আজ ঐতিহাসিক ১০ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এ দিনে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার সার্কিট হাউসে সত্তুরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচিত এমপিএ, এমএনএ’দের বৈঠকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত হয়।
এই সরকার গঠনের পেছনে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি পরামর্শও কাজ করে। প্রবাসী নেতাদের মধ্যে প্রথম তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমির উল ইসলামের সঙ্গে নয়াদিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম বৈঠকটি হয়। সে বৈঠকে প্রবাসী বাংলাদেশি নেতাদের একটি সরকার গঠনের পরামর্শ দেন ইন্দিরা। মূলত সেই সরকার গঠনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাজনৈতিক-প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি সংঘবদ্ধতা পায়। সৃষ্টি হয় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্বের। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত সরকার শুধু এই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গেই যোগাযোগ রক্ষা ও অফিসিয়াল আলাপ-আলোচনা করেছে। অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে নয়।
তখনও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল ভারত সরকার। পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানিদের গণহত্যা শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে বানের মতো মানুষজন ভারত সীমান্তের দিকে যাচ্ছিল। প্রথম দিকে ভারত সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায় এসব শরণার্থী মানুষজনকে সীমান্তে বাধাও দিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। কিন্তু মানুষের জনস্রোতে সে বাধা টেকেনি। প্রতিদিন জনস্রোতের মতো হাজার হাজার মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ছিলো। শেষ পর্যন্ত প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় পায়। পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা-আসাম-মেঘালয় সব সীমান্ত দিয়েই ভারতে ঢুকছিলো মানুষ। প্রথমদিকে এদের বেশিরভাগ সীমান্ত এলাকার অনেক স্কুল-কলেজে আশ্রয় নেয়। সে কারণে প্রায় সব ভারতীয় সীমান্ত এলাকার স্কুল-কলেজ সব এসব শরণার্থী মানুষজনের ভিড়ে বন্ধ হয়ে যায়। তখনও স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উদ্যোগে এসব শরণার্থী মানুষজনের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ভারত সরকার জড়ায় পরে। তবে হঠাৎ করে এই বিশাল সংখ্যক শরণার্থীর খাবার-আশ্রয়সহ অন্য সবকিছুর ব্যবস্থা করতে গিয়ে ভারত সরকার অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যেও পড়ে। সে দেশের জনগণ থেকে নেওয়া হয় বিশেষ শরণার্থী ট্যাক্স। ইন্দিরা গান্ধী এভাবে নানা কায়দায় তৎকালীন শরণার্থী পরিস্থিতি সামাল দেন। শরণার্থী অনেকে ভারতে ঢুকে যার যার আত্মীয়বাড়িও চলে যায়। ত্রিপুরায় একাত্তরে জনসংখ্যা ছিল ১৪ লাখ। ১৬ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নেয় ছোট সে রাজ্যে। এর জন্যে বলা হয় ত্রিপুরার শুধু শরণার্থী শিবির নয়, সেখানে শরণার্থীবিহীন এমন একটি বাড়িও ছিলো না।
বাংলাদেশ ইস্যুতে সিদ্ধান্তহীনতার কারণে শুরুতে কলকাতা-আগরতলাসহ ভারতীয় শহরগুলোতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশের নেতাদের বিষয়েও গোপনীয়তা বজায় রাখছিল ভারত সরকার। কারণ পাকিস্তানিরা প্রচার চালাচ্ছিল ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ আর পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করছে। পাকিস্তানের পক্ষে শক্ত অবস্থান ছিল আমেরিকা-চীন, সৌদি আরবসহ অনেক দেশের। ভারতীয়রা শুধু বলছিল তারা তাদের দেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের মানবিক কারণে সাহায্য দিচ্ছে। শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী তাজউদ্দিন কলকাতা পৌঁছেছেন খবর পেয়ে তাকে ইন্দিরার সঙ্গে দেখা করানোর জন্য দিল্লি নিয়ে যাবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস, বামফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ, সাহিত্যিক মহেশ্বেতা দেবীসহ আরও অনেকে নেপথ্যে এই উদ্যোগের পেছনে ছিলেন। সাধারণ যাত্রাবাহী বিমানে তাজউদ্দিনদের দিল্লি যাওয়া আসা করতে গেলে মিডিয়ায় জানাজানি হয়ে যেতে পারে এমন আশংকায় তাদের ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি মালবাহী বিমানে করে নেওয়া হয়। তাজউদ্দিন তার বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার আমির উল ইসলামকে সঙ্গে নেন। সেই বৈঠকে তাজউদ্দিনরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি বর্ণনা করে মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সহায়তা চান। ইন্দিরা তখন বাংলাদেশ সরকারের একটি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়ে বলেন, এতে করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের অফিসিয়াল নেতৃত্বেই পরিচালিত হবে। ভারত প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সহায়তা দেবে। ইন্দিরা-তাজউদ্দিন বৈঠকের বিস্তারিত আমাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন সেই বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশি দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম।
তখন সরকার গঠনের বৈঠকের জন্য আগরতলা শহরকে বেছে নেবার কারণ তৎকালীন এমএনএ, এমপিএসহ রাজনৈতিক-ছাত্র নেতৃবৃন্দ, সামরিক অফিসার ও জওয়ানদের বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই সীমান্তশহরে। জেলারেল ওসমানী, মেজর জিয়া, খালেদ মোশাররফসহ অনেকে সেখানে আগে থেকে জড়ো হন। আগরতলা সার্কিট হাউসে কড়া নিরাপত্তার ভিতর অনুষ্ঠিত এমএনএ, এমপিএ’দের বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃ্ত্বে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত হয় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবেন জেনারেল ওসমানী। তবে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে মন্ত্রিপরিষদ গঠন সহ এসব খুঁটিনাটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য তাজউদ্দিনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সেখানে তৈরি করা হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের একটি ঘোষণার খসড়া। সেই ঘোষণাটি সাংবাদিকদের মাধ্যমে ঘোষণার দায়িত্ব পান অধ্যাপক ইউসুফ আলী, মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ।
পিটিআই’র আগরতলা প্রতিনিধি ছিলেন সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য। প্রবাসী নেতৃবৃন্দকে শুরু থেকে নানাভাবে সহায়তা ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঐতিহাসিক ঘোষণাটি সর্ব ভারতীয় মিডিয়া ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে তখন এই অনিল ভট্টাচার্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের গোটা ৯ মাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর নিতে সারা দুনিয়া থেকে যত সাংবাদিক ভারত আসেন, তারা আগরতলা এসে বা আসার আগে অনিল ভট্টাচার্য খোঁজেন। বাংলাদেশ-যুদ্ধকে নানাভাবে সহায়তাকারী একাত্তরের নিবেদিতপ্রাণ এই অনিল ভট্টাচার্যকে কিন্তু বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের সম্মানিত করার সময় মনে রাখে নি! আগরতলায় সিদ্ধান্ত নেয়া ও ঘোষিত সরকারটিই কিন্তু সে বছরের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শপথ নেয়। সে কাননের নাম হয় মুজিবনগর। সরকারের নাম হয়ে যায় মুজিবনগর সরকার। এর মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয় নতুন একটি রাষ্ট্রের। বাংলাদেশ তার নাম।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১১৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১২
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।