শুরুটা প্রশ্ন দিয়েই করি। ‘সাম্প্রতিক সময়ের টেলিভিশন রিপোর্টিং: কিছু প্রশ্ন’।
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে মুক্তমতে সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার লেখার জবাব দিয়েছেন তারই শিষ্য সময় টেলিভিশনের ফেনী ব্যুরো ইনচার্জ বখতেয়ার মুন্না। দু’টো লেখাই পড়েছি। যদি ভুল না হয়; আমার যতটুকু মনে পড়ে সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা টেলিভিশনে সাংবাদিকতা শুরু করার আগে প্রিন্ট মিডিয়াতে কাজ করেছেন। অর্থাৎ প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক এ দু’টো মিডিয়াতে সাংবাদিকতা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে কাজ করার কারণে সম্ভবত প্রশ্নটি টেলিভিশন রিপোর্টিং নিয়েই করেছেন।
ইতিমধ্যে সাংবাদিকতা পেশায় যাদের দু’যুগ হয়েছে তাদেরকে একটু পেছনে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কারণ পেছনের দিকে ফিরে না তাকালে বর্তমান সময়ে সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা যে প্রশ্ন করেছেন তার সঠিক জবাব পাওয়া দূরহ হয়ে পড়বে। নব্বইয়ের পট পরিবর্তনের আগের ও পরের চিত্র নিশ্চই সে সময় যারা রিপোর্টিং করেছেন তাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
১৯৯০ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সাংবাদিকরা ধর্মঘট শুরু করলে সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। এরশাদ তার তথ্যমন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সংবাদপত্রের মালিকদের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যেকোনভাবেই পত্রিকা প্রকাশ করাতে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিকদের কাছে মালিকদেরও মাথা নত করতে হয়েছিলো। এমনকি এরশাদের দৈনিক জনতা পত্রিকাও সেসময় সাংবাদিকদের দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে প্রকাশনা বন্ধ রাখে।
এখন একবার ভাবুনতো ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক আন্দোলনের কথা। নব্বইয়ের পট পরিবর্তনের পর সাংবাদিক ইউনিয়ন দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরপর থেকে দাবি দাওয়ার প্রশ্নে তো তারা এক হতেই পারে না। উল্টো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেলে দেখা যায় সাংবাদিকতার আদর্শের চেয়েও দলীয় আদর্শ থেকে তারা তাড়িত হন। অবশ্য গেল ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাজধানীর রাজাবাজারে ফ্ল্যাট বাড়িতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকা-ের পর সাংবাদিকদের বিভক্ত দু’টি ধারা এক মঞ্চে বসে আন্দোলন শুরু করে। তবে এখনো তারা পূর্বাবস্থায় অর্থাৎ নব্বই পূর্ববর্তী ঐক্যবদ্ধ ধারায় ফিরে যায়নি।
সাংবাদিক সম্মেলন, প্রেস ব্রিফিং, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, জনসভা-পথসভা, আলোচনা সভা, গোলটেবিল বৈঠক কিংবা যে কোন ধরণের ঘটনা-দুর্ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করার দায়িত্ব রিপোর্টারদের। অফিস অ্যাসাইনমেন্ট দেয় এসব অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহের জন্য। আসল কথায় আসি, হয়তো এ লেখা অনেকের নিকট পীড়াদায়ক মনে হতে পারে। তাছাড়া মনে মনে অথবা প্রকাশ্যে আমাকে গালমন্দও করতে পারেন। তাতে কোনো ক্ষতি নেই। সত্য কথাটা কাউকে না কাউকে মুখ খুলে বলতে হবে। আর সে কথাটি বলতে পারছি এটিই বড় কথা।
