জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি থমথমে। উপাচার্যপন্থী ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাসে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৩ সালে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা মুখে কাপড় বেঁধে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট ও শিক্ষক ক্লাবে ঢুকে ভাঙচুর ও শিক্ষকদের ওপর বর্বর হামলা চালিয়েছিল। ছাত্রলীগ হামলা চালাবার কেবলই আগে, ক্যাম্পাসের বিদ্যুৎ চলে গেছে বা বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হামলার আগে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ক্যাম্পাসে মোতায়েন করা পুলিশ। এ থেকে ছাত্রলীগের এই হামলার সাথে প্রশাসনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সহজেই বোঝা যায়। আক্রান্ত-আহত শিক্ষার্থীরা চিৎকার করে ক্যাম্পাসের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রক্টরের সাহায্য চেয়েছেন। কিন্তু প্রক্টর তার মাইক্রোবাসে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হামলার দৃশ্য উপভোগ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি ‘এক হাতে তালি বাজে না, নিশ্চয়ই কোনো উস্কানি ছিল’ বলে হামলায় নির্যাতীত সংস্কৃতিকর্মীদেরই এর জন্য দায়ী করেছেন। হামলার সময় উপাচার্যপন্থী কয়েকজন শিক্ষক ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সাহায্য করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। হামলার ব্যাপারে যথারীতি থানা-পুলিশ কোনো মামলা নিতে চায়নি।
জাবি’র বর্তমান উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের ৩টা খুঁটি আছে। প্রথমত, তিনি ‘পিওর’ আওয়ামী লীগার। সম্ভবত তার আগে নিয়োগপ্রাপ্ত খুব কম উপাচার্যই, তার মতো সক্রিয় ও বিশ্বস্ত আওয়ামী লীগার ও সাবেক ছাত্রলীগার ছিলেন। দ্বিতীয়ত, তার বাড়ি গোপালগঞ্জে। তৃতীয়ত, তিনি বর্তমান সরকারের শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা, জাবির সাবেক উপাচার্য ড. আলাউদ্দিন আহমেদের বিশেষ ‘অনুগামী’। আলাউদ্দিন আহমেদ যখন জাবি’র উপাচার্য ছিলেন, তখন বর্তমান উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির ছিলেন কোষাধ্যক্ষ। উল্লেখিত এই তিন খুঁটির জোরে তিনি ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছেন ভিসি শরীফ এনামুল!
২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত শরীফ এনামুল কবির তার আমলে প্রায় দুই শ’ শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। এটা একটা রেকর্ড বটে!
আন্দোলনকারী শিক্ষকদের অভিযোগ, অনেক বিভাগে প্রয়োজন না থাকলেও, নিজের অবস্থান সংহত করার উদ্দেশে ভোটার বাড়াতে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতা বিবেচনা করা হয়নি, বিবেচনা করা হয়েছে কেবল উপাচার্যের প্রতি আনুগত্যকেই। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকা-ে লিপ্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত কেউ কেউ নিয়োগ পেয়েছেন শুধুমাত্র উপাচার্যের প্রতি আনুগত্যের কারণে। উপাচার্যের পক্ষ অবলম্বন করবেন না শুধুমাত্র এই ধারণা থেকে মেধাবী ও যোগ্যতর অনেককে নেওয়া হয়নি। এমনকি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও উঠেছে।
ব্যক্তিগত ক্ষমতা পোক্ত করতে গিয়ে শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি, নানা কায়দায় উচ্চাভিলাষী ও আপোষকামী শিক্ষকদের নিজ গ্রুপে ভিড়িয়েছেন। শুধু ভোট বাড়াতে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের আগের দিনও কয়েকজনকে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ আছে। আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারী শিক্ষকদের দ্বারা নিয়োগপ্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হলেও রণেভঙ্গ দেননি শরীফ। নিজ বাসভবনেই নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। দুই বছরের কিছু বেশি সময়ে শুধু শিক্ষক নয়, কর্মচারী-কর্মকর্তাও নিয়োগ দিয়েছেন ইচ্ছে মতো। এসব নিয়োগের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশই কেবল ক্ষুণœ হয়নি, একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বিরাট আর্থিক বোঝা চেপে বসেছে।
অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, ক্ষমতার অপব্যবহার আর স্বেচ্চাচারিতা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে। নিজের অবস্থান সংহত করতে উপাচার্য জামাতী শিক্ষকদেরকেও নিজের গ্রুপে যুক্ত করেছেন বলে অভিযোগ আছে। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশে ক্যাম্পাসের শত শত গাছ নির্দয়ভাবে কেটে ফেলেছেন। কোনো প্রতিবাদ যাতে হতে না পারে, তার জন্য গাছ কাটার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির সময়টাকে বেছে নেওয়া হয়। ব্যবসায়িক উদ্দেশে ক্যাম্পাসের জায়গা-লেক লিজ দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসে এখন ব্যবসায়িকভাবে হলুদের চাষ হচ্ছে। ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছেন তিনি। তার এই খেলার শিকার হয়ে অতিথি পাখি আর আগের মতো ক্যাম্পাসে আসছে না।
উপাচার্যের বর্তমান বিত্ত-বৈভবের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কয়েকটি গাড়ির মালিক উপাচার্যের একটা গাড়িরই দাম প্রায় কোটি টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা গাড়ীর তেলের যে বিল করেছেন, সেই তেলের হিসাব অনুযায়ী সেই গাড়িকে প্রতিদিন (ছুটির দিনসহ) গড়ে কমপক্ষে ৩০০ কি.মি. চলতে হয়েছে। এই ঘটনা থেকেই বর্তমান উপাচার্যের শাসনামলের দুর্নীতি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান দাম্ভিক উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। মুক্তমঞ্চ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভাড়ার পদ্ধতি চালু করেন তিনি। তার শাসনামলে কোনো ছাত্র কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে অতিথি-বক্তার নাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রশাসনের অনুমতি গ্রহণ করতে হয়। রাত ১১ টায় ছাত্রদের হলগেট বন্ধ করার ফতোয়া দিয়েছেন তিনি। ছাত্রদের বাস ও রুটের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন। ডাইনিং চিরতরে বন্ধ করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।
মিডিয়াকে একদমই পছন্দ নয় তার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকদের সংগঠন ‘সাংবাদিক সমিতি’ দীর্ঘদিন ধরে ক্রিয়াশীল আছে। কিন্তু উপাচার্য সাংবাদিক সমিতিকে পকেটবন্দী করতে ব্যর্থ হয়ে, অনুগত কয়েকজন সাংবাদিককে দিয়ে আলাদা করে প্রেসক্লাব গঠন করেছেন। গালাগালি করে অফিস থেকে সাংবাদিকদের অনেকবার বের করে দিয়েছেন। আর এখন হলগুলো থেকে পত্রিকা উধাও করে দিয়েছেন!
বর্তমান উপাচার্যের সময়ে ছাত্রলীগ অনেক বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। নিজেদের মধ্যে মারামারি করে বেশ কয়েকবার পত্রিকার প্রথম পাতায় ঠাঁই পেয়েছে তারা। ৪ তলা ভবনের ছাদ থেকে বিরোধী গ্রুপের কর্মীকে নিচে ফেলে দেওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলাকালে মুক্তমঞ্চে হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, যৌন নিপীড়ন বেড়েছে। যৌন নিপীড়নের অভিযোগের খাতায় উপাচার্যগ্রুপের কোনো কোনো শিক্ষকেরও নাম উঠেছে। একজন শিক্ষিকা একই বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেছিলেন। যে শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগেই যৌন নিপীড়নের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং জালিয়াতির মামলা ছিল। তার নিয়োগের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমেছিলেন। এই অনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত শিক্ষককে রক্ষা করলেন উপাচার্য, আর নিপীড়িত শিক্ষিকা নানাভাবে নাজেহাল হলেন! বর্তমান প্রশাসনের একজন সাবেক প্রক্টর শিক্ষক সমিতির সভায় প্রকাশ্যে শিক্ষক সমিতির সভাপতিকে মারধর করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ছাত্রলীগের সংহিতায় ৯ জানুয়ারি খুন হয় জুবায়ের নামে ইংরেজি বিভাগের এক ছাত্র। অভিযোগ আছে, উপাচার্যের মদদেই এই খুনের ঘটনা ঘটেছে। জুবায়ের ছাত্রলীগের যে গ্রুপের কর্মী ছিলেন, সেই গ্রুপকে উপাচার্য পছন্দ করেন না। তাই এই গ্রুপকে তিনি ক্যাম্পাস ছাড়া করেছিলেন। জুবায়েরকেও ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়েছিল। যেদিন