প্রয়াত সাংবাদিক মিনার মাহমুদ আত্মহননের ক’দিন আগে এসেছিলেন একাত্তর টেলিভিশনের এক আলোচনায় যোগ দিতে। বিষয় ছিলো আমাদের নতুন সংবাদ কর্মীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলা।
অনেক কথা শুনেছি। অনেক উপদেশ ছিলো অনেকের দিক থেকে। কিন্তু মিনার মাহমুদের একটি কথা কানে বাজছে এখনো। তিনি বলেছিলেন, ‘একজন রিপোর্টারকে তথ্য বের করার জন্য অনেক প্রশ্ন করতে হবে, প্রশ্ন করতে জানতে হবে, যতক্ষণ না নিজের কাছে মনে হবে যে তথ্য সম্পূর্ণ হয়েছে, ততক্ষণ প্রশ্ন করে যেতে হবে। ’
পশ্চিমা দেশগুলো থেকে প্রকাশিত সাংবাদিকতার অনেক বইতেই পড়েছি রিপোর্টারের অনেক গুণের একটি হলো Should have ability to ask critical questions। এই যে প্রশ্ন তা সাধারণ প্রশ্ন নয়, প্রয়োজনীয় জটিল প্রশ্নও করতে জানতে হবে।
কিন্তু তা কি দেখছি আমরা ইদানিং? পত্রিকা কিংবা অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলোতে তবুও কিছুটা ক্রিটিক্যাল দিক পাওয়া যায়, টেলিভিশনগুলোয় তা অনেকাংশেই নেই।
শুরু করা যাক সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড দিয়ে। প্রথম দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে। কিন্তু তা আর হয়নি। এরপর পুলিশের মহাপরিদর্শক সংবাদ সম্মেলন করে জানালেন তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তাও কিছু বোঝা গেলো না। এরপর প্রায় প্রতিদনিই ডিবি’র মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের ব্রিফিং দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিটি স্তরে যে বিষয়টি প্রকট হয়ে উঠেছে, অন্তঃত টিভি’র পর্দায়, তা হলো এক তরফা এইসব বক্তব্য প্রচার করে যাওয়া।
একটি বড় সময় যখন পার হয়ে গেলো, হত্যাকারীদের ধরা গেলো না তখনো শুধু এসব কর্মকর্তার কথাই শুনে যাচ্ছি আমরা।
“হত্যার কোনো ক্লু বের করা সম্ভব হচ্ছে না তার কারণ কি পুলিশের অদক্ষতা?” এই প্রশ্নটি একজনকেও করতে দেখা গেলো না, অন্তত: প্রচার হতে দেখিনি।
পুলিশের দক্ষতা নিয়ে যে প্রশ্ন আছে তা শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হলো উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণে। এখন এই হত্যাকাণ্ড নতুন করে তদন্ত করছে র্যাব।
একই ধরনের সংবাদ প্রচার দেখা গেলো সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তার খুনের বেলায়ও। যা বলছে, মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরছেন, কথা রেকর্ড করে চলে আসছেন, সংবাদ প্রচার করছেন।
আসা যাক খিলগাঁও থেকে হারিয়ে যাওয়া শিশু মাইশার প্রসঙ্গে। ডাকাতদল ডাকাতি শেষ করে তাকে তুলে নিয়ে যায়, মুক্তিপণ দাবি করে। আবার তারা তাকে ফেলেও যায় মীরপুরে। স্থানীয় লোকজন শিশুটিকে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়। তারপর সে তার মা-বাবার কাছে ফেরত যায়। এখানেও দেখা গেলো পুলিশ সাংবাদিকদের কাছে দাবি করছে তাদের তৎপরতার কারণে শিশুটিকে তারা ফেলে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু কোনো প্রশ্ন দেখা গেলো না এখানে পুলিশের তৎপরতাটি আসলে কী ছিলো? তাদের কৃতিত্বই বা কতটুকু? ডাকাতরা ফেলে গেছে, মানুষ শিশুটিকে পথে পেয়ে পুলিশে খবর দিয়েছে। পুলিশের কৃতিত্ব হবে যদি ডাকাত দলটিকে ধরতে পারে।
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার প্রতিবাদে বিএনপি তিনিদিন হরতাল করেছে। প্রতিদিন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা অন্য কোনো নেতা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের একতরফা ব্রিফিং বারবার প্রচার পেয়েছে। অনেক ক্রিটিক্যাল প্রসঙ্গ ছিলো। সেগুলো বাদ দেওয়া যায়। কিন্তু একটিবারও শোনা গেলোনা লাখ লাখ এইচএসসি পরীক্ষার্থীর বিষয়টি নিয়ে তাদের সুনির্দিষ্ট যুক্তিটি কী? তারা হরতালের আগে বাসে মানুষ পুড়িয়ে মারার কোনো দায় স্বীকার করেন কিনা? তিনদিন হরতাল শেষে বিএনপি চেয়ারপরসন খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনে এমন প্রশ্ন ছিলো কিনা অন্ততঃ চ্যানেলগুলোর পর্দায় দেখা যায়নি।
তেমনিভাবে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী আর আওয়ামীলীগ নেতা মাহবুবুল আলম হানিফ অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু একজনকেও প্রশ্ন করতে দেখা গেলোনা যে ঘটনা যেভাবেই ঘটুক সরকার কি এর দায় এড়াতে পারে?
বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিষ্টার রফিকুল হক ইলিয়াস নিখোঁজের ঘটনায় বক্তব্য দিয়েছেন। সমবেদনা জানিয়েছেন। সরকারের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু যদি বিবেকের তাড়নাতেই তিনি কথা বলেন, তাহলে প্রশ্ন ছিলো তার বিবেক কি একবারও নাড়া দেয়নি দরিদ্র বাসচালককে পুড়িযে মারা কিংবা লাখ লাখ এইচএসসি পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়া নিয়ে? কোনো প্রশ্ন করতে দেখা গেলো না কাউকে? শুধুই মাইক্রোফোন সামনে ধরে থাকা।
কাউকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়। আত্ম উপলব্ধি থেকে লেখা। অনেকেই হয়তো বলবেন আপনিও তো টেলিভিশনের বার্তা বিভাগ চালান। আপনার চ্যানেলের লোকজনকে তাহলে কি শেখালেন? এই প্রশ্ন আমার নিজের কাছেও। আমরা কি প্রশ্ন করতে ভুলে গেছি, নাকি আমাদের মনোবল নেই, নাকি আমাদের দক্ষতাই নেই পশ্ন করে তথ্য বের করে দর্শককে জানানোর?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, বার্তা পরিচালক, একাত্তর টেলিভিশন
বাংলাদেশ সময় ১০১৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১২
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।