ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

দুঃসহ সেই রাতের স্মৃতি

ম. শামসুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০২৩
দুঃসহ সেই রাতের স্মৃতি ...

চট্টগ্রাম: ২৯ এপ্রিল ১৯৯১। আমার কাছে এটি শুধু একটি তারিখ নয়, দিনটি ছিল আমার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ।

আরো অনেকের মতো আমিও নাই হয়ে যেতে পারতাম বিভীষিকাময় সেই রাতে। সেই মহাপ্রলয়ের রাতে ঝড়-জলোচ্ছাসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি সারা রাত। এক পর্যায়ে ছেড়েও দিয়েছিলাম জীবনের আশা। তারপরও আল্লাহর ইচ্ছা ছিল বলেই  একটি গাছকে অবলম্বন হিসাবে পেয়ে বেঁচে গিয়েছিলাম আমি। নতুন জীবন নিয়ে আরো বত্রিশটি বছর পার করে দিলাম এই ধরনীতে।

গাঢ় অন্ধকার সেই রাতটিতে খুব কাছে থেকেই দেখেছি মৃত্যুকে। আমার চোখের সামনেই পানিতে ভাসতে ভাসতে লাশ হতে দেখেছি অনেককে। নিজ কানে শুনেছি কারো কারো মৃত্যুপূর্ব ঘোঙানির শব্দ। আমার সঙ্গে যেসব স্বজনরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে কারো কারো লাশটাও খুঁজে পাইনি।

আমি তখন সদ্য ভর্তি হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দুরত্বে আমাদের বাড়ির অবস্থান। আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর গ্রামে অবস্থিত আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে আড়াই কিলোমিটার দূরে শংখ নদী আর পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। ঘূর্ণিঝড়ের আগের দিন চট্টগ্রাম শহর থেকে গিয়েছিলাম বাড়িতে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একটি নিম্নচাপ ওই দিনই পরিণত হয়েছিল ঘূর্ণিঝড়ে। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে দেয়া হয়েছিল ছয় নম্বর বিপদ সংকেত। কিন্তু আমাদের মতো উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের এ ধরনের সংকেতের খবর হরহামেশাই শুনতে হতো।  

ওইদিন আবহাওয়া পরিস্থিতিও তেমন একটা খারাপ ছিল না। তাই এ নিয়ে অন্যদের মতো আমার কাছেও  অস্বাভাবিক মনে হয়নি। কিন্তু ২৯ এপ্রিল আবহাওয়ার চেহারা কিছুটা পরিবর্তন হয়। এদিন সকাল থেকেই আকাশে ছিল ভারি মেঘের ও আনাগোনা। সেই সঙ্গে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ও হালকা বাতাস। দুপুরের পর থেকে আবহাওয়ার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। ক্রমশ বাড়ছিল বাতাসের গতি। সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় বৃষ্টি আর বাতাসের ঝাপটা। মাটির দেয়াল আর উপরে টিনশেড দেওয়া আমাদের ঘরে ছিলাম আমি, মা ও আমার ভাগিনী । মাঝে মধ্যে দমকা হাওয়া বইছিল। পেরেক ঢিলে হয়ে যাওয়া টিনের চালার টিনগুলো বাতাসের গতির কাছে হার মেনে খুলে পড়তে চাইছিল। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আম্মা রান্না শেষ করে ফেলেন। কিন্তু খাওয়া হয়নি কারো।  

রাত ৯টার দিকে জেঠাত ভাই আবুল কালাম এসে আম্মাকে জানালেন ১০নম্বর বিপদ সংকেতের কথা। বললেন, সাইক্লোন শেল্টার কিংবা দূরে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু আম্মা রাজি হলেন না। বললেন- বিল খাল শুকনো। পানি আসলে তা তো জমি চুষে নেবে। কত আর পানি হবে। বাড়ির অনেকেই এসময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেও আমরা সহ বাড়ির আরো কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা থেকে গেলেন নিজ নিজ ঘরে। বাইরে প্রচন্ড গতিতে বইছিল ঝড়।  ঝড়ো হাওয়া আর বর্ষণের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিলনা তখন। মনে মনে ভয় লাগলেও ভরসা দিচ্ছিলেন আম্মা। হারিকেন জ্বালিয়ে একটি রুমে এসে বসে রইলাম আমরা তিনজন। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল দমকা হাওয়া আমাদের ঘরটিই হয়ত উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তারপরও কোনভাবে রাতটা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।  

তখনো আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। বাতাসের কারণে হারিকেনও জ্বালিয়ে রাখা যাচ্ছিল না।  তাই অন্ধকারে একমাত্র সম্বল ছিল তিন ব্যাটারির টর্চলাইটটি। রাত বারোটার দিকে জানালা ফাঁক করে বাইরে টর্চ লাইটের আলো ফেলতেই দেখি ঘরের দেয়ালের কাছেই পানি। আম্মাকে বলার পর তড়িঘড়ি করে আম্মা আর ভাগিনীসহ বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। আমার ডাকাডাকিতে ৫বছরের পুত্র বাদশা আর ৩বছরের মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলো জেঠাত ভাই ফয়েজ ও তাঁর স্ত্রী। এলেন জেঠাত বোন আয়েশা, তাঁর স্বামী সত্তরোর্ধ আছদ আলী ও মেয়ে ফাতেমা। বাড়ির উঠোনে তখন কোমর সমান পানি। সবাই মিলে পানি ভেঙ্গে ভিটের উত্তর পূর্ব পাশে থাকা খড়ের গাদায় গিয়ে উঠলাম।  

প্রথম দফায় শংখের বাঁধ বিলীন হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব থেকে ধেয়ে আসা পানি দ্রুত বাড়ছিল তখন। এ অবস্থায় আমরা একে অপরকে ধরে একসঙ্গে জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলাম । কিন্তু বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারিনি। রাত সাড়ে ১২টায় দ্বিতীয় দফায় বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা জলোচ্ছ্বাসের ঢেউয়ের আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে ছিড়ে যায় খড়ের গাদাটি। আমার চোখের সামনেই অল্প খড় সহ বিচ্ছিন্ন হয়ে ভেসে গেলেন আম্মা ও ভাগিনী। তাঁদের ধরে রাখার কোন চেষ্টাই কাজে আসল না। একইভাবে একে একে ভেসে গেলেন আয়েশা ও তাঁর স্বামী আছদ আলী। ছেলে বাদশা আর মেয়ে মুন্নীকে কাঁধে নিয়ে খড় ধরে ভেসে গেলেন জেঠাত ভাই ফয়েজ। অথৈ সাগর মাঝে গাছের ঢাল আর খড়ে গাদা সঙ্গী করে তখনও সেখানে রইলাম আমি, ফয়েজের স্ত্রী ও ফাতেমা। হঠাৎ দক্ষিণ দিক থেকে একটি খালি চালা এসে ঠেকল খড়ের গাদা ও পার্শ্ববর্তী ফুল গাছের সঙ্গে। আমরা তিনজন কