‘উঁচু নিচু পাহাড়ি লাল মাটি। কোথাও টিলার মত আবার কোথাও সমতল ভূমি।
দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকার অদুরে সাভারে ১৯৭১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পথচলা শুরু। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মোট ৭৪৮.১৪ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৮০ সালে বিপিএটিসিকে ৫০ একর জমি ছেড়ে দেওয়ায় বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট জমির পরিমাণ ৬৯৭.৫৬ একর। ’
উপরের কথাগুলোকে মনের মতো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে এক সময় সংবাদ ও ফিচারের ইন্ট্রো করতেন সাংবাদিক ও ফিচার লেখকরা। ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতা করার সুবাদে আমিও কিছুদিন এইভাবেই চালিয়েছি। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় চির সবুজের ক্যাম্পাস হিসেবে খ্যাত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর আগেও ছিল অসংখ্য প্রজাতির বৃক্ষ, আর ছোটখাটো বণ্যপ্রানীর অভয়ারণ্য ছিল এই ক্যাম্পাসটি।
রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় চোখে পড়ত বড় বড় গুইসাপ, বেজি, গিরগিটি, কাঠ-বিড়ালি, রাতের বেলায় শিয়াল, বাগডাশা, হুতুম-লক্ষ্মিপেচাঁসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। আর প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো পূর্ণ ছিল ছোট বড় নানা ধরনের দেশি প্রজাতির মাছ দিয়ে। শোল, বোয়াল, শিং, টেংরা, পুঁটি, টাকি, চ্যাং, পাবদা, বাইন, পাকাল আরো নাম না জানা কতো মাছ। শীতকালে অতিথি পাথীদের কলতান ক্যাস্পাসে প্রাণের উচ্ছ্বাস বাড়িয়ে তুলতো। একসময় ক্যাম্পাসবাসী জলাশয়গুলোকে অতিথি পাখীদের জন্য অভয়াশ্রম ঘোষণা করে।
এই ক্যাম্পাসে সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারীর সঙ্গে এসব বণ্যপ্রাণীর ছিল অন্তরের সম্পর্ক। কেউ কখনো প্রাণীগুলোকে হত্যা করতো না, বিরক্তও করত না। একদিন রিক্সা নিয়ে যাওয়ার পথে দেখলাম একটি গর্ভবতী গুইসাপ রাস্তার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাচ্ছে। আমি রিক্সাওয়ালা মামাকে থামার কথা বলার আগেই তিনি রিক্সা থামিয়ে গুইসাপটিকে যাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। বণ্যপ্রাণীর সঙ্গে ক্যাম্পাসবাসী ও আশপাশের লোকজনের এই সম্পর্ক অবলোকন করে মুগ্ধ হয়েছিলাম সেদিন। ক্যাম্পাসের রিক্সাওয়ালাটাও বুঝে- এই প্রাণীগুলো আমাদের পরিবেশের অমূল্য সম্পদ। যা আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে বিচরণ করে না। এই প্রাণীগুলো ক্যাম্পাস থেকে চলে গেলে আর এগুলোকে ফিরে পাওয়া যাবে না।
কিন্তু বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গাছ-গাছালিসহ ঝোপ-ঝাড় কেটে ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করার কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে রিক্সাওয়ালার কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনেক কিছু শেখার আছে। ২০১০ সালে থেকে এই প্রশাসন ক্যাম্পাসের বন-জঙ্গল উজাড় করার এই অদ্ভূত আর অচিন্ত্যনীয় কার্যক্রম শুরু করে। সেসময় দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি উঠে আসলেও প্রশাসন তাদের কার্যক্রম থেকে একটুও সরে আসে নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক থেকে ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার পর্যন্ত সারি সারি গাছ কেটে সেখানে ফুলের গাছ রোপন করেছে। সেসময় ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক থেকে ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার দেখার বাধা দূর করার অজুহাতে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়।
আমি জানি না ঢাকা আরিচা মহাসড়ক দিয়ে যাওয়ার পথে এখন কেউ শহীদ মিনার দেখতে পান কি না?
