ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

পরিবেশ ভারসাম্য বজায় রেখে সমুদ্রসম্পদ আহরণ করা সম্ভব

আলম শাইন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০২৩
পরিবেশ ভারসাম্য বজায় রেখে সমুদ্রসম্পদ আহরণ করা সম্ভব

‘ব্লু ওশান ইকোনমি’ হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিশাল একটি সম্ভাবনাময় জোন। শুধু বাংলাদেশই নয়, সমুদ্রতীরবর্তী দেশগুলোর জন্য প্রকৃতির বিশেষ একটি অবদান বলা যায় ‘ব্লু ওশান ইকোনমি’।

সমুদ্র বিজয়ের পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা আয়তনে বৃদ্ধি পেয়ে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার দাঁড়িয়েছে। যে সীমানা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিশেষ একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজে দিচ্ছে। যা ‘ব্লু ওশান ইকোনমি’ (নীল সমুদ্র অর্থনীতি) জোন নামে খ্যাত। বিশেষ করে বৈদেশিক বাণিজ্য, জাহাজ শিল্প, আমদানি-রফতানি কিংবা পর্যটন এসব ‘নীল সমুদ্র অর্থনীতি’র আওতায় পড়ে। এসবের বাইরেও সমুদ্রের খনিজ সম্পদের বিশাল ভান্ডার ‘নীল সমুদ্র অর্থনীতি’র আওতায় পড়ে। এই বিষয়টি সম্পর্কে সর্বসাধারণের ধারণা নেই বললেই চলে।  

আরেকটি বিষয় হচ্ছে সমুদ্রসম্পদ অতি প্রয়োজনীয় হলেও আহরণে এক ধরনের অনীহা লক্ষ্য করা যায় আমাদের মধ্যে। শুধু বাংলাদেশই নয়, সমগ্র সমুদ্রতীরবর্তী দেশগুলোর মধ্যেই এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অথচ সমুদ্রতীরবর্তী বিশ্বের প্রতিটি দেশই ইচ্ছে করলে সমুদ্র সম্পদের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে অনায়াসেই। কিছু কিছু দেশ নির্ভরশীল হচ্ছেও ক্রমশ। তবে ইচ্ছে করলে সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল হতে পারে বাংলাদেশ। এটি অনেকভাবেই সম্ভব। বিশেষ করে খনিজ পদার্থ উত্তোলনের মাধ্যমে অতি সহজেই বিত্তশালী দেশে পরিণত হতে পারে বাংলাদেশ।  

আমরা লক্ষ্য করেছি, দুর্গম অঞ্চল থেকে খনিজ সম্পদ আহরণ করলেও সমুদ্র সম্পদের প্রতি এক ধরনের অনীহা রয়েছে মানুষের। অথচ দুর্গম অঞ্চলের খনিজ সম্পদের তুলনায় সমুদ্রসম্পদ আহরণ কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও প্রচুর লাভজনক। যেমন, একটি সাধারণ বিষয় হচ্ছে মৎস্য আহরণ ও লবণ উৎপাদন। এ দুটি ক্ষেত্রে খুব বেশি অর্থলগ্নির প্রয়োজন পড়ে না। অথচ কোটি কোটি টাকা লাভবান হচ্ছেন লগ্নীকারিরা। এ দুটি সেক্টরে বাংলাদেশ সরকারের সরাসরি অর্থলগ্নি না থাকলেও অনেক সময় প্রণোদনা দিয়ে থাকেন সরকার। তাতে করে লগ্নিকারীরা উজ্জীবিত হয়ে থাকেন যেমন, তেমনি সমুদ্রসম্পদ আহরণ করে অভ্যন্তরীন চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরে রপ্তানী করে বিপুল রাজস্বের জোগান দেন তারা।

আমরা জানি, সমগ্র বিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ স্থলভূমি, বাদবাকি তিন ভাগ জলরাশিতে ভরপুর। তার মধ্যে বেশির ভাগই সমুদ্রবেষ্টিত জলরাশি। উদাহরণ হচ্ছে, মাত্র এক ভাগ স্থলভূমির মধ্যে শত শত প্রকারের খনিজ পদার্থ বিদ্যমান থাকলে বাকি তিন ভাগে কী পরিমাণ সম্পদ থাকতে পারে তা অনুমেয়। এই হিসেব-নিকেশের জন্য কাগজ-কলম নিয়ে অঙ্ককষার প্রয়োজন নেই, সাধারণ জ্ঞানই যথেষ্ট। অনেকের উপলব্ধি জলতলে আবার কীসের সম্পদ! সে উপলব্ধি নিবৃত্তির প্রয়াসে ছোট্ট একটি পরিসংখ্যান দাখিল করার চেষ্টা করছি আমরা।  

সমীক্ষায় জানা গেছে, সমুদ্রে ৫০টির অধিক অতি প্রয়োজনী খনিজ পদার্থ রয়েছে। উল্লেখযোগ্যের মধ্যে, বালু, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, মোনাজাইট, জিরকন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, জিংক, আয়োডিন, অ্যালুমিনিয়াম, ফসফরাস, লিথিনিয়াম, সালফার, সিলিকন, কপার, নাইট্টোজেন, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, বোরন, স্বর্ণ, জ্বালানি তেল, গ্যাস, ক্লে (সিমেন্টের কাঁচামাল), দ্রবীভূত লবণসহ হরেক খনিজ পদার্থ। অপরদিকে জলজ প্রাণিদের মধ্যে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩৬০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া, অক্টোপাস, হাঙরসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণিজ সম্পদ রয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এছাড়াও আমাদের সমুদ্র সীমানায় প্রচুর টুনা মাছ পাওয়া যায়, যা খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি এ মাছের আন্তর্জাতিক চাহিদা ব্যাপক। উল্লেখ্য, আমাদের দেশেও টুনা মাছের প্রচুর চাহিদা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বিচ এলাকায় পর্যটক বেড়াতে এলে টুনা মাছের বারবিকিউ তাদের পছন্দের তালিকায় থাকে।

অন্যান্য খনিজ পদার্থের তুলনায় সমুদ্রে দ্রবীভূত লবণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, তার পরেই হচ্ছে সালফার। মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে কিংবা খাদ্যের স্বাদ ফিরিয়ে আনতে হলে লবণের বিকল্প নেই। যা জোগান দিচ্ছে সমুদ্রের জলরাশি। অপরদিকে সালফারের প্রয়োজনীয়তা স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করার নয়। শুধু সালফার নয়, প্রতিটি খনিজ পদার্থের প্রয়োজনীয়তা স্বল্প সময়ের মধ্যে কিংবা স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করা যাবে না। উপরে ইউরেনিয়ামের কথা উল্লেখ করা হলেও এই খনিজ পদার্থের প্রয়োজনীয়তা ও সমুদ্রতলে মজুতের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি। অন্যান্য খনিজ পদার্থ সম্পর্কে তেমন একটা আলোচনা করা না হলেও ইউরেনিয়াম সম্পর্কে আমরা সামান্য আলোচনা করার চেষ্টা করছি। কারণ এটি একটি দুষ্পাপ্য খনিজ পদার্থ। বিশ্ববাজারে ইউরেনিয়ামের দাম যেমন চড়া তেমনি রয়েছে ব্যাপক চাহিদাও। বিশেষ করে জার্মানি, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইউরেনিয়ামের চাহিদা বলে শেষ করার মতো নয়। এ ছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশেই ইউরেনিয়াম সংগ্রহ নিয়ে অনেক কূটকৌশল চলছে।

সমীক্ষায় জানা যায়, কোন স্থানে ইউরেনিয়ামের মাত্রা ৭ শতাংশ হলে বাণিজ্যিকভাবে সেটি উত্তোলনের উপযুক্ত হয়। সেই মতে আমাদের সমুদ্রসীমানায় বিশেষ করে উপকূলীয় কিছু অংশে বাণিজ্যিকভাবে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের মতো মজুত রয়েছে। ইউরেনিয়াম শুধু বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকাই নয়, বিশ্বের সমগ্র সমুদ্রে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত রয়েছে যার পরিমাণ প্রায় ৪ বিলিয়ন টন। যা উত্তোলনে পরিবেশের ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটার কথা নয়। খনি থেকে ইউরিনিয়াম অরহণ খুব বিপজ্জনক হলেও সমুদ্রের তলদেশ থেকে ইউরিনিয়াম উত্তোলন তুলনামূলক নিরাপদ।  

