৈতিক কালচারের’ জমজমাট বিকাশ ঘটবে? পরিচিত মানুষগুলো জানাচ্ছেন, যে মুহূর্তে আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে মায়াকে সমর্থন জানাবেন, সেই মুহূর্তেই আওয়ামী লীগ ঢাকা উত্তরের মেয়র আসনটি খুইয়ে বসবে।
তবে আজরাইল আর ভোটার- এ দু’টোর ওপর চোখ বুঁজে নির্ভর করা যায় না। আজরাইল হুট করে চলে আসে। ভোটার আরও ভয়াবহভাবে চলে যায় বিনা নোটিশে।
পাদটীকা: ঢাকা দক্ষিণের বিশ্লেষণ আগামীতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৪ ঘণ্টা, ০৫ এপ্রিল, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।