পূর্ববাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম কানুনগোপাড়া, জেলা চট্টগ্রাম। শহর চট্টগ্রাম থেকে মাত্র বার মাইল দূরে পাহাড় ও নদীবেষ্টিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যমণ্ডিত কানুনগোপাড়া গ্রামেই আনুষ্ঠানিক আয়োজনে শুরু হয় বসন্ত উৎসব।
সময়টা ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। সপ্তাহব্যাপী এই উৎসব শেষ হয় ১৪ মার্চ। পাকিস্তানি শাসনের নাগপাশ থেকে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় পরবর্তী মুক্ত স্বাধীন দেশে আবারো নতুন উদ্যমে বসন্ত উৎসব শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। পূর্ববাংলা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ।
আজ থেকে ৫২ বছর আগে শুরু হওয়া নতুন এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা আজকের বাংলাদেশের অন্যতম এক আনন্দ উৎসব। সেদিনের আয়োজকরা যার নাম দিয়েছেন বসন্ত উৎসব। এই বসন্ত উৎসবের আগে একই স্থানে ১৯৬৮ সালে রাস উৎসব নামে একটি উৎসব হতো। সেখানে দিবারাত্রি কীর্তন ও খিচুড়ি বিতরণ হতো। হাজারো ধর্মপ্রাণ সনাতন ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ যোগ দিতেন। আমরাও দেখতে যেতাম। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত রাস উৎসব চলে। ১৯৭০ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে লাখো মানুষের প্রাণহানির ঘটনা, জাতীয় সংসদ নির্বাচন- সব মিলিয়ে সে বছর রাস উৎসব উদযাপন করা হয়নি। ১৯৭১ সালে রাস উৎসবের আয়োজকরা ধর্মীয় বাতাবরণ থেকে বেরিয়ে এসে এক সর্বজনীন আনন্দমেলার আয়োজন করে নাম দিলেন ‘বসন্ত উৎসব’। মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে আবারো আয়োজন করা হয় এই বসন্ত উৎসবের। একটানা ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত চলে। বিভিন্ন কারণে এরপর প্রায় দশ বছর বসন্ত উৎসব আয়োজন বন্ধ ছিলো। ভালোবাসার বসন্ত উৎসবের এই বিরাম দর্শক-শিল্পী সবাইকে দারুণভাবে মর্মাহত করে। পরবর্তীতে নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসে। প্রবীণদের সহায়তা ও পরামর্শে বসন্ত উৎসবকে তারা পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে ১৯৯৪ সালে।
কানুনগোপাড়ার মতো প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বসন্ত উৎসবের মতো নতুন একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূত্রপাত হলো, বর্তমান সময়ে নগরকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক পালা-পার্বণ উৎসবে এই কথা কেউ বলবে না। হালের নগরকেন্দ্রিক করপোরেট সংস্কৃতিতে কেবলই নিজেদের জাহিরের প্রবণতা। বর্তমানে দেশজুড়ে বর্ণিল আয়োজনে যে বসন্ত উৎসব হয়, একদা গ্রামীণ সংস্কৃতিতে অনানুষ্ঠানিকভাবে পালিত হওয়া পহেলা ফাল্গুন বসন্ত দিন আজ করপোরেট ছোঁয়ায় নগর সংস্কৃতির বড় একটি উপলক্ষ্য। তরুণ-তরুণীর বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস।
