ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

একটি ভুলে ৩ হাজার শিক্ষার্থীর জীবন অনিশ্চিত

সিয়াম সারোয়ার জামিল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০১২
একটি ভুলে ৩ হাজার শিক্ষার্থীর জীবন অনিশ্চিত

বৃহস্পতিবার প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে হাঁটছিলাম। দেখলাম কয়েকশ` শিক্ষার্থী সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করছেন।

ব্যানার দেখে বুঝলাম, ওরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কাছে গেলাম শিক্ষার্থীদের। সংহতি সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী সুমনা। কর্মসূচি শেষে কথা হলো তার সঙ্গে। তিনি জানালেন, ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে নিয়মানুযায়ী মেধা তালিকায় স্থান পেয়ে ভর্তি হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ইডেন কলেজের ইংরেজি বিভাগে। এক বছর নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে ক্লাশও করেছেন। ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তে কলেজ কতৃপক্ষ জানায়, তার রেজিস্ট্রেশন কার্ড আসেনি। খোঁজ নিয়ে জানলেন, শুধু তিনি একা নন, আরো অনেকেরই নিবন্ধন হয়নি। ভাবলেন, হয়তো কোথাও ভুল হয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদন করলেন। যা উত্তর এলো তা শুনে যে কোনো শিক্ষার্থীরই মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার কথা!

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, সুমনার ভর্তি বাতিল করা হয়েছে। তিনি ইংরেজিতে স্নাতক পড়ার জন্য উপযুক্ত নন। তাই নিবন্ধন দেয়া হয়নি। একইভাবে "অনুপযুক্ত"তার কারণ দেখিয়ে আরো প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু সুমনার কিংবা ভুক্তভোগী তিন হাজার শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ কি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে কিছুই বলেনি।

সম্প্রতি অব্যাহত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ এক নোটিশ জারি করে। তাতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে, "২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের প্রায় ৩ হাজার জনের ভর্তি ফলাফল ভুল প্রকাশিত হয়েছে। এসব ছাত্র-ছাত্রী ইংরেজিতে পড়ার ন্যূনতম যোগ্যতা ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজিতে ১২ পায়নি। " কিন্তু কেন ভুল প্রকাশিত হলো? শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে নষ্ট হওয়া দুটো শিক্ষাবর্ষের ক্ষতি কে পোষাবে? তাদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম কি হতে পারে তা নিয়ে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি ঐ নোটিশে। কতটা দায়িত্বহীন হলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ এই ধরনের বিবৃতি দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারে, তার নিকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে এই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে।

বৃহস্পতিবারের মানববন্ধনে শুধু ইডেন কলেজ থেকে নয়, শিক্ষার্থীরা এসেছিলেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। রংপুরের বেগম রোকেয়া কলেজ, নারায়ণগঞ্জ ও বরিশালের বিভিন্ন কলেজ থেকেও অনেকে এসেছিলেন শিক্ষাজীবন রক্ষার দাবিতে। গত এক মাস ধরে তারা নিজ নিজ এলাকায় সভা-সমাবেশ-মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। কিন্তু কোনও ফলাফল না হওয়ায় বৃহস্পতিবারে সমাবেশে তারা এসেছেন অনেকটা বেপরোয়া হয়ে। কারণ তারা অধিকাংশই নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। প্রতিটি মহুর্তই তাদের কাছে অনেক মূল্যবান। কর্তৃপক্ষের এই দায়িত্বহীন ঘোষণায় তারা পুরোপুরি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। হতাশায় অনেকেই আত্মহত্যার মন মানসিকতায় এসে পৌঁছেছেন।

১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। শুরুতে এর লক্ষ্য ছিলো বিদ্যমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণেচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীদের অত্যধিক চাপ লাঘব করা এবং একইসাথে অধিভুক্ত কলেজগুলির মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখা। বর্তমানে অধিভুক্ত প্রায় আড়াইশটি কলেজে অনার্স পড়ানো হয়। কয়েক লাখ শিক্ষার্থী এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ন করে। ক্রমশই শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ছে। এত বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শিক্ষার্থীদের জীবন ছেলের হাতের মোয়া নয় যে, "ভুল করলাম আবারও শুধরেও নিলাম"। তাদের প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান। এটা নষ্ট করার অধিকার কারো নেই। এই ভুলও মেনে নেয়া যাবে না। এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বুঝতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এরকম ভুল নতুন নয়। ভুল হতেই থাকে। একটা দুটো নয়, অসংখ্য ভুল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে এবছরও। ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে অনার্স প্রথম বর্ষের ভর্তি প্রক্রিয়ার ফলাফল ১লা জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম তালিকার স্থলে প্রকাশ করা হয়েছিল সংশোধিত নতুন তালিকা। ভুলভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়নের কারণে ফল প্রণয়নেও মারাত্নক ত্রুটি ধরা পড়ে। আর এ কারণে কর্তৃপক্ষ আগের ফলাফলে সংশোধনী আনে। কিন্তু সংশোধিত ফলাফল প্রকাশের আগেই  দেশের অনার্স কলেজে ২ লক্ষাধিক আসনের মধ্যে অন্তত ১ লাখ শিক্ষার্থী আগের ফলাফল অনুযায়ী ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফেলেছিল। তারা এখন ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের আন্দোলনরতদের অবস্থা দেখে আতঙ্কিত এই ভেবে যে, পাছে কয়েকদিন পর হয়তো তাদেরও ভর্তি বাতিলের ঘোষণা আসতে পারে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়-অধিভুক্ত কলেজ সমূহে নেই পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক কিংবা ক্লাশরুম। কোনো গবেষণার ব্যবস্থাও নেই। চার বছরের অনার্স কোর্স সেশনজটের কারণে শেষ করতে হয় সাত-আট বছরে। এখানে শিক্ষার জন্য না আছে সুষ্ঠু পরিবেশ না আছে সঠিক পরিকল্পনা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়-অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা আসলে সম্পদ নাকি বোঝা তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। কিন্তু তারপরও শিক্ষার্থীরা উপায়ান্তর না দেখে বাধ্য হয়ে এসব কলেজে ভর্তি হন উচ্চশিক্ষা লাভের স্বপ্ন নিয়ে। সেই রকম স্বপ্ন নিয়ে পড়তে আসা প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থীর স্বপ্ন এখন অনেকটা গলার ফাঁস হয়ে উঠেছে।

শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকার আসলে কতটুকু তৎপর ? ১১ লাখ শিক্ষার্থীর প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সরকারের বাস্তব পরিকল্পনাটাই বা কি, তা স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন। একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুল ফলাফল প্রকাশের কারণে শিক্ষার্থীরা কেন তাদের জীবন নষ্ট করবে তার ব্যাখ্যাও কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তবে তাদের ভর্তি বহাল রেখে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
সবশেষে, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবেদন, ভর্তি বাতিল হওয়া শিক্ষার্থীদের ভর্তি বহাল করতে দ্রুত উদ্যোগ নিন। কারণ, ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয়ে এইসব তরুণ-তরুণীর জীবননষ্টের দায়ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। সাংবিধানিকভাবেই রাষ্ট্র সে দায়ভার নিতে বাধ্য।

লেখক: সিয়াম সারোয়ার জামিল, কবি ও ব্লগার।
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।