নির্বাচন মানেই ভোটাধিকার প্রয়োগ করা। নির্বাচন হলেও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হয় বিভিন্ন পেশার লোকদের। এদের মধ্যে সাংবাদিক সমাজও রয়েছে। যে কোন রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন থাকতেই পারে, আর থাকাটাও স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে নিরপেক্ষ হলেও কেন্দ্রে গিয়ে যে কোন একজন প্রার্থীকে তো ভোট দিতেই হয়। তাই বলে কি দলীয় মতাদর্শের সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নিজেদের পেশাকে জলাঞ্জলি দিয়ে রাজনৈতিক দলের সাথে লেপ্টে থাকতেই হবে? অথচ এমনটি প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান হচ্ছে।
যা বলছিলাম সংবাদ সংগ্রহের জন্য রিপোর্টাররা ঠিকই যান। তবে পেশাগত দিকের পরিবর্তে দলের সমর্থক এমন রিপোর্টারদের উপস্থিতি অনুষ্ঠানে থাকবেই। আর তারা প্রশ্ন করেন সেদিকটি চিন্তা করে। তারপরও পেশাগত দিকটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রশ্ন করার মত এখনো অনেক রিপোর্টার আছেন। কিন্তু প্রশ্ন করার সুযোগ চাপা পড়ে যায় পেশাগত দিকটির উর্ধ্বে উঠে রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হওয়া সাংবাদিকদের কৌশলী প্রশ্নের তোড়ে।
অনুষ্ঠানগুলোতে মাঝে মধ্যে দু’একটি প্রশ্ন করার সুযোগ পাওয়া গেলেও জবাব পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কেননা প্রশ্নকর্তা রিপোর্টার অপরাধ করেছেন তার প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত দলটির সমর্থক রিপোর্টাররা এমনভাবে একের পর এক প্রশ্ন করেন যাতে অনুষ্ঠানের আয়োজকরা যা বলতে চেয়েছিলেন তাদের জবাবের মাধ্যমে তাই বলা হয়ে যায়। তাছাড়া প্রশ্ন করে যদি হিতে বিপরীত হয় এমন আশংকা যে নেই তা হলফ করে কেউ বলতে পারবেন না।
এ ব্যাপারে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক খোন্দকার মোহাম্মদ খালেদের একটি কথা না বললেই নয়। তিনি সব সময় রিপোর্টারদের একটি কথা স্মরণ করিয়ে দেন, পাশাপাশি কথাটি মনে রেখে রিপোর্ট লেখার জন্য সব সময় উপদেশও দেন। সেটি হচ্ছে- অ্যাসাইনমেন্টে যা বলা হবে কিংবা যে কোন ঘটনার যা কিছু থাকবে তার কোন কিছুই যেন রিপোর্ট লেখার সময় বাদ না যায়। কারণ সবকিছুই বার্তা সম্পাদকের নজরে থাকতে হবে। রিপোর্ট হুবহু ছাপা হবে, কতটুকু বাদ যাবে কিংবা নতুন কিছু সংযুক্ত করা হবে কিনা সে দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের নয়। এর পুরো দায়িত্বভার বার্তা সম্পাদকের। তাছাড়াও তিনি যে কোন বিষয়ে রিপোর্ট লেখার সময় পত্রিকার নিজস্ব গাইড লাইন অনুসরণ করারও পরামর্শ দেন।
উদ্দেশ্য যদি দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি হয় এবং নেতাকে তোষামোদ করা তাহলে প্রশ্ন কীভাবে করবেন? ঘটনার পেছনের ঘটনা বের করতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা কর্তৃপক্ষ বা রাজনীতিবিদদের সূঁচালো প্রশ্ন করেন না। এরপরও প্রিন্ট মিডিয়াতে কোন না কোনভাবে ঘটনার পেছনের খবর চলে আসে। আবার প্রিন্ট মিডিয়াতে উল্টোটি দেখা যায় যে রিপোর্টার নিজে থেকেই ঘটনার রিপোর্ট লেখার আগেই সেন্সর করে ফেলেন। আর এতে করে ঘটনার পেছনের ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক ইত্তেফাক
বাংলাদেশ সময় ২২২০ ঘণ্টা, মে ০২, ২০১২
এমএমকে