সত্তর দশকে দেশের কোথাও ঘটা করে বসন্ত উৎসব হতো বা এমন একটা উৎসবের আয়োজনের কথা আমার ঠিক জানা নেই। তখন যে ক’টি সংবাদপত্র ছিলো তার প্রায় সবকটি আমার পড়বার সুযোগ হতো। তখন সংবাদপত্র বলতে ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক বাংলা, চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী। অবজারভার, টাইমস- এসব বাবার পাঠ্য। সাপ্তাহিক বিচিত্রা পরবর্তীতে রোববার। তখন ইত্তেফাকে ছোটদের পাতা কচিকাঁচা, সংবাদে খেলাঘর ছিলো আমাদের পাঠের অন্যতম পাতা। তারপর দৈনিক বাংলার খেলার পাতা। কানুনগোপাড়া কলেজ তথা স্যার আশুতোষ কলেজে বাবার শিক্ষকতার সুবাদে প্রায় সবকটা পত্রিকা রাখা হতো বাসায়। একজন রাজা মিয়া আমাদের ‘রাজা দা’ পত্রিকা দিত। সংবাদপত্র পাঠের হাতেখড়ি সেই কিশোরবেলা থেকেই। সেই সময় পত্রিকা পড়েই আমাদের সময়ের কিশোর তরুণদের দেশ ও বিশ্বকে জানা।
তখন ঢাকার রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করতো ছায়ানট, এছাড়া রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর সংবাদ পড়তাম। কখনও বসন্ত উৎসবের খবর পড়েছি বলে মনে আসছে না। এখন কত ধরনের উৎসব। গ্রামের হারিয়ে যাওয়া উৎসব জায়গা নিয়েছে নগর কেন্দ্রে। পৌষ উৎসব, বর্ষা উৎসব, এবার দেখলাম শীত উৎসব(!), কুয়াশা উৎসব! চৈত্র সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ এসব আমাদের বাঙালিয়ানার অংশ। গ্রামে এক সময় ঘরে ঘরে পালিত হতো ঘরোয়াভাবে। গ্রামীণ মেলা হতো একদিন-দু’দিনের। বৈশাখের হালখাতা উৎসব, হতো ‘বলিখেলা’ । গ্রামীণ মেঠো মেলার এই সংস্কৃতি এখন অনেকটা উঠে যাচ্ছে। কারণ অনেক। বসন্ত উৎসব এখন শহরের বিশেষ আয়োজন। ফুলেল শুভেচ্ছা। তরুণীর হলুদ শাড়িসাজ, তরুণদের হলুদ সহ বর্ণিল পাঞ্জাবি। কোথাও গানের আয়োজন।
কানুনগোপাড়া নামটি চট্টগ্রামের এক স্নিগ্ধ গ্রাম। শহর থেকে মাইল দশ দূরের এই গ্রাম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অগ্রসরমান ঐতিহ্যমণ্ডিত। সেই গ্রামের কিছু তরুণ যুবার মেধা নিসৃত এই ‘বসন্ত উৎসব’ এর পুরোধা পুরুষ ছিলেন প্রবীর কুমার চৌধুরী বা বন চৌধুরী । তাঁর সহযাত্রী হয়েছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও নাটক পাগল কিছু তরুণ-যুবক। তাদের মধ্যে পরিতোষ কানুনগো, রবি ঘোষ, বিকাশ সেন, মাস্টার অরূপ চ্যাটার্জি, গোপাল দে, বিজয় চক্রবর্তী, শিবু মহাজন, মৃণাল কান্তি বল, সুকুমার সর্ববিদ্যা, মাস্টার অনিল শীল, বাবুল চক্রবর্তী, মৃণাল কান্তি ঘোষ, রাখাল দাস, মৃদুল সেন, শান্তলাল হরিদাশ, গণেশ দে। পরবর্তী সময়ে যোগ হন আহমদ হেসেন, আবুল হোসেন, সমীর কানুনগোসহ অনেকেই।
কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক পার্থ প্রতিম চৌধুরী, অধ্যাপক বাদল বরণ বড়ুয়া, অধ্যাপক সুকুমার দে, কানুনগোপাড়া ড. বিভূতি ভূষণ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সুকুমার শীল, সুশীল কুমার দে ছিলেন পরামর্শক। এর বাহিরে আরো অনেকেই ছিলেন। মূল উদ্যোক্তা বন চৌধুরী। কানুনগোপাড়া ড. বিভূতি ভূষণ হাইস্কুলের সামনে হরি মন্দিরের মাঠে বসতো এই নাটকের উৎসব। নাট্য সপ্তাহ পৌঁছেছে নাট্যপক্ষে। পনের দিনব্যাপী মঞ্চ নাটক হতো। দূর-দূরান্ত থেকে নারী-পুরুষ আসতেন নাটক দেখতে। তখন সবে কলেজে প্রবেশ করেছি। বসন্ত উৎসবের সেইসব নাটক দেখতে বোয়ালখালীর বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও দূরবর্তী এলাকা পটিয়ার ধলঘাট, ভূর্ষি, রতনপুর, কেলিশহর, কর্ণফুলী নদীর ওপাড়ের রাঙ্গুনিয়ার বেতাগী, লাম্বুরহাট এলাকা এবং চট্টগ্রাম শহর থেকেও বহু নাটকপ্রেমি মানুষ কানুনগোপাড়া আসতেন।
ওই সময় কানুনগোপাড়ার সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের বাস যোগাযোগ ছিলো। রাতের বাসে শহর থেকে কানুনগোপাড়া এসে নাটক দেখে ভোরে প্রথম বাসে আবার শহরে চলে যেতো অনেক দর্শক। এই গ্রামীণ জনপদের অনেক দূর থেকে মহিলারা দল বেঁধে হারিকেন জ্বালিয়ে এসব নাটক দেখতে আসতেন। সেই সময়ের সামাজিক পরিবেশ এমন ছিলো যে, রাতে নাটক দেখতে আসা কোনও নারীকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি। দুষ্টু মানুষ যে এক্কেবারে ছিলো না, তা নয়। কিন্ত তারপরও রাতে গৃহকর্ম শেষ করে নারীরা নির্ভয়ে নাটক দেখতে আসতেন। বসন্ত উৎসবের সময়ে কানুনগোপাড়া ও তার আশপাশের গ্রামের বিবাহিত কন্যারা শ্বশুর বাড়ি থেকে ননদ-জা’দের নিয়ে বাবার বাড়ি নাইয়র আসতো।
বসন্ত উৎসব নিয়ে বন চৌধুরীর স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করছি। ‘কানুনগোপাড়ায় প্রথম বসন্ত উৎসবের বীজ বপন হয়েছিল ১৯৭১ সালে। বসন্ত উৎসবের সেই হরিমন্দির প্রাঙ্গণ বা শ্যাম রায়ের হাট মাঠে এককালে চারণ কবি মুকুন্দ দাস স্বাধীনতার জাগরণী গান গেয়ে দেশবাসীকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করেছিলেন । এই মাঠে অগ্নিপুরুষ মাস্টারদা সূর্যসেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, কল্পনা দত্ত, লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ প্রমুখ আত্মোৎসর্গকারী বিপ্লবী মহানায়কেরা তেজোদীপ্ত ভাষণে দেশবাসীকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন। বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রামের অবদান অগ্রগণ্য। চট্টগ্রামের বীর বিপ্লবীদের প্রাণকেন্দ্র ছিল বোয়ালখালী। আর বোয়ালখালীর কেন্দ্রে অবস্থিত মাঠ ঘিরে এই এলাকা ছিল বিপ্লবীদের প্রধান চারণভূমি’।
‘১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর সূর্য সৈনিকেরা হলেন দেশান্তরি। সঙ্গে সঙ্গে এই মাঠের রমরমা গেল মরে। উপযুক্ত উদ্যোগীর অভাবে দীর্ঘদিন এই মাঠ ছিল নির্বাক। সুদীর্ঘ সময় পর ‘মূক মাঠকে মুখর করার ব্রত নিয়ে ১৯৬৮ সালে কতিপয় তরুণ ‘রাস উৎসব’ নামের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করলো। আলো জ্বললো, মূর্ছা ভাঙ্গলো, কিছুটা কলকোলাহলে জেগে উঠলো সুপ্ত মাঠ। যথেষ্ট আলোড়ন তুলে ৬৮ ও ৬৯ সালের রাস উৎসব সম্পন্ন হলো। ৭০ সালে রাস উৎসবের প্রথমদিকে ঘূর্ণিঝড়ে সবকিছু বিপর্যস্ত হয়ে গেল। ১৯৭০ সাল দুটি কারণে বাঙালির জন্য অবিস্মরণীয়। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও প্রবল জলোচ্ছ্বাসে দশ লাখ স্বজন হারানোর বেদনা এবং পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে বঞ্চিত বাঙালির নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য অর্জনের আনন্দ। দ্বিজাতি তত্ত্বের খোলস খুলে পাকিস্তানের আরোপিত সাম্প্রদায়িকতার কৃত্রিম বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব বাঙালি তখন এক জাতি এক প্রাণ একতায় সঙ্গবদ্ধ। মহামিলনের এই আনন্দ প্রকাশ করার জন্য রাস উৎসবের আয়োজকরা ধর্মীয় বাতাবরণ থেকে বেরিয়ে এসে এক সর্বজনীন আনন্দমেলার আয়োজন করলো। নাম দিলো ‘বসন্ত উৎসব’। বসন্ত উৎসব কোনো ধর্মীয় উৎসব ছিল না। শুধু বাঁচার জন্য চাই অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান। কিন্তু বাঁচার মত বাঁচার জন্য চাই চিত্ত বিনোদন। বসন্ত উৎসব হচ্ছে চিত্ত বিনোদনের একটি প্রধান উপাদান। কানুনগোপাড়ায় সপ্তাহব্যাপী প্রথম বসন্ত উৎসব মহাসমারোহে সমাপ্ত হয় ১৪ মার্চ, ১৯৭১ সালে’।
বর্তমান সময়ের চলমান বসন্ত উৎসব আয়োজনের আগেও ছোট্টবেলায় আমরা বসন্ত আয়োজন দেখেছি। তখন দেখেছি, কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজের দিদিরা এই বিশেষ একটা দিনে হলদে বরণ বা বাসন্তী রঙের শাড়ি ফুলের খোঁপাসহ সেজেগুজে কলেজে আসতেন। হয়তো সেই বয়সে এমন বিশেষ কিছু বুঝতাম না। তারপরও দেখতাম আমার দুই ফুফুর দুই মেয়ে আমাদের এই আপাদের বান্ধবীরা বাসায় আসতেন। অসাধারণ সাজ। এসব দৃশ্য স্বাধীনতার আগের ঘটনা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই উৎসবে রঙ লাগে। কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান-বাজনা হতো।
এই বিশেষ দিনে বিশেষ রঙের শাড়ি পড়ার বিষয়টি বুঝতে পারছি আরো বড় হয়ে। তখন আমি স্কুলের উপরের ক্লাসে। ড. বিভূতি ভুষণ স্কুল লাগোয়া কলেজ। কলেজের করিডোর পার হয়ে আমার স্কুলে যাওয়া। চলতি পথে ছাত্রীদের বিশাল কমনরুম। ফাল্গুনের প্রথম দিবসে কলেজের দিদিদের সাজগোছ নজর এড়াতো না। প্রায় সব দিদি-আপারা এই একটি দিনে সুন্দর সুন্দর সাজ নিয়ে কলেজে আসতেন। অনেক দিদিকে দেখতে দারুণ লাগতো। বেশ কয়েকজন দিদি ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দরী। সেই দিদিরা যে কেবলই সুন্দরী তা নয়, কলেজের নাটক সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও সরব ছিলেন। দারুণ গান করতেন এমন ক’জন দিদির ছবি এখনও চোখে ভাসে।
আমাদের বসন্ত উৎসব দেখা ও বুঝবার মধ্যে একটু তফাৎ রয়েছে। ছোট্টবেলায় কলেজের দিদিদের বিশেষ রঙের শাড়ি পড়বার দিন, এটা একদিনের নয়। এই যে দিদিদের শাড়ি পড়া, এটা মা-ঠাকুমা, দিদিমা-নানী-দাদীর কাছ থেকে শেখা। এটা চিরায়ত ঐতিহ্য। এসব ছিলো অনানুষ্ঠানিক কার্যক্রম। আমাদের বেড়ে উঠবার প্রিয় প্রাঙ্গণে যখন আমরা বসন্ত উৎসব আয়োজন দেখতে শুরু করি তখন উৎসবের মূল ছিলো সপ্তাহব্যাপী নাটক। পরবর্তীতে এই নাট্য উৎসবের ব্যাপ্তি গিয়ে ঠেকে পক্ষকাল।
