২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির এক রাতের গল্প। আদাবর এলাকায় বোনের বাসায় থাকি।
চারপাশ থেকে অগণিত মানুষ জাপান গার্ডেন সিটির দিকে আসছে। মনে হলো, মোহাম্মদপুর এলাকার কোনো পুরুষ বুঝি আজ বাসায় বসে নেই। রিং রোড জনসমুদ্র। সেই সমুদ্রে আমিও মিশে গেলাম। ভিড় ঠেলে এগুতে পারছি না। মানুষের সঙ্গে মানুষ মিশে গিয়েছে। একটু বেখেয়াল হলেই নিচে পড়ে যেতে হবে। এই অবস্থায় পড়ে গেলে, হাজার হাজার লোকের পায়ের নিচে চলে যাবো। উঠে আসার কোনো সুযোগ থাকবে না। আমি উপায় না দেখে, অনেক কায়দা করে ভিড় থেকে একটা সময় বের হলাম। রিং রোড থেকে দূরে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ দেখছি।
এই সময় দেখলাম, রিং রোডের ওই মাথা থেকে মানুষের একটা ঢল এই দিকে দৌড়ে আসছে। হাজার হাজার মানুষ দৌড়াচ্ছে। কে কোন দিকে কেন দৌড়াচ্ছে, কেউ জানে না। দৌড়ে আসা মানুষদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনা কি? সে বললো, পুলিশ ধাওয়া দিয়েছে। দূরে দেখলাম, শিয়া মসজিদের কাছে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আসলে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে। উৎসাহী হাজার হাজার জনতার ভিড় ঠেলে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি একদমই এগুতে পারছে না। একেবারে জায়গায় থমকে গিয়েছে যেন। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া আরও বেশ কয়বার চললো। পুলিশ একটু সরে গেলেই উৎসাহী জনতা আবার জাপান গার্ডেন সিটির দিকে দৌড়ে যায়। দূর থেকে যেন আগুন দেখায় কোনো আনন্দ নেই।
রাত এগারোটার দিকে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি জাপান গার্ডেন সিটির ভিতরে ঢুকতে শুরু করলো। আমি অনেক দূরে দাঁড়িয়েও স্পষ্ট দেখলাম, উন্মত্ত আগুনের লাল শিখা তখন বারোতলা ছুঁয়ে ফেলেছে।
এই ঘটনার উপসংহার বলি। রাত প্রায় পৌনে বারোটার কাছাকাছি সময়ে সেই বিল্ডিংয়ের বারোতলা থেকে সাত জন মানুষের লাশ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে এই পরিবারের দুই জন শিশু। মেয়েটার নাম আয়েশা যার বয়স সাত বছর। আর ছেলেটা ফাহিম, যার বয়স এগারো বছর। ফাহিমের গৃহশিক্ষক যে ছেলে, তার কাছ থেকে জেনেছি, আগুন লাগার পর এই পরিবারটি ভয়ে ছাদের দিকে চলে যায়। ছাদের দরজা বন্ধ ছিল। আগুনও তখন উপরের দিকে উঠছে। আর নিয়মের ফাঁক গলে তৈরি করা অন্যসব ভবনের মতো এখানেও আগুন থেকে বাঁচার জন্য বিকল্প কোনো সিঁড়ি ছিল না।
তারপরও এই পরিবারটি বাঁচার আশায় অপেক্ষায় ছিল। আসাদ গেটের ফায়ার সার্ভিস স্টেশন থেকে রিং রোড আসতে খুব বড়জোর পাঁচ থেকে সাত মিনিট লাগার কথা। তাদের বাঁচাতে ফায়ার সার্ভিস সময়মতো আসতে পারেনি। এই শহরের হাজার হাজার মানুষ রাস্তা আটকে তখন আগুন দেখছিল। দূর থেকে আগুন দেখায় আনন্দ নেই।