তিনি উপাচার্যপন্থী ছাত্রলীগের দ্বারা আক্রান্ত হন, সেদিন তিনি ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে ক্যাম্পাসে এসেছিলেন পরীক্ষা দিতে। উপাচার্য এখনও জুবায়েরের খুনীদের রক্ষা করে চলেছেন বলে অভিযোগ আছে। খুনের আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেও, উপাচার্যের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা ক্যাম্পাসে অবাধে বিচরণ করছে। মামলা থেকে আসামিদের ছাড়ানোর জন্যও উপাচার্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আলোচিত জুবায়ের হত্যাকা-ের পর জাবি’র প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিক্ষকদের একাংশ ক্যাম্পাসে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হয়। পরবর্তীতে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা আন্দোলনকে উপাচার্যের পদত্যাগের আন্দোলনে পরিণত করেন। শিক্ষকদের ধর্মঘটের কারণে ক্যাম্পাস কার্যত অচল হয়ে পড়ে। উপাচার্য তার অনুগত শিক্ষকদের আন্দোলনকারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নামিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন। নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন আন্দোলনের কাছে। গ্রীষ্মকালীন ছুটি এক মাস এগিয়ে এনে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করেন। কিন্তু আন্দোলনরত শিক্ষকরা ছাড়া, ছাত্ররাও দৃঢ়ভাবে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন। আন্দোলনকারীদের ‘ডা-া মেরে ঠা-া’ করতে মাঠে নেমে পড়ে ছাত্রলীগের উপাচার্যপন্থীগ্রুপের সন্ত্রাসীরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক বেশ কিছুদিন আগে সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগের নানা গ্রুপ আছে। কিন্তু কখনো কি কেউ উপাচার্য গ্রুপের কথা শুনেছেন?’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির আসলে জাবি’র ছাত্রলীগ দখল করে ফেলেছেন। ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগের সব গ্রুপকে হটিয়ে দিয়ে একটা মাত্র গ্রুপকেই অস্তিত্ত্বশীল রেখেছেন তিনি, আর সেই গ্রুপের নাম উপাচার্যপন্থী গ্রুপ বা ভিসি গ্রুপ বা ভিসি লীগ। ‘সরকারের পেটোয়া বাহিনী’ কথাটা শুনতে আমরা অভ্যস্ত। এখন শুনছি ‘উপাচার্যের পেটোয়া বাহিনী’!
উপাচার্য মহোদয় সদম্ভেই বলেছেন, রাষ্ট্রপতি তাকে নিয়োগ দিয়েছেন, গুটিকয়েক ‘ষড়যন্ত্রকারী’ শিক্ষকের দাবি মেনে তিনি পদত্যাগ করবেন না। রাষ্ট্রপতি বললেই কেবল তিনি পদত্যাগ করবেন। উপাচার্যের এই কথার মধ্যে তার পতনের পদধ্বনি শোনা যায়। সচেতন মানুষ ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বের’ সাথে পরিচিত। সব কালেই স্বৈরশাসকরা পতনের আগে আন্দোলনকারীদের ‘ষড়যন্ত্রকারী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং নিজের ‘খুঁটির’ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনে সরকার কী উদ্যোগ নিয়েছেন, দেশবাসী জানে না। সরকার স্বেচ্ছায় কোনোদিনই কোনো উদ্যোগ নেয় না, শেষমেষ উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়। বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন অচল থাকার পর, গত ৩০ এপ্রিল শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘প্রয়োজনে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সরকার আইনি পদক্ষেপ নেবে। ’ এই ভাষা স্বৈরাচারের ভাষা। এভাবে হুমকি দিয়ে কোনো কালে কোনো আন্দোলন দমন করা যায়নি।
সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীদের শিবির কর্মী এবং উপাচার্যবিরোধী চলমান আন্দোলনকে ‘শিবিরের ক্যাম্পাস দখলের ষড়যন্ত্র’ বলে ছাত্র লীগ আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু ছাত্রলীগের হয়তো মনে নেই, কিন্তু অনেকেরই ঠিক মনে আছে। বেশ কিছুদিন আগে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দু’ গ্রুপের মধ্যে তুমুল মারামারি হয়েছিল। তখন উপাচার্য ‘ছাত্রলীগের মুখপত্রের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যা বলেছিলেন, তাতে নিজ দলের মধ্যেই তিনি দারুণভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এটা শিবিরের কাজ। ছাত্রলীগের মধ্যে শিবির ঢুকে পড়ে এসব সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে।
