ঠিক করেছিলাম লিখবো না এই বিষয়ে। কারণ কেউ যদি মনে করেন বসেন তাকে ছোট করছি, জাত ভাইবোনদের ছোট করছি।
যা বলছিলাম, বিভিন্ন কারণে ফেসবুক মেইলবক্স ও আমার জি-মেইল অ্যাকাউন্ট চেক করা হইনি দুই আড়াই মাস। দুই ইনবক্সে মেইল জমে গেছে প্রায় তিনশোর কাছাকাছি, যদিও আমি নিয়মিত মেইল দেখি। গত আড়াই মাসের জমে থাকা মেইল দেখতে বসেছিলাম, সাজিয়ে নিলাম, মানে খুব ঘনিষ্ঠ জনদের সবার আগে, এখানকার মিডিয়ার মেইল যাদের সাথে কাজ করি, এরপর অল্প ঘনিষ্ঠদের, তারপর চেনাজানাদের, দরকারি অদরকারি ও অচেনাদের। কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মুরুব্বী-সাংবাদিকদের মেইল পেয়ে মনটা ভালো হয়ে গেলো; সেই সাথে কিছু অচেনাদের মেইল পেয়েও। আবার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মুরুব্বী সাংবাদিকদের মেইল পেয়ে মনটা চরম খারাপ হয়ে গেল। মন ভালো হয়েছিলো যে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের পলিসির কারণে সাগর-রুনি কে নিয়ে লিখতে পারছেন না; কিন্তু ওদের প্রতি ন্যায়বিচার যেন হয় সেজন্য মানসিকভাবেব্যাকুল। তাদের মনের কথা, আমার লেখার মাঝে খুঁজে পাচ্ছেন।
যাদের মেইল মন খারাপ করে দিয়েছিলো তারাও আমার ভালো চান, শুভাকাঙ্ক্ষী। ওদের কথা, এসব লিখে কোনো লাভ নাই, আজাইরা প্যাঁচাল। কারণ কিছুই হবে না মাঝখান থেকে আমি সবার কাছে চোখের বালি হয়ে যাব। আর রাষ্ট্রচালকরা যখন উদাসীন, তখন তুই কেরে গোধুলি? আমি ওদের ইমেইল পেয়ে ফোন করি, বলি এতদিন পরে নেতারা এক হয়েছেন, নিশ্চয় ভালো কিছু একটা হবে। আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের একজন বললেন, পিছন ফিরে দেখো, সাংবাদিকদের সব আন্দোলনের ফল কী হয়েছে মনে করো। আরও দুই তিন জনের সাথে কথা বললাম---- ঘুরে ফিরে সেই একই কথা। আমি দমে না গেলেও মনটা খারাপ হয়ে গেল খুব। যাদের আলোড়ন জাগানো লেখা এ পেশায় আসতে আগ্রহী করেছিলো তারা আজ কোন দিকে চলেছেন আমাদের নিয়ে, যাদের আদর্শ বলে মেনেছিলাম তারা কোন পথ দেখাচ্ছেন আমাদের, উনারা কি আর আমাদের মত আম-সাংবাদিকদের চান না তাদের পিছে, নাকি চান না আমরা তাদের আমাদের নেতা বলে মনে করি। রাষ্ট্রনায়ক বা নায়িকারা যেমন আম জনতার কথা ভাবে না, সাংবাদিক নেতারাও আমাদের মত আম-সাংবাদিকদের কথা ভাবেন না। হাজার বছরের পুরানো কথা আর মিথ্যে হল না, ‘যে যায় লংকায়...!!’
যাহোক, মন-খারাপ নিয়ে আবার মেইল চেক করতে বসলাম, অনেক অচেনা মানুষের কাছ থেকে মেইল এসেছে, লেখার জন্য সাধুবাদ জানিয়েছেন, তাদের কেউ কেউ ফেসবুক বন্ধুও হয়েছেন। অচেনা কয়েকজনের কয়েকটি মেইল পড়ে হাসবো না কাঁদবো বুঝে পাচ্ছিলাম না। পড়ে হাসলাম কারণ কান্না না, হাসিই এলো। ঐ মেইলগুলো আমাকে ভদ্র ও অভদ্র ভাষায় হুমকি দিয়ে লেখা, যার সারমর্ম হল, আমাকে হাতের কাছে না পেলে আমার নিকটজন যারা ঢাকায় থাকেন, যে কোনো অজুহাতে থানায় নিয়ে সাইজ করা হবে, আদালত আবমাননায় ফাঁসিয়ে দেবে আমাকে। আমার ঢাকার ফেরার অপেক্ষায় তারা, ফিরলে কত ধানে কত চাল বুঝিয়ে দেবে, আমার ও আমার নিকটজনের মঙ্গল হবে সরকার কে নিয়ে না লিখলে। তাতে বিরাট আমোদ পেলাম!
