বর্তমান বিশ্বে ক্রীড়াঙ্গনের প্রাণ ও প্রধান চালিকাশক্তি হলো স্পন্সরশিপ। ধনতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক সব দেশের খেলাধুলায় ঘরোয়া কার্যক্রম, আন্তর্জাতিক এবং বিশ্ব পর্যায়ে বিভিন্ন খেলার প্রতিযোগিতা-টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠানের পেছনে সম্পৃক্ত আছে বাণিজ্যিক স্পন্সরশিপ এবং করপোরেট হাউসের সাহায্য ও সহযোগিতা।
ক্রীড়াঙ্গনে অলিম্পিক হলো সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড। একটা খেলা নয়, একসঙ্গে অনেক খেলার আসর। সারা পৃথিবী অংশ নেয়। দুনিয়াজুড়ে ক্রীড়াঙ্গনের এখন সবচেয়ে কাছের বন্ধু এবং সহযোগী হলো বাণিজ্যিক স্পন্সরশিপ।
বিশ্বের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেশে দেশে ক্রীড়াঙ্গনকে সচল রাখা এবং খেলার মানোন্নয়নে বাণিজ্যিক পৃষ্ঠপোষকতার কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে ‘স্পোর্টস অ্যান্ড গেমসে’ মানের ক্ষেত্রে ম্যানপাওয়ার বড় কথা নয়। একান্ত প্রয়োজনীয় হলো স্পন্সরশিপ। খেলাধুলা পরিচালনার সব দায়দায়িত্ব নিজ নিজ দেশের সরকারের এই প্রেক্ষাপট বদলে গেছে।
খেলার চত্বরে পৃষ্ঠপোষকতার ঐতিহ্যের শুরু প্রাচীন গ্রিসে। তখন বিত্তবান অ্যাথেলিয়ানরা খেলাধুলা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন। অর্থাৎ স্পন্সর করতেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল সংস্কৃতি এবং খেলাধুলার সুবিধা, যাতে সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে থাকেন। বিনিময়ে রাষ্ট্র তাঁদের নাম শ্বেত পাথরে খোদাই করে দিত। এটা ছিল স্পন্সরদের প্রতি দেশের সম্মান ও স্বীকৃতি জানানোর উপায়।
আমাদের বাংলায় কয়েক যুগ ধরে রাজা, জমিদার, ধনবান ব্যক্তিরা খেলাধুলায় পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সময়ের পাশাপাশি ভৌগোলিক সীমারেখা পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি পর্যায়ে ক্রীড়া পৃষ্ঠপোষকতা এখন একেবারে কমে গেছে। এই স্থান পূরণ করেছে ধীরে ধীরে সিএসআর কর্মসূচির আওতায় করপোরেট হাউস এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। নতুনতর বাস্তবতায় পুরো বিষয়টি বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছে। তারা বুঝতে পেরেছে ক্রীড়াঙ্গনের মাধ্যমে উদ্দেশ্য সাধন যত সহজে সম্ভব, অন্য কোনো মাধ্যমে তা সম্ভব নয়।
ক্রীড়াঙ্গনে ট্রেন্ড নিয়ে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ করেছি করপোরেট সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী পেশাদারি মোড়কে মোড়ানো দেশের অন্যতম একটি বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপ নির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে সময়কে সঠিকভাবে পড়ে দেশের ক্রীড়াঙ্গন, বিশেষ করে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলকে জাগিয়ে তোলা ও টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে যে বিনিয়োগ করেছে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫১ বছরের ইতিহাসে এই নজির আর নেই। বসুন্ধরা পেরেছে ক্রীড়াঙ্গনে তার কার্যকর ভূমিকার মাধ্যমে দেশের ক্রীড়ামোদী মহলে দাগ কাটতে এবং আস্থা অর্জন করতে। পেরেছে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করতে। সম্ভব হয়েছে দেশ ও বিদেশে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্রীড়াঙ্গনের মাধ্যমে আরেক ধাপ উজ্জ্বল করা।