প্রিয় পাঠক, এই দেশের সাধারণ মানুষের কথা বলছি, যারা সীমাহীন ক্ষমতা ধারণ করেন। তারা সংখ্যায় প্রায় পনেরো কোটি। তারা চাইলেই রাস্তা আটকে দিতে পারেন। শহর, বন্দর-নগর অচল করে দিতে পারেন। এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন তাদের প্রিয় ক্রিকেট দলটিকে এমন এক জনপদে পাঠানোর খবর এসেছে, যার পরিচিতি মৃত্যু উপত্যকা হিসেবে। নিরাপত্তার প্রশ্নে দেশটাকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তাদের ওপর কেউই বিশ্বাস রাখতে পারেনি। কখনো পারবেও না।
প্রিয় পাঠক, যে দেশটার প্রসঙ্গে পৃথিবীর বাকি সব দেশ মুখ ঘুরিয়ে নেয়, সেখানে আমাদের ক্রিকেটারদের পাঠানোর সিদ্ধান্তে আমরা কতটুকু অপমানিত হয়েছি, ভাবতে পারেন? আচ্ছা, সে কথা না হয় বাদ দিলাম। আপনার সকল আবেগ কিংবা ভালোবাসার জায়গাটাকে যদি কেউ, জুয়ার মঞ্চ বানিয়ে ফেলে, আপনি কি তাকে ছেড়ে দেবেন?
এদেশে খুব সাধারণ কারণে মানুষ জড়ো হয়। রাস্তায় ক্যানভাসারদের ঘিরেও শত শত মানুষদের দেখা যায়। এটা হচ্ছে মানুষদের দেশ। মানুষের এই দেশটা থেকে তাদের প্রিয় ক্রিকেট দলকে ‘পাকিস্তান’ নামের এক মধ্যযুগীয় দেশে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। যেখানে গত পরশুদিনই জেল ভেঙে কয়েক শ’ কয়েদিকে জঙ্গিরা মুক্ত করে দিয়েছে। তাদের পাশের দেশ আফগানিস্তানে দুদিন আগেও বিদেশি দূতবাসগুলোর ওপর একটানা ১৮ ঘণ্টা আক্রমণ হয়েছে। অতীত ইতিহাস বলে, আফগানিস্তানে শুরু হওয়া তাণ্ডব সবসময়ই শেষ হয়েছে পাকিস্তানে এসে।
আমাদের ক্রিকেটারদের পাতাল পথে কিংবা গায়েবি কোনো উপায়ে পাকিস্তানে পাঠানোর সুযোগ নেই। তারা আমাদের চোখের সামনে দিয়ে এই রাজপথ ধরে এয়ারপোর্টে যাবেন। এর পর তাদের গন্তব্য হবে নিষিদ্ধ এক মৃত্যু উপত্যকা।
আগেই বলেছি, এদেশে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর কারণে মানুষ জড়ো হয়। এখানে মানুষ জড়ো হতে কারণ লাগে না। তাই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর বন্ধ করার জন্য বিশেষ কোনো আয়োজনেরও দরকার নেই এই দেশের মানুষের। সংখ্যায় এরা প্রায় পনেরো কোটি। তারা চাইলেই রাস্তা আটকে দিতে পারেন। শহর, বন্দর-নগর অচল করে দিতে পারেন। তারা কারণে-অকারণে এই কাজগুলো করেন। কখনো বুঝে করেন, আবার কখনো না বুঝে করেন। আমি আশাবাদীদের দলে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের বিশাল এই জনস্রোত পেরিয়ে সাকিব-তামিমদের বাসটা কোনোভাবেই এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে না।
আমি আশাহত হতেই পারি। সেটা নতুন কিছু না। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে গেলে আমার লেখায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। আমি হয়তো বলবো, প্রায় পনেরো কোটি মানুষের এই দেশটা শুধু একটা ‘লোটাস কামাল’ এর কাছে হেরে গিয়েছিল।
নেদারল্যান্ডসে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সাংবাদিকতার ছাত্র
siddique1237@gmail.com
বাংলাদেশ সময় : ০৯২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১২