আজকে যে শিক্ষকরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছেন, তাদের সবাই অভিযোগমুক্ত নন। তাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যারা অতীতে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং প্রশাসনের ভাগ-বাটোয়ারার সাথে যুক্ত ছিলেন। আবার কেউ কেউ ভবিষ্যতের ভাগ-বাটোয়ারায় নিজের অবস্থান সংহত করতে, উপাচার্যের পদত্যাগের আন্দোলন করছেন। এমন কেউ কেউ আছেন, যারা নৈতিক অবস্থান থেকে নয়, সংকীর্ণ অবস্থান থেকেই উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন করছেন।
তাই উপাচার্য পদত্যাগ করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। বর্তমান উপাচার্য সরে গেলে নতুন যে উপাচার্য আসবেন, তিনি যে স্বেচ্চাচারী, দুর্নীতিবাজ, নিপীড়ক, সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষক হবেন না তার কি নিশ্চয়তা আছে? তাই সমস্যার মূলে আঘাত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সিস্টেমকে বদলে ফেলতে হবে। দুষ্টচক্র থেকে উদ্ধার করতে হবে শিক্ষক রাজনীতিকে। আর সেই কাজের জন্যই দুর্নীতিবাজ, স্বেচ্চাচারী, সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষক উপাচার্যকে সরে যেতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সংজ্ঞা, একটা ধারণা আছে। সেই সংজ্ঞা, ধারণা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমশই সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব, অনিয়ম, দুর্নীতি, অগণতান্ত্রিকতার আখড়ায় পরিণত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংসের যে চক্রান্ত চলছে, তাকে চ্যালেঞ্জ করে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকৃতপক্ষে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে, মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত নয়, সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্বায়ত্ত্বশাসনের’ লাটাই প্রকৃতপক্ষে সরকারের হাতেই। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এখন ছাত্রদের নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক পরিচালিত প্রশাসন নিপীড়কের ভূমিকা পালন করে এবং এই ভূমিকা ক্রমশই বাড়ছে। ফলে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। ৭৩-এর অ্যাক্ট অনুযায়ী, ভিসি নির্বাচনে ৩ জনের প্যানেল নির্বাচন করা হয়। তার মধ্যে সরকার যাকে বেশি অনুগত মনে করে, তাকেই নিয়োগ দেওয়া হয়। অর্থাৎ নির্বাচিত হওয়াই শেষ কথা নয়, নিয়োগ পাওয়ার জন্য সরকারের কাছে মাথা নোয়াবার প্রতিযোগিতা চলে নির্বাচিত ৩ জনের মধ্যে।
বাংলাদেশে এখন কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই নির্বাচিত উপাচার্য নেই। অনির্বাচিত উপাচার্য তথা প্রশাসন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করার এই নতুন ধারা বর্তমানে তৈরি হয়েছে। এতে সরকারের অনেক সুবিধা হয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করতে। প্রশাসনের কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকে না। অনির্বাচিত উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের তোয়াক্কা না করে, সরকারের করুণা নিয়ে টিকে থাকতে চান। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটা খারাপ চর্চা চালু হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কায়েম হচ্ছে স্বৈরতন্ত্র। কোন উপাচার্যই এখন আর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারছেন না। সরকারের মেয়াদের শেষের দিকে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠা একটা নিয়মিত স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে আলোচনা উঠলে, কিছু প্রশ্ন ঘুরপাঁক খায়। উপাচার্য কি শাসক না অভিভাবক? বর্তমানে কতোজন উপাচার্য ‘উপাচার্য সুলভ’ আচরণ করেন? সত্যিই যদি ‘উপাচার্য’ হবেন, তবে কেন তারা ‘অনির্বাচিত’ থেকে যেতে চান? কেন তারা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে চান? কেন তারা ‘দায়িত্বকে’ ‘ক্ষমতা’ হিসেবে দেখেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের কতজন শিক্ষক-অধ্যাপক নিজের ‘শিক্ষক’ অবস্থানের প্রতি সুবিচার করেন?