বসন্ত উৎসবের উদ্যোক্তা পুরুষ বন চৌধুরী বা প্রবীর কুমার চৌধুরী যেমন সুদর্শন ছিলেন তেমনি একজন অসাধারণ শিক্ষকও ছিলেন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকার প্রাক্তন ছাত্ররা এখনও শ্রদ্ধাভরে তাঁর নাম উচ্চারণ করেন। আমি তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি সীতাকুণ্ড আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমার নানা- মামাদের পড়া ঐতিহ্যবাহি এই স্কুলে আমার ও বড় ভাইয়ের কিছুদিন পড়বার সুযোগ হয়েছিল। সময়টা ১৯৭০ সাল।
কতোদিন ধরে তিনি ওই স্কুলে শিক্ষকতা করছেন জানি না। ছাত্ররা ভীষণ সমীহ করতো। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ের সীতাকুণ্ড স্কুলের ছাত্রদের কাছে তিনি এখনও স্মরণীয়। বি.কম স্যার নামে খ্যাত। একজন ভালো ফুটবল রেফারি হিসাবেও তাঁর সুখ্যাতি ছিলো।
একসময় এই দেশে গ্রামে-গঞ্জে যাত্রাপালা হতো, স্কুল-কলেজে বার্ষিক নাটক হতো। গ্রামের তরুণরা তাদের ক্লাবের উদ্যোগে নাটক করতো। তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলো না। নাটক কিন্তু হয়েছে। নাটক বন্ধ থাকেনি। বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা পেট্রোমাক্স বা হ্যাজাক লাইট চিনে কিনা জানি না। সেই পেট্রোমাক্স জ্বালিয়ে কী কৌশলে তারা নাটক করতো। এমন নাটক দেখার সুযোগ আমার হয়েছে বেশ কয়েকবার। পেট্রোমাক্স জ্বালিয়ে নাটক করা বা যারা এই হ্যাজাক লাইটের আলোকে নাটকের প্রয়োজনে আলো-আঁধারি বা বর্ণিল করতেন তারা দারুণ শিল্পী। আলোর শিল্পী। কানুনগোপাড়ার কথা ভিন্ন। কানুনগোপাড়া কলেজে ও বোয়ালখালীর বহু গ্রামে বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ হয়েছে বহু আগে। স্বাধীনতারও আগে। কানুনগোপাড়ার বসন্ত উৎসবে চট্টগ্রামের সেই সময়ের সেরা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নাটক করেছেন। অনেকে পরবর্তীতে সিনেমার নায়ক-নায়িকা হয়েছেন। অনেক শিল্পী তৈরি করেছে বসন্ত উৎসব মঞ্চ।
৫২ বছর আগে কানুনগোপাড়া নামে বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে একজন বন চৌধুরীর সৃষ্ট অনন্য সাধারণ সৃজনকর্ম ‘বসন্ত উৎসব’ সত্তর ও আশির দশকের সেই অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবে। নতুন প্রজন্ম হয়তো শুনবে-জানবে, একসময় এই কানুনগোপাড়ায় বসন্ত উৎসব হতো। পক্ষকালব্যাপী রাতভর নাটক দেখতো মানুষ। সেই বসন্ত উৎসবের আনন্দ উল্লাস আজ দেশময়। বসন্ত উৎসব আজ আলোয় উদ্ভাসিত। কিন্ত সেই বন চৌধুরী ও তার সেদিনের কুশিলবরা আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। আসলে কী বন চৌধুরীরা কখনো হারিয়ে যায়?
লেখক: সাংবাদিক, গল্পকার।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২৩
এসি/টিসি