ঢাকা, শনিবার, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিতর্কই জাবি ছাত্রলীগের মূলমন্ত্র!

ইমদাদ শুভ্র, চৌধুরী রাতিম, শিরন, মাহি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৪ ঘণ্টা, মে ২, ২০১২
বিতর্কই জাবি ছাত্রলীগের মূলমন্ত্র!

বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। ছাত্ররাজনীতিবিহীন বর্তমান ক্যাম্পাসের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিনষ্টের পেছনে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, সাধারণ শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, শিক্ষার্থীদের মাদক গ্রহণে প্ররোচনা, জমি দখল, প্রার্থীদের টাকা নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোর করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কাজে সম্পকৃক্তকরণ, মুরগী চুরিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে এসব নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।


 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি মীর মশাররফ হোসেন হল, মওলানা ভাসানী হল, কামাল উদ্দিন হল, রফিক-জব্বার হলে মাদক সেবনের হার আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে। নিয়মিত কিছু সেবনকারীর সঙ্গে প্রতিদিনই যোগ দেন নতুন ছাত্ররা। জুনিয়রদের রুম অথবা ছাদে বসে গাঁজা, হেরোইন ও মাদক সেবনের আসর। প্রায় প্রতিমাসেই হলের বিভিন্ন রুম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ৫/৬টি মোবাইল ফোন। এছাড়া একাধিক ল্যাপটপ চুরির ঘটনাও ঘটেছে। হলের মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীরা মাদকের পেছেন অর্থের যোগান দিতে চুরির পন্থা অবলম্বন করছেন বলে অভিযোগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের। মাদকাসক্ত টিম দেখাশোনা করেন ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগের কর্মী মুরগী চোরখ্যাত এবং সাংবাদিক নির্যাতনকারী সম্রাট, রাজিব, মিশুক, রাহাত, চয়ন, অর্ণব, ফেরদৌস ও মিঠুন।

গত ১১ জুলাই ঘুমের ওষুধ না দেওয়ায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের ছাত্রলীগ কর্মী অর্ণব ওষুধের দোকানে ভাঙচুর এবং দোকানিকে মারধর করেছে। ওই দিন রাত ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট সংলগ্ন মার্কেটের মুনমুন ফার্মেসিতে গিয়ে একপাতা ঘুমের ট্যাবলেট দাবি করে মওলানা ভাসানী হলের ইভটিজিংয়ের দায়ে স্থগিত বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ কর্মী জাহাঙ্গীর আলম অর্ণব। দোকানি সোহাগ ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ঘুমের ওষুধ দিতে অপরাগতা প্রকাশ করায় অর্ণবসহ আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী দোকানের অন্যান্য ওষুধ বাইরে ফেলে দেয় এবং লাথি মেরে কাচ ভাঙচুর করে। তারা দোকানি সোহাগকেও মারধর করে। এ ঘটনায় অন্য দোকানিরা প্রতিবাদ স্বরুপ তাদের দোকান বন্ধ করে দেয়। পরে মওলানা ভাসানী হলের মাদকসেবীদের প্রশ্রয় দানকারী ছাত্রলীগ নেতা আসগর আলী ঘটনাস্থলে এসে প্রান্তিক দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন ও অন্য দোকানিদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং এই মুহুর্তে দোকান না খুললে মারধর করার হুমকি দেয়। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক মো. আরজু মিয়াসহ প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা ঘটস্থলে হাজির হন। তারা দোকানিদের কোনো অভিযোগ না শুনেই দোকান খোলার নির্দেশ দেন।

দোকানি সোহাগ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনাদের কাছে বলেও কোনো বিচার পাবো না। আমাদের আসলে কোনো স্বাধীনতা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কাছে আমরা খুবই অসহায়। ’ ভাসানী হলের ছাত্রলীগ নেতা আসগর আলী প্রান্তিক গিয়ে দোকানীদের বলেন, ‘যদি কেউ দোকান বন্ধ করে তাহলে তার হাত-পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেব। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক আরজু মিয়া দোকানিদের বলেন, ‘আপনারা দোকান খোলেন, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