সবচেয়ে মজার কথা হলো, গাছগুলো কাটার সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছিল- এই রাস্তাটি যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রবেশ পথ তাই একে ব্যতিক্রমী সৌন্দর্যে সাজানো হবে। গাল ফুলানো ওইসব বুলির মধ্যে আরও ছিল- চারপাশে রঙিন আলো আর মাঝখানে বিভিন্ন ফুলগাছের সারি, হেঁটে গেলে মনে হবে বিদেশি কোনো জায়গায় এসেছি- এমন করে সাজানো হবে এ পথকে।
কিন্তু এখন যে কোনো দুপুরে সেখান দিয়ে হেঁটে গেলে তপ্ত শরীরের সব পথিকেরই মনে হবে- সেসময় প্রশাসন গাছ কাটার জন্য মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো।
সেসময় শিক্ষক-শিক্ষর্থীরা গাছ কাটার প্রতিবাদ করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সিদ্ধি সাধনে ঈদের ছুটিকে কাজে লাগান। ঈদের ছুটিতে সব শিক্ষার্থী বাড়ি চলে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তখন রাস্তার দুপাশে দাঁড়ানো সারি সারি গাছগুলো কেটে সাফ করে ফেলে।
গাছ কেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করেছে, ঠিক বিভিন্ন ঝোপ-ঝাড় নির্মূলের মাধ্যমে ধ্বংস করেছে ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্য। শুধু তাই নয়, শুষ্ক মৌসুমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কারের কায়দা হিসেবে আগুন লগিয়ে দেওয়া হয় ওইসব ঝোপ-ঝাড়ে। এরফলে ওই জায়গাগুলোতে আবাস গড়ে তোলা ছোট ছোট বন্যপ্রানীগুলো আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছে। কে না জানে, অধিক গাছপালা ও তৎসংলগ্ন ঝোপ-ঝাড় এসব বন্যপ্রাণির জন্য অভয়াশ্রম হিসেবে কাজ করে।
অতি সম্প্রতি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে প্রায় বার একর জমির বনজঙ্গল পরিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হলুদ চাষের জন্য লিজ দিয়েছে। ইতিমধ্যে সেখানে হলুদ চাষের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। এর পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিক যুক্তি দিয়েছেন, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চুরি-ছিনতাই ঠেকাতে পুলিশ প্রশাসনের অনুরোধে জঙ্গল পরিস্কার করে হলুদ চাষের জন্য লিজ দেয়া হয়েছে। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বাড়বে বলে তিনি জানান। আবার এখন নাকি ক্যাম্পাসে সবুজ গাছের বাগান ধ্বংস করে ক্যাম্পাসে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। কতটুকু বিদ্যুৎ ক্যাম্পাসবাসী পাবে তা জানি না, তবে একথা সত্য- ক্যাম্পাসের সবুজ গাছ আর কিছু নিজস্ব জমি হাত ছাড়া হয়ে যাবে এর ফলে।
প্রতিবছর শীতকালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোতে আসত অতিথি পাখি। কিন্তু প্রশাসনের বেনিয়া মানসিকতা ও উদাসিনতার ফলেই এই বছর ক্যাম্পাসে অতিথি পাখির দেখা পাওয়া যায়নি। লেকগুলো লিজ দিয়ে সেখানে চলছে মাছের চাষ। বিভিন্ন রাসায়নিক আর পরিবেশনাশী উপকরণ প্রয়োগের ফলে পাখিরা ছেড়েছে এসব লেক এবং ক্যাম্পাস।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয় কি কোনো ফার্ম, যে এখানে মাছ চাষ হবে? এখানে হলুদ চাষ হবে? নাকি এটা কোনো বাণিজ্যিক প্রকল্প যে এখান থেকে টাকা আয় করতেই হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কার্যত্রম দেখে মনে হচ্ছে, শিক্ষা দেয়ার জন্য তাদের কোনো উদ্যোগ নেই, তাদের সব উদ্যোগ- কিভাবে আয় বাড়ানো যায়।
এখন আর জলাশয়ে দেশি প্রজাতির মাছগুলোও পাওয়া যায় না, কিছু বড় বড় কার্প জাতীয় মাছ পানিতে ভাসে; লেকের কাছে যাওয়াটাও ক্যাম্পাসবাসীর জন্য নিষিদ্ধ। কারণ, টাকার বিনিময়ে আমরা জলাশয় দেখার অধিকার অপরের কাছে বন্ধক রেখেছি। এখন শীতের সময় অতিথি পাখীরা বাংলাদেশে আসে কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়ে বসে না। কারণ নগদ কিছু পাওয়ার জন্য পাখীর গান না শোনার চুক্তি আমরাই করেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন তুহিনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ক্যাম্পাসের জীববৈত্রিত্য নিয়ে। তিনি এসব নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বললেন, ‘ক্যাম্পাসের বনজঙ্গল উজার হওয়ার ফলে বন্যপ্রাণিদের আবাসস্থল ও প্রজণন ক্ষেত্রগুলো নষ্ট হয়েছে। যার ফলে আগে দেখা পাওয়া বন্যপ্রাণীর সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে।
তিনি দুঃখ নিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশে মোট ৩০০ প্রজাতির প্রজাপতির মধ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়েই ১০০ প্রজাতির প্রজাপতি পাওয়া গেছে। দিন দিন এভাবে বন-জঙ্গল উজার হতে থাকলে এসব প্রজাপতির সংখ্যাও কমে যাবে। আগে ক্যাম্পাসে অসংখ্য শিমুল ও পলাশ গাছ ছিল। কিছুদিন আগে এক জরিপে দেখা গেছে, ক্যাম্পাসে এখন মাত্র অর্ধশতাধিক শিমুল ও পলাশ গাছ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার সময় তার সময়কালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভবন নির্মাণসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথাই বেশি বলেন। কিন্তু হলুদ চাষ করে, মাছ চাষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কী উন্নয়ন করলেন তা কখনো বললেন না। আশা করি তিনি পরবর্তী কোনো অনুষ্ঠানে বলবেন, মাছ চাষ ও হলুদ চাষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কি উন্নয়ন করলেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে কত টাকা জমা করলেন এই হলুদ চাষ ও মাছ চাষ করে। গাছ ও ঝোপ-ঝাড় কেটে ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্যসহ পরিবেশ ও সৌন্দয্যের যে ক্ষতি হয়েছে এই টাকা দিয়ে সেই ক্ষতি পূরণ সম্ভব কিনা?
সবশেষে এটা বলতে পারি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সব উপাচার্যের তালিকায় আপনার নামটি বিশেষভাবে লেখা থাকবে- গাছ ও ঝোপ ঝাড় কেটে ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্যসহ পরিবেশ ও সৌন্দয্য হানি করার কারণে। এ বিষয়টি কি আপনাকে একবারও ভাবিত করে না?
লেখক: জাবি ছাত্র
oliju10@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৬ ঘণ্টা, ১১ এপ্রিল, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর