আসছে শনিবার পহেলা বৈশাখ। বর্ষ পরিক্রমায় নতুন বছর ১৪১৯ সালকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে।
বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর এ লেখার সাথে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন। আর সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। পহেলা বৈশাখে দিনভর আনন্দ উল্লাসের পাশাপাশি রাজধানী এমন কি প্রতিটি শহরেই একটি দিনের জন্য ফিরে আসে গ্রামীণ সেই আমেজ। গ্রামে নাগরদোলায় চড়ার আনন্দ যত সহজে পাওয়া যায় শহরে তা কল্পনাই করা যায় না।
যে কারণে লেখা সেটি হচ্ছে পান্তা-ইলিশ। পহেলা বৈশাখের সকালে পান্তা-ইলিশ যেন বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। মাটির সানকিতে পান্তাভাত ও ইলিশের এক টুকরো ভাজি না হলে যেন আর চলে না। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে মাত্র একটি দিনে বাঙ্গালি হওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টায় কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় সেদিকে কারো নজর আছে বলে মনে হয় না।
মধ্য চৈত্র থেকে ইলিশের দাম প্রতিদিন হাই জাম্প দিয়ে বেড়েই চলেছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিটি ৫০০ গ্রাম ইলিশের দাম সর্বোচ্চ ২০০ টাকা হতে পারে। বর্ষবরণের ডামাডোলে এখন দাম গিয়ে ঠেকেছে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায়। আর নিউ মার্কেটের কাঁচাবাজারে দেড় কেজি ওজনের এক জোড়া ইলিশের দাম হাঁকা হয়েছে সাত হাজার টাকা।
রাজধানীর কাওরানবাজার, বাড্ডার মেরুল, যাত্রাবাড়ী ও পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাট মাছের আড়তে এখন ইলিশ আর ইলিশ। খোঁজ নিয়ে গিয়ে জানা গেল বাজারে ইলিশের এতো ছড়াছড়ি হলে সেটি কিন্তু এবারকার মেঘনা, পদ্মা ও কর্ণফুলীর মোহনা থেকে ধরা ইলিশ নয়। গত বছর যখন দাম কম ছিলো তখন পহেলা বৈশাখকে টার্গেট ধরে কোল্ড স্টোরেজে ইলিশ সংরক্ষণ করা হয়েছিলো। যে ইলিশ ২০০ টাকায় কিনে কোল্ড স্টোরেজে রাখা হয়েছে সেটি এবার সর্বনিম্ন দুই হাজার থেকে সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। পহেলা বৈশাখের কারণে এবার মেঘনা ও পদ্মা থেকে জাটকাও ধরা হচ্ছে বলে আড়তদাররা জানিয়েছেন।
মাছের আড়ত ও কাঁচাবাজারের বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে যে চিত্র পাওয়া গেছে তা হলো পহেলা বৈশাখের পরই কোল্ড স্টোরেজের ইলিশের দাম পড়ে যাবে। ভাবা যায় মাত্র একটি দিনের জন্য ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া। আমি ব্যক্তিগত কৌতূহল থেকে গত সপ্তাহে পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ উৎসব নিয়ে নানা পেশার লোকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের কথার সারমর্ম হচ্ছে, বাংলা বছরকে স্বাগত জানাতে পহেলা বৈশাখে দিনভর উৎসবে মেতে থাকার মধ্যেই আনন্দ। তবে পান্তা-ইলিশ নিয়ে বাড়াবাড়িতে অনেকেরই আপত্তি।
ইংরেজি দৈনিক দি ইন্ডিপেনডেন্ট-এর বিশেষ প্রতিনিধি নজরুল ইসলামের মতে, পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বাঙ্গালির ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু সাত সকালে উন্মুক্ত জায়গায় পান্তা ভাত ও একট টুকরো ইলিশ ভাজি মাটির সানকিতে নিয়ে খেতেই হবে আর তা না হলে নিজেকে বঙ্গালি মনে হবে না-- এমন ধারণার সাথে তিনি একমত নন। যারা বছরের প্রথম দিনটিতে এমন করেন তারা বাকি ৩৬৪ দিন বাঙ্গালির কৃষ্টির মধ্যে থাকেন কিনা সন্দেহ। পুরো বছর বাঙ্গালি থাকলে অসুবিধা কোথায়?
আরেকটি ইংরেজি দৈনিক দি সান-এর বিশেষ প্রতিনিধি কামরান রেজা চৌধুরী বলেন, হাজার হাজার টাকা খরচ করে এক বেলা একটি ইলিশ মাছ খেতে হবে চিন্তা করা যায়? পহেলা বৈশাখের পরদিনই যে সে টাকায় একাধিক ইলিশ মাছ বাজারে পাওয়া যাবে তা কেউই ভাবেন না।
একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল বললেন, একদিনের জন্য বাঙ্গালি হওয়ার ইচ্ছা নেই বলে ইলিশের দিকে হাত বাড়াই নি। আমি বছরব্যাপী নয়, যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন বাঙ্গালি হয়েই থাকতে চাই।
পশ্চিম রামপুরার উলন কাঁচাবাজারে গৃহবধূ শামীমা খানমকে পহেলা বৈশাখের পান্তা-ইলিশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই তিনি মন্তব্য করলেন, পান্তা ও ইলিশের পিছনে যে টাকা খরচ করা হয় তা দিয়ে শুধু রাজধানীতে অনেক অসহায় শিশু ও নারী-পুরুষের মুখে কিছু তুলে দেওয়া যেত। এদিকে দৃষ্টি না দিয়ে একদিনের জন্য বাঙ্গালি হওয়ার পিছনে যারা কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন তাদের সম্পর্কে কী আর বলা যায়।
মাত্র একটি দিনের তরে বঙ্গালি হওয়ার দৌড়ঝাঁপ থেমে যাবে এমন আশা কেউই করেন না। উৎসব আর আনন্দকে সেভাবেই দেখা উচিত। তবে প্রায় সবার আপত্তি একটি বিষয়ে। আর সেটি হচ্ছে বাতাসে টাকা উড়িয়ে পান্তা-ইলিশের উৎসব যেন বন্ধ হয়। লেখা শেষ করতে হচ্ছে কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিতের সেই গানের একটি লাইন দিয়ে ...মনে পইড়া যায় একদিন বাঙ্গালি ছিলাম রে...।
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক ইত্তেফাক।
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।