এখানে কাজের সুবাদে এফবিআইয়ের কয়েক জন জুয়েলের ভালো বন্ধু, আমারও বন্ধু, ওদের ঐ অচেনা ইমেইল আইডিগুলো দিয়েছিলাম ওদের ও ঢাকার কিছু বন্ধুর সহযোগিতায় দেখা গেছে সব ফেক আইডি , ঢাকা, সাভার ও মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন সাইবার ক্যাফে থেকে পাঠানো।
যাহোক, আমাদের নেতারা সাগর-রুনিসহ সব সাংবাদিকের হত্যার বিচার চেয়ে যে ধারালো ও জোরালো বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাতে আশা জেগেছিলো মনে। কিন্তু মনটা শঙ্কিত হল, যখন দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর ``বেডরুম বচন``র পর দল ধরে সময় কাটাতে গেলেন আমাদের নেতারা ও সম্পাদক-মালিকরা। যাই হোক মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম উনাদের ক্ষুরধার বক্তৃতা শুনে, সেই সময় নেতাদের ঠিক বেকারি থেকে মাত্র বের হওয়া গরম মচমচে টোস্ট বিস্কুটের মতো ফ্রেস লেগেছিলো; অথচ গতকাল শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চায়ে ডুবে তারাই যে নেতানো বিস্কুট হয়ে যাবেন দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি!
কেন উনারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গেলেন বা কি দেখে সাহারা খাতুনের উপর ভরসা করলেন জানার কোনো আগ্রহ পাচ্ছি না। উনাদের হাসি-হাসি মুখ দেখে সাগর-রুনি সহ নিহত সব সাংবাদিকদের জন্য, নিজের জন্য, সব আম-সাংবাদিকদের জন্য করুণা হচ্ছে। করুণা হচ্ছে মিনার মাহমুদের জন্য যার সাথে ২০০৭ সালে মাত্র এক ঘণ্টা কথা হয়েছিল। ``বিচিন্তা`` আমি পড়েছিলাম স্কুলে আমার বড় ভাইয়ের সংগ্রহ থেকে, মিনার ভাই সম্পর্কে জানা আরও পরে, এই পেশায় এসে।
সে-ই প্রথম ও শেষ দেখা নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটে। এক ঘণ্টা ছিলাম নিউ ইয়র্কে স্থায়ীভাবে বসবাসরত আরো কিছু সাংবাদিকদের সাথে। মিনার ভায়ের কথায় মুক্তো ঝরেছিল। অমূল্য সব কথা। যার কথায় এতো দ্যুতি, সে কি আত্মহত্যা করতে পারে? যে মানুষ নতুন করে সবকিছু শুরু করার কথা বলেন তিনি কী করে আত্মহত্যা করেন? নাকি তাকে বাধ্য করা হল আত্মহত্যা করতে? তাহলে সে-ও তো হত্যায় সামিল। সাগর-রুনির হত্যাকারীদের আমরা না চিনলেও, মিনার মাহমুদের হত্যাকারীদের আমরা চিনি। তাকে হত্যা করেছে আমাদের ``সুধী ও গুণী`` সাংবাদিকরা। যাদের ১০ বছর আগে ছিল না বেবি ট্যাক্সি চড়ার পয়সা, আজ তারা ৪০/৫০ লাখ টাকার গাড়িতে চড়েন। এক দেড় কোটি টাকায় ভিআইপি এলাকায় ফ্ল্যাট কেনেন। মিনার ভাইকে একটু জায়গা ছেড়ে দেননি কেউ। উনার মৃত্যর পর শোক দেখি উথলে উঠছে সবার, কত ধরনের লেখা। কত আবেগ, ভালবাসা, কত উপাধি!
এখানে আসার পর মাঝে মাঝে কষ্ট পেতাম, ১১ বছর ধরে যেখানে কাজ করেছি, যাদের সাথে কাজ করেছি, একসাথে উঠেছি-চলেছি-খেয়েছি সব মিস করতাম। আজ মনে হয়, না অনেক ভালো করেছি। ওই মুখগুলো আজ আরও বেশি কষ্ট দিতো যদি দেশে থাকতাম। লিখতে লিখতে মনে হল সাগর-রুনি, বালুভাই, গৌতমদা, শামসুর রহমান, মানিকদাসহ সকল সাংবাদিক যারা হত্যার শিকার হয়েছেন; তাদের পরিবার পরিজন আমাদের সাংবাদিকদের আজ কি চোখে দেখছেন? নেতাগণ, উনারা কি আপনাদের শ্রদ্ধার করবেন? এমনকি নিজ পরিবারের সদস্যদের কাছে সম্মান পাবেন? উপহাসের পাত্র হবেন না কি? সাধারণ জনগণ আর বিশ্বাস করবে আপনাদের? ওদের সবার চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারবেন তো? কিম্বা আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্বের চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারবেন তো ? জানি না, এর উত্তর আপনারা দেবেন কিনা।
আফিফা নামে আমার এক ফেসবুক বন্ধু সাংবাদিক নেতাদের সাহারা খাতুনের বাসায় চা-চক্র যাওয়াকে মেনে নিতে না পেরে স্ট্যাটাস লিখেছে, ``ভাগ্যিস আমাদের সাংবাদিকনেতারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় নেতা ছিলেন না, উনারা ওই সময় নেতা থাকলে আমাদের শত্রুরা উনাদের চা খাইয়ে যুদ্ধ জিতে নিত। ``
সাংবাদিক শব্দটা কিন্তু আমজনতার এখনই খুব একটা ভাল শব্দ নয়, সেটা আমাদের মনে রাখতে হবে।
ফারজানা খান গোধুলি, ওয়াশিংটন প্রবাসী সাংবাদিক।
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।