অন্যদিকে প্রতি ঘনমাইল সমুদ্রজলে প্রায় ২৫ টন স্বর্ণ মজুতের তথ্যও জানা গেছে। জানা গেছে, অফুরন্ত গ্যাস এবং জ্বালানি তেলের মজুত সম্পর্কেও। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার পাশেই মিয়ানমার ইতিমধ্যে বড় ধরনের গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পেয়েছেও। বিশেষজ্ঞদের ধারণা আমাদের সমুদ্র সীমানায় তারচেয়েও বড় ধরনের গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, যা আমাদের অতিশীঘ্রই সন্ধান করে নিশ্চিত হতে হবে এবং সেটি উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ ২০৩১ সাল পর্যন্ত আমাদের গ্যাস মজুত থাকবে। ভূপৃষ্টের গ্যাস পুড়িয়ে যাওয়ার আগেই সমুদ্রে রক্ষিত গ্যাসের ওপর আমাদের নজর দিতে হবে। এই মুহূর্তে উত্তোলন সম্ভব না হলেও ভারত ও মিয়ানমার থেকে অর্জিত সমুদ্রসীমায় ২৬টি ব্লক ইজারা দিয়ে সেখান থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ সমুদ্রের খনিজ সম্পদ উত্তোলনের অভিজ্ঞতা ভারত, মিয়ানমারের রয়েছে। তারা সমুদ্রের তেল-গ্যাস উত্তোলন করে নিজেদের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে ইতোমধ্যে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। তেমনি গ্যাসের মতো ইউরেনিয়ামের ক্ষেত্রেও ইজারার মাধ্যমে আহরণ সম্ভব। কারণ ইউরেনিয়ামের ব্যবহার দেশে খুব দ্রুততর হতে যাচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে ইউরেনিয়ামের প্রয়োজনীতা দেখা দিবে। আমাদের বিশ্বাস সঠিক সময়ে উত্তোলনের ফলে সেই প্রয়োজনীতা মিটে যাবে অনায়সেই।  

শুধু নীল সমুদ্রই নয়, সমুদ্রোপকূলেও রয়েছে অগাধ সম্পদ। সমুদ্রোপকূলে এ পর্যন্ত ১৭ প্রকার খনিজ বালুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ইলমেনাইট, জিরকন, রোটাইল, গ্যানেট, ম্যাগনেটাইট উল্লেখযোগ্য। ধারণা করা হচ্ছে, সমুদ্রোপকূলেও প্রায় ১.২৪ মিলিয়ন টন খনিজ বালু রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ১২ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্যে আঘাত হানলেও সমুদ্রোপকূলের বালু আরহণে সেই ধরনের ঝুঁকি নেই। অর্থাৎ পরিবেশ ভারসাম্য বজায় রেখেই উত্তোলন করা সম্ভব।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সুনীল অর্থনীতি কাজে লাগাতে পারলে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশের পক্ষে আয় করা সম্ভব। যার জন্য সমুদ্রে রক্ষিত প্রাণিজ সম্পদ, অপ্রাণিজ বা খনিজ সম্পদ উত্তোলনের ব্যবস্থা নিতে হবে দ্রুততর। তাতে করে দেশ যেমন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে, তেমনি বেকারদেরও কর্মস্থানের ব্যবস্থা হবে দ্রুত। তা ছাড়া এসব অতি প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ উত্তোলন এবং সঠিক ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশ অচিরেই বিত্তশালী দেশে পরিণত হতে পারবে বলে আমাদের অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। আরেকটি কথা হচ্ছে, ভূপৃষ্টের সম্পদ যতটা নিরাপদে আগলে রাখা সম্ভব, ততটা নিরাপদ নয় সমুদ্র সম্পদ। বিশেষ করে প্রাণিজ সম্পদের কথাই ধরা যাক, এ সম্পদের মধ্যে স্থিরতা নেই, যেকোন সময় সীমানা অতিক্রম করতে পারে অথবা সীমানা ডিঙ্গিয়ে কেউ কেউ আহরণ করে নিয়ে যেতে পারে। সুতরাং সেসব চিন্তা মাথায় নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সমুদ্র সম্পদ আহরণ করা যায়, ততটাই মঙ্গল আমাদের জন্য।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।