উল্লেখ্য, ইভটিজিংয়ের দায়ে গত ২২ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বিধিমালার ৪ ও ৫ নং ধারাবলে অর্ণবকে এক বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থগিত বহিষ্কার করে প্রশাসন। এছাড়া তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ভাসানী হলের জুনিয়র ছাত্রলীগ কর্মীরা জানান, অর্ণব মাদকসেবী এবং সে নেশা করার জন্য ঘুমের ওষুধ কিনতে প্রান্তিকে যায়।
 
ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে হলের নতুন শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালান সিনিয়র কর্মীরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বছরের শুরুর দিকে মিরপুর গিয়ে স্থানীয় এক নেতার পক্ষে টোকাই, রিকশাচালক ও দিনমজুরদের সঙ্গে মিছিল করতে বাধ্য করেন হলের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। বছরের মাঝামাঝি সময়ে হল থেকে কিছু ছাত্রকে সাভারের পাশে একটি খোলা ময়দানে নিয়ে যাওয়া হয়। ৩০-৪০ জন লোক লাঠিসোটা নিয়ে তাদের তাড়া করলে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারেন এক লোকের জমি দখল করে দেওয়ার জন্য তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়।
 
সম্প্রতি ঢাকা আরিচা মহাসড়কে চলাচলকারী বাস থেকে অভিনব কায়দায় চাঁদাবাজি শুরু করেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। বাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হেলপার, সুপারভাইজারদের ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনাকে পুঁজি করে চাঁদাবাজি করা হয়। অনেক সময় ছাত্রলীগের জুনিয়র কর্মীদের শিখিয়ে দিয়েও এরকম ঘটনা ঘটানো হয় বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জুনিয়র কর্মী।

গত বছরের ২০ মে ঢাকা যাওয়ার সময় মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্র মাহমুদ আল জামানের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয় আনন্দ সুপার পরিবহনের একটি বাস। এতে তিনি আহত হন। পরে মালিক পক্ষের সঙ্গে ৫০ হাজার টাকায় বিষয়টি সমঝোতা করা হয়। ২৩ মে প্রক্টর অফিসে বাসের মালিকপক্ষের একজন প্রতিনিধি ৪৫ হাজার টাকা মাহমুদের হাতে তুলে দেন। মাহমুদ হলে ফেরার পর ছাত্রলীগের সিনিয়র কর্মী মোল্লা আলমগীর হোসেন অমি ১৮ হাজার টাকা মাহমুদকে দিয়ে বাকি টাকা নিয়ে নেন। পরে সেই টাকা তিনিসহ বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্রলীগ নেতা এসএম শামিম ও হলের ৩/৪জন ছাত্রলীগ কর্মী ভাগাভাগি করে নেন। মাহমুদ বিষয়টির প্রতিবাদ করেন। এছাড়া বিষয়টি ক্যাম্পাসে জানাজানি হলে ছাত্রলীগ কর্মীরা ক্ষিপ্ত হয়ে গত ২৩ জুন রাতে মাহমুদকে মারধর করে হল থেকে বের করে দেন। পরে হল প্রাধ্যক্ষ মাহমুদকে হলে তুলে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও হলের আবাসিক শিক্ষক ও সহকারী প্রক্টর সাব্বির আলম এর সহযোগিতায় হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা তাকে হলে উঠতে দেননি।
 
সম্প্রতি আনন্দ সুপার পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে মীর মশাররফ হোসেন হলের মাজহার নামের এক ছাত্রলীগের কর্মীর ভাড়া নিয়ে ঝামেলার সূত্র ধরে ক্যাম্পাসে বাস আটকানো। সে সময় ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে ঘটনার মীমাংসা করা হয়। পরবর্তী ওই টাকার ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভাজন দেখা দেয়। এরও আগে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক ছাত্রের কাছ থেকে গ্রিনওয়ে পরিবহনের একটি বাসের হেলপার মোবাইল ও টাকা ছিনতাই করেছে অভিযোগ করা হয়। পরে বাস আটকে রেখে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ১৮ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়।
 
এদিকে দলীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান কিংবা পরিকল্পিতভাবে কাউকে মারধরের আগে মাদকথেরাপি ও নৈশভোজের আয়োজন করেন সিনিয়র ছাত্রলীগ কর্মীরা। মাহমুদকে মারধরের আগে ২৩ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইজারা দেওয়া একটি লেকে থেকে অবৈধভাবে প্রায় তিন মণ মাছ ধরে মীর মশাররফ হোসেন হলের ৪৫/৫০ কর্মীকে নৈশভোজ করানো হয়। লেকের ইজারাদার নুরুল ইসলাম জানান, মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা প্রায় তিন মণ মাছ ধরেছে।
 
এদিকে গত বছর অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কাজে লাগিয়ে টাকার বিনিময়ে চেয়ারম্যান ও মেম্বার পদপ্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় জোর করে সাধারণ ছাত্রদের ব্যবহার করেন হলের সিনিয়র কর্মীরা। গত বছর ২৯ জুন অনুষ্ঠিত পাথালিয়া উপজেলা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর সঙ্গে হলের ভোট পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাসে ছাত্রলীগ নেতাদের প্রায় ৫০ হাজার টাকায় সমঝোতা হয় বলে জানা গেছে।

এদিকে সাভার উপজেলার ভাকুর্তা ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের মেম্বার পদপ্রার্থী মো. মানিকের নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ২৫ জুন জনসেবা পরিবহনের একটি বাসে করে প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থীকে ভাকুর্তা নিয়ে যান ছাত্রলীগ কর্মীরা। সেখানে পৌঁছানোর পর একটি বাড়িতে ঘটা করে শিক্ষার্থীদের বিরিয়ানি খাওয়ানোর পর স্থানীয় সমর্থকদের সঙ্গে করে শিক্ষার্থীদের দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো হয়। তবে মীর মশাররফ হোসেন হলের শিক্ষার্থীরা ওই ইউনিয়নের ভোটার নন। ছাত্রলীগ কর্মী লিটন, মইন, শরিফসহ চার/পাঁচ জন এসব প্রচারণায় সাধারণ ছাত্রদের বাধ্য করেছেন বলে জানা গেছে। তবে ছাত্রলীগ কর্মীরা অভিযোগ অস্বীকার করেন।
 
এছাড়া চাঁদার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংস্কারকাজও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের চলা সংস্কার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ১৩ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ টাকার বরাদ্দের সংস্কার কাজ এখন বন্ধ আছে। মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের দাবি ক্যাম্পাসের আদু ভাই ছাত্রলীগের কথিত নেতা আসগর আলী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স নয়ারহাট ট্রেডার্সের কাছ থেকে ২৬ হাজার চাঁদা নিয়েছেন। ফলে এই হলের বঞ্চিত নেতা-কর্মীরা কাজ বন্ধ করে দেন। তবে আসগর আলী পাল্টা অভিযোগ করে দাবি করেন, মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ কর্মীরাই চাঁদার দাবিতে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। চাঁদার দাবিতে বটতলায় এক খাবার দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কামাল উদ্দিন হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা বাবুল ও মোস্তাফিজের নেতৃত্বে ১৫ হাজার টাকা দাবি করে দোকান বন্ধ করে দেওয়ার জন্য হুমকি দেয়।
 
এব্যাপারে ছাত্রলীগ জাবি শাখার সভাপতি রাশেদুল ইসলাম শাফিন বলেন, ক্যাম্পাসে অবস্থাররত ছাত্রলীগের নামধারী কিছু সন্ত্রাসী এসব অপকর্ম করছে। তিনি এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
 
এসব বিষয়ে একাধিক অভিযোগ থাকলেও বিষয়টির খোঁজ নেওয়া হচ্ছে বলেই দায় এড়িয়ে যান হলের প্রাধ্যক্ষ ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক আরজু মিয়া বলেন, নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।

লেখকবৃন্দ: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৮ ঘণ্টা, মে ০২, ২০১২

সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

rana@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।