বসুন্ধরা গ্রুপ এরই মধ্যে প্রমাণ করেছে সময়ের প্রয়োজনে তারা ক্রীড়াঙ্গনে এসেছে। গ্রুপের ক্লাব ‘বসুন্ধরা কিংস’কে সেরা ব্র্যান্ড হিসেবে টার্গেট গ্রুপের কাছে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য করপোরেট ‘প্ল্যান’ অনুযায়ী গ্রুপ এবং ক্লাব ম্যানেজমেন্ট কাজ করছে। আপাতত দেশ এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে অনুকরণীয় এক নম্বর ব্র্যান্ড হিসেবে বসুন্ধরা কিংসকে প্রতিষ্ঠিত করাটাই গ্রুপ এবং ক্লাব ম্যানেজমেন্টের লক্ষ্য। প্রিমিয়ার লিগে খেলতে নেমে একনাগাড়ে তিনবার শিরোপা জিতেছে ক্লাব। দেশের ফুটবলে অতীতে কোনো করপোরেট দলের ক্লাবের এই ধরনের সাফল্যের নজির নেই। ২০১৮ সালে বড় মাঠে নেমে লিগ শিরোপা ছাড়াও অন্যান্য টুর্নামেন্টেও শিরোপা নিশ্চিত করেছে ক্লাব। পাশাপাশি নারী ফুটবল দল গঠন করার পর দুবার লিগে অংশ নিয়ে দুবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এএফসির আঞ্চলিক ফুটবলে এখন পর্যন্ত শিরোপা জয়ের স্বাদ না পেলেও সম্ভাবনার আলো ছড়াতে সক্ষম হয়েছে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে গ্রুপের ক্লাব কিংস ফুটবল মাঠে সার্বিক পরিবর্তন সাধনের পাশাপাশি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা ও চেতনার জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে।
দেশে প্রথম পূর্ণাঙ্গ পেশাদার ক্লাব বসুন্ধরা কিংস। এই ক্লাব প্রথম থেকেই নতুন সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করছে। ইউরোপের ক্লাবগুলোর মতো সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বসুন্ধরা কিংসের আছে। ক্লাবের নিজস্ব অ্যারেনা আছে। নিজ মাঠে তারা প্রিমিয়ার ফুটবল খেলে। আছে অনুশীলনের জন্য ভালো মাঠ, পুনর্বাসন ব্যবস্থা, ভালো কোচিং স্টাফ এবং আবাসন। এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে এবং হচ্ছে, তার প্রধান কারণ গ্রুপের চেয়ারম্যান ক্রীড়া অন্তপ্রাণ, সাবেক হকি খেলোয়াড় আহমেদ আকবর সোবহান। তাঁর ক্রীড়ানুরাগী সন্তানরা গ্রুপে কর্ণধারের দায়িত্ব পালন করছেন। খেলাধুলার প্রতি তাঁদের প্রচণ্ড আগ্রহ এবং ভালোবাসার পরিপ্রেক্ষিতে। বৃহৎ বাণিজ্যিক গ্রুপের সামাজিক দায়বদ্ধতা ছাড়া এই পরিবারের সব সদস্য বিশ্বাস করেন খেলার চর্চা সুস্থ জীবনবোধের সন্ধান দেয়। খেলাধুলা জাতির প্রাণ ও সভ্যতার প্রতীক। দেশের তরুণ ও যুবসমাজ মানসিক ও শারীরিক পূর্ণতা পেলেই তো তারা রাষ্ট্র, সমাজকে পুরোপুরি মদদ দিতে পারবে। তাঁরা আরো বিশ্বাস করেন, তরুণদের জন্য খেলাধুলার বিকল্প নেই।
বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের ক্রীড়াঙ্গন ঘিরে একটি পারিবারিক সুবর্ণময় অতীত আছে। আগেই উল্লেখ করেছি, তিনি নিয়মিতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হকি খেলেছেন। তাঁর ভাই আবদুস সাদেক ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হকি খেলোয়াড়। পাকিস্তান জাতীয় হকি দলের স্কোয়াডে তাঁর স্থান হয়েছে। তাঁদের বাবা বিখ্যাত আইনজীবী, সমাজসেবক আলহাজ আব্দুস সোবহান তাঁর যৌবনে অল ইন্ডিয়া সাঁতার কম্পিটিশনে অংশ নিয়েছেন।
বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি দেশের খেলাধুলার অগ্রগতিতেও ভূমিকা রেখে চলেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। সোবহান পরিবারের বিভিন্ন সদস্য দেশের বিভিন্ন ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বসুন্ধরা গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সায়েম সোবহান আনভীর ২০১৫ সাল থেকে শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। আর্তমানবতার সেবা, শিল্প-বাণিজ্য ও ক্রীড়ায় বিশেষ অবদানের জন্য টেলিভিশন রিপোর্টার্স ইউনিটি অব বাংলাদেশ (ট্রাব) অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
আহমেদ আকবর সোবহানের আরেক পুত্র সাফওয়ান সোবহান সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাবের। স্বাভাবিকভাবে এই দুই ক্লাবে বসুন্ধরা গ্রুপের বড় পৃষ্ঠপোষকতা আছে।
ফুটবলসহ বসুন্ধরা গ্রুপ ক্রিকেট, হকি, ব্যাডমিন্টন, গলফ ছাড়াও ক্রীড়াঙ্গনে আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছে। দেশের একমাত্র স্পোর্টস চ্যানেল ‘টি স্পোর্টস’ও বসুন্ধরা গ্রুপের। ক্রীড়াঙ্গন এবং খেলাধুলাকে দেশে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ‘সার্ভ’ করার লক্ষ্য নিয়েই এই চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
দেশে বসুন্ধরা গ্রুপই প্রথম, যারা তাদের ক্লাবের জন্য স্টেডিয়াম নির্মাণ করেছে। শুধু দেশে নয়, উপমহাদেশে আর কোথাও কোনো ফুটবল ক্লাবের এত বড় আধুনিক নিজস্ব স্পোর্টস কমপ্লেক্স নেই। আধুনিক ফুটবল স্টেডিয়ামসহ আধুনিক স্পোর্টস কমপ্লেক্স দেশের জন্য গর্বের বিষয়। এ ক্ষেত্রে গ্রুপের বিনিয়োগ ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত হচ্ছে স্পোর্টস কমপ্লেক্স। আশা করা যাচ্ছে, এই কমপ্লেক্সের কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালের মধ্যে। এই কমপ্লেক্সে থাকছে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, টেনিস, গলফ, আর্চারিসহ বিভিন্ন ইনডোর ও আউটডোর গেমসের স্টেডিয়াম, অনুশীলন মাঠ, জিমনেসটিকসসহ সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধা।
ক্রীড়াঙ্গন এবং খেলার চর্চাকে ভালোবাসার পরিপ্রেক্ষিতে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান যেভাবে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে অবদান রেখে চলেছেন কোনো কিছু পাওয়ার চিন্তা না করে এটি অনন্য একটি নজির।
২০১৭ সাল থেকে বসুন্ধরা কিংস ফুটবল ক্লাবের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং সুচারুভাবে পালন করছেন মো. ইমরুল হাসান। এই স্বাপ্নিক ব্যক্তিত্ব তাঁর কাজে পুরো সময় দেওয়ার পাশাপাশি যেভাবে ক্লাবকে স্বপ্নের বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সবাইকে নিয়ে কাজ করছেন এটি উল্লেখ করার মতো। মো. ইমরুল হাসান বাফুফের গত নির্বাচনে সর্বাধিক ভোটে সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। কিছুদিন আগে এক বিকেলে তাঁর অফিসে বসে বললেন, ‘আমাদের ক্লাবের সবচেয়ে বড় শক্তি, সাহস এবং অনুপ্রেরণা হলেন গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং তাঁর সুযোগ্য খেলাপ্রেমিক সন্তানরা। চেয়ারম্যান সাহেব শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও কখনো খেলা দেখা থেকে বিরত থাকেন না। তিনি ফুটবল ছাড়া অন্য খেলাও দেখেন। ক্লাবের ফুটবল থাকলে খেলার পরপরই যে টেলিফোনটি রিসিভ করি সেটি চেয়ারম্যান সাহেবের কাছ থেকে। ’
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক, সাবেক সহসভাপতি, এআইপিএস