মেধা ও যোগ্যতাহীন যেসব ব্যক্তি শুধুমাত্র দল ও উপাচার্যের প্রতি আনুগত্যের কারণে এবং ঘুষ দিয়ে (শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক লেন-দেনের অভিযোগ আছে) শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে কোথায় নিয়ে যাবেন? এভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যেই কেউ হয়তো আগামী দিনে বিশ্বদ্যিালয়ের বড়ো কোনো দায়িত্ব পাবেন, এমনকি লংবি-গ্রুপিং-এ দক্ষ হলে উপাচার্যও হয়ে যেতে পারেন! বর্তমানের শিক্ষক-প্রশাসকদেরও অনেকেরই নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ছিল না। অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার মতো যথেষ্ট যোগ্য ও মেধাবী ছিলেন না। গোড়ায় গলদ থাকার এই প্রক্রিয়া চলছে এবং তা ক্রমবর্ধমান।
গত ১ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে উপাচার্য মহোদয় দৃঢ়ভাবেই বলেছিলেন, কয়েকজন শিক্ষকের কথায় তিনি চলে যাবেন না। ছাত্ররা চাইলেই তিনি পদত্যাগ করবেন। ছাত্রদের মতামত জানতে প্রয়োজনে ক্যাম্পাসে ‘মতামত বাক্স’ স্থাপনের কথাও বলেছিলেন তিনি। উপাচার্যের জন্য দুঃখজনক যে, ছাত্ররাও (ছাত্রলীগের ভিসি গ্রুপ ছাড়া) এখন তার পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার। তারা শ্লোগান তুলেছেন, ‘যে ভিসি ছাত্র মারে, সেই ভিসি চাই না’, ‘যে ভিসি দুর্নীতি করে, সেই ভিসি চাই না’। আন্দোলনকারী শিক্ষকদের গড়া ‘উপাচার্য প্রত্যাখ্যান মঞ্চ’ পরিণত হয়েছে ‘ছাত্র-শিক্ষক সংহতি মঞ্চে’। পূর্বঘোষণা অনুযাযী কয়েকজন শিক্ষার্থী আমরণ অনশন শুরু করেছেন। তাদের প্রতি সংহতি জানাতে ঢাকা থেকে অনেকেই ছুটে যাচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। অন্যদিকে প্রশাসন ভীতির পরিবেশ তৈরি করতে সাংস্কৃতিক কর্মীদের নামের তালিকা করছে। মনে পড়ে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে রেপ লিস্ট, শুট লিস্ট, হিট লিস্ট করেছিল!
ক্যাম্পাসের গ-ি পেরিয়ে আন্দোলনের ঢেউ ঢাকাতেও এসে পড়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও তার পদত্যাগের দাবিতে ঢাকায় নানা কর্মসূচি পালন করছেন। উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ শিক্ষকরা তার কাছে থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেছেন। উপাচার্য গ্রুপের একজন প্রভাবশালী ডিন (সাবেক উপাচার্যও তিনি!) এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন। উপাচার্যগ্রুপের স্টিয়ারিং কমিটির ৩ জন পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে, পরবর্তীতে আরো কয়েকজন উপাচার্যের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন।
উপাচার্য মহোদয় এখন কী করবেন? পদত্যাগ করা ছাড়া তার সামনে আর কোনো পথ খোলা আছে! বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অস্থিরতা ও অচলবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা কাটাতে তাকেই উদ্যোগী হতে হবে। ক্ষমতার মোহ তাকে ত্যাগ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর স্বার্থে তাকে চলে যেতেই হবে।
লেখক : রাজনীতিক। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ সময় ১৫২৮ ঘণ্টা, মে ০২, ২০১২
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