কাকতালীয়ভাবে দু’জন প্রভাবশালী ব্যক্তির ঢাকা সফর প্রায় একসঙ্গে, পাশাপাশি হয়ে গেল! এরা হলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন আর ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। বাংলাদেশের নানা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও এদুটি দেশকে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখা হয়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সময়ে যে ঢাকা এসেছেন, এটিই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে পজিটিভ দিক। হিলারির স্বামী বিল ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর নানা কারণে প্রায় ভন্ডুল হতে বসেছিল! জঙ্গী হামলার আতংকে সাভারে তার জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাওয়া সহ নানা কর্মসূচি বাতিল করা হয়। এমনকি নয়াদিল্লি থেকে রওয়ানা হওয়ার পরও মার্কিন সিক্রেট সার্ভিসের গোয়েন্দারা ‘গো ব্যাক, গো ব্যাক’ বলে তাকে ফেরত পাঠাতে চেয়েছিল! সে পরিস্থিতিতে এয়ারফোর্স ওয়ান এড়িয়ে ছোট একটি বিমানে ঢাকা এসে বাংলাদেশের মুখরক্ষা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন! এমনকি তার সফরসঙ্গী মেয়ে চেলসি’কেও ঢাকা আনেননি। হিলারি’র সফর নিয়ে সে রকম কিছু ঘটেনি। কিন্তু পুরো সফর পরিকল্পনা যে মার্কিনিদের সাজানো তা ঢের বোঝা গেছে। ক্লিনটনের মতোই এ সফরেও জাতীয় স্মৃতিসৌধ বা বঙ্গবন্ধু জাদুঘর’কে অন্তর্ভূক্ত রাখা হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধে নেয়াই যাচ্ছে না! হিলারি এত কথা বললেন, কিন্তু বাংলাদেশ জঙ্গি কলঙ্কমুক্ত—সরকারের এ দাবির সমর্থনে একটাও শব্দ বললেন না! সরকারের জন্যে শুধু এই একটিমাত্র না, আরও অনেকগুলো ধাক্কা এই সফরে এসেছে।
যেমন সরকারের জন্য খুব বাজে একটি সময়ে হিলারি এসেছেন। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ঘটনায় সরকার নাজুক অবস্থায় আছে। ঢাকা পৌঁছে একঘন্টা বিমানে বসে থেকে সম্ভবত তিনি হালের বাংলাদেশ সম্পর্কিত ব্রিফিংটি নেন। সে কারণে ইলিয়াসের মেয়েকে তিনি বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। আর ইলিয়াসের মেয়ের নামে মানবিক একটি পত্র লিখিয়ে গেমটি ভালোই খেলেছে বিএনপি! ইদানিং নানা কিছুতে তাদের পেপারওয়ার্কও খুব ভালো হচ্ছে। সরকারের লোকজন এত বেশি পণ্ডিত অথবা পণ্ডিতন্মন্য অথবা নিজেদের কাজে নিজেরা এত বেশি সন্তুষ্ট যে, এসব নিয়ে আজকাল খুব একটা ভাবেন বলেও মনে হয় না! অসন্তুষ্ট মানুষ নতুন কিছু করার জন্য ভাবে। কেউ নিজে নিজে সন্তুষ্ট হয়ে ঘুমিয়ে থাকলে তাদের জাগানো কঠিন। হিলারির সফরে সরকারের জন্য নেগেটিভ অনেক কিছুই উঠে এসেছে। সব দলকে নিয়ে নির্বাচনের জন্য সংলাপের তাগিদ দিয়েছেন হিলারি। বিএনপির সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু নিয়ে সংলাপ চায় না সরকারিদল। তারা তাদের বলেছে সংসদে প্রস্তাব নিয়ে যেতে। বিএনপি সংসদে নিজেদের অবস্থা কী সেটা ভালো করেই জানে। সেখানে কোনো প্রস্তাব নিয়ে গেলেই তা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে খারিজ করে দেবে আওয়ামী লীগ। অতএব বিএনপি সে পথে যাবে না। হিলারির সংলাপ প্রস্তাবেরও তাই দ্রুত বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
ইলিয়াসের পাশাপাশি গার্মেন্ট শ্রমিকনেতা আমিনুলের প্রসঙ্গ নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছেন হিলারি। সাভারের পোশাকশ্রমিকদের এই নেতা নিখোঁজ হবার পর তার লাশ বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন করা হয়। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশের স্বপ্ন দেখা হচ্ছিল, সেখানে হিলারি বলেছেন আমিনুল হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত না হলে বিদেশের বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমন একটি বক্তব্য আসার পর তার কাছে কী আর শুল্কমুক্ত আবদার রাখার পরিবেশ থাকে? গার্মেন্ট শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করাতে মোশরেফা মিশু সহ অনেকে গ্রেফতার, নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। খুন হয়ে গেছেন আমিনুল। সুশাসন যেখানে নির্বাসনে সেখানে হিলারির সঙ্গে শেখ হাসিনা-দীপু মনির খুশি খুশি ভাব নিয়ে তোলা ছবি ছাড়া আর কী পেয়েছে বাংলাদেশ? ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় ফজলে হাসান আবেদ, ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর আবার সরকারকে এক হাত নিয়েছেন হিলারি! সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গ্রামীণব্যাংকে যেন হাত দেয়া না হয়! গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে তার সফরের কোথাও একটি শব্দও উল্লেখ করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরীকে ফেরত দেবার কথাও নেই! এত নেই এর মধ্যে তাহলে সরকার আর সরকারিদল হিলারির সফর থেকে কী পেয়েছে?
অন্যদিকে হিলারি-প্রণব এদুজনের সফরে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রকাশ পেয়েছে বিএনপির! খালেদা জিয়া বক্তৃতায় একটা কথা প্রায়ই বলেন, ‘‘বিদেশে আমাদের প্রভু নেই বন্ধু আছে!’’ তা এই দুই সফর নিয়ে কী করেছে বিএনপি? বিদেশে যখন গিয়ে কেউ রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়, তখন তারা দেশের বিরুদ্ধে হেন খারাপ কথা নেই, যা বলে না। হিলারি-প্রণবকে এমন দেশ সম্পর্কে চূড়ান্ত খারাপ যা যা বলা সম্ভব সব বলেছে বিএনপি! এমনকি তত্ত্বাবধায়কের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রণব বাবু তথা ভারতের সহায়তা চেয়েছেন! ভোট হবে বাংলাদেশে, ভোট দেবে দেশের মানুষ, আর তা সুষ্ঠু করে দেবেন হিলারি-প্রণব? এগুলাকে বন্ধুত্ব না গোলামি বলে? বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের এসব দেউলিয়াপনার খবর বিদেশিরা বিলকুল জানে। এসবের একটু বেশি জানেন পাশের দেশের প্রণব মুখার্জি। সরেজমিন সব দেখে-জেনে গেলেন হিলারি ক্লিনটন! তিস্তা চুক্তি-টিপাই মুখ বাঁধ নিয়ে প্রণবের মন্তব্য বাংলাদেশের জন্য হতাশাব্যঞ্জক! এসব কারণে এই সফর থেকে বাংলাদেশের জন্য পজিটিভের চেয়ে নেগেটিভের পাল্লাই ভারী।
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
Jewel_mazhar@yahoo.com