মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই মেয়াদের সাবেক ফার্স্টলেডি ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিসেস হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন মাত্র ২০ ঘন্টার সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন গত ৫ মে শেষ বিকালে।
এ সফরের সময় বিএনপির নিখোঁজ সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াছ আলীর ঘটনার চেয়ে বড় ঝাঁকুনি দিয়েছেন গুম ও হত্যাকাণ্ডের শিকার পোশাকশ্রমিক আমিনুল ইসলাম।
সূর্যের আলোতে দু’দিন হলেও বাস্তবে একদিনেরও কম সময় অর্থাৎ ২০ ঘন্টা বাংলাদেশে ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানটি গত ৫ মে বিকাল চারটায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করে। বিমানটি থেমে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই হিলারির নেমে আসার কথা। কিন্তু তিনি বিমান থেকে বের হলের প্রায় ৫০ মিনিট পর। এর আগে বিমানের ভেতরে প্রবেশ করেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা। বিমান থেকে কি কারণে ৫০ মিনিট দেরি করে হিলারির এই নেমে আসা? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব এখনো পাওয়া যায়নি। তবে জবাব পাওয়া না গেলেও বিমানের ভেতের রাষ্ট্রদূত মজিনার প্রবেশই এর জবাব।
রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রীরা সফরে যাওয়ার আগে পরিষ্কার ধারণা নিয়ে যান। এটি প্রতিটি দেশের বেলায় প্রযোজ্য। যে দেশ সফর করা উদ্দেশ্য দূতাবাসের মাধ্যমে আগেই সে দেশের সরকার, বিরোধী দল, রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্য নেতিবাচক হলে সফর অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তবে ইতিবাচক হলে নির্দিষ্ট সময়ে সফর সম্পন্ন হয়। বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিস্তারিত তথ্য জানানোর পরই তিনি যে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই।
কূটনৈতিক সূত্রে যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে তা হলো, বিমানের ভেতরেই হিলারিকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত ধারণা দিয়েছেন। আর বিমান থেকে নামার আগেই হিলারিও সেটি চাইছিলেন বলেই নাকি ৫০ মিনিট বিলম্ব। সূত্রগুলোর মতে, এছাড়া অন্য কোনো কারণ থাকার কথাও নয়। অবশ্য এ তথ্যটি নিয়ে হিলারি ২০ ঘন্টা অবস্থানকালে নিজে মুখ খুলে কিছু বলেননি। আবার আকার ইঙ্গিতেও এমন কোন মন্তব্য করেননি যাতে করে ৫০ মিনিট বিলম্বের কারণটি পরিষ্কার হয়ে যায়।
অপরদিকে রাষ্ট্রদূত মজিনা এ বিষয়ে অর্থাৎ বিমান থেকে ৫০ মিনিট দেরিতে হিলারির নেমে আসা নিয়ে এখন পর্যন্ত টু শব্দটি করনেনি।
হিলারি ক্লিনটের সফর বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক হয়েছে সে প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে। কিন্তু সেজন্য অপেক্ষায় বসে না থেকে বর্তমানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক বা গার্মেন্টশিল্প। পোশাক রফতানিকারক অপরাপর যেসব দেশ রয়েছে তাদের তুলনায় বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে। আর এগিয়ে থাকার অন্যতম কারণটি হচ্ছে শ্রমিকের স্বল্প মজুরি। বাংলাদেশে পোশাকশ্রমিকরা যে মজুরিতে কাজ করেন তা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে আছে কিনা সন্দেহ। শ্রমিকের কম মজুরি গার্মেন্টশিল্পের মালিকদের পোশাক রফতানিতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু যে মালিকরা লাভবান হচ্ছেন তা কিন্তু নয়, সাথে সাথে লাভবান হচ্ছে দেশও। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে।
এসব বিষয় বলার কারণ হচ্ছে, পোশাক শ্রমিক আমিনুল ইসলাম। হিলারি তার সফরের প্রথম যে ম্যাসেজটি দিয়েছেন সেটি হচ্ছে আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন তদন্ত। তিনি আরো বলেছেন, এ ঘটনার তদন্তসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে পোশাক আমদানিকারক দেশগুলোতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দৃশ্যত একটি কথা পরিষ্কার করে বলা যায়, আমিনুল ইসলামের গুম ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বর্তমানে একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারিকে এ ব্যাপারে সরকার আশ্বস্থ করেছে যে, ঘটনার স্বাধীন তদন্ত করা হবে। তদন্তের আগে কয়েকটি কথা না বললেই নয়। পোশাকশ্রমিক আমিনুল ইসলাম কার বা কাদের জন্য ভীতির কারণ হয়ে উঠেছিলেন? দেশ আমিনুলকে কি দিয়েছে, সে প্রশ্নটি বড় নয়। বড় প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি তো পোশাকশ্রমিক হিসাবে দেশকে কিছু না কিছু দিয়েছিলেন। বেঁচে থাকলে আরও অনেক কিছু দিতে পারতেন। আমিনুল ইসলামকে কারা গুম করেছিলো? গুম করার কাজে যারা জড়িত তাদের কারা কি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে? এ ঘটনায় কে বা কারা লাভবান হয়েছে?
বাংলাদেশের একজন পোশাকশ্রমিক আমিনুল ইসলামকে নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্বেগ যে আমাদের জন্য কতটা উদ্বেগের কারণ সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাভাবিক নিয়মে আমাদেরকে মনে রাখতেই হবে এটি একজন হিলারির কথা নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কথা। আমিনুলকে নিয়ে হিলারি যে কথা বলেছেন তার জবাব আজ হোক কাল হোক দিতেই হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কে বা কারা এতো শক্তিশালী যে এ ধরণের একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সামনে বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে? এ জঘন্য ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে বা যারা জড়িত তারা যত বড় আর শক্তিশালীই হোক না কেন শেষ পর্যন্ত কি মুখোশ উন্মোচন করা সম্ভব হবে?
লেখক : সাকির আহমদ, সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক ইত্তেফাক। সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
Jewel_mazhar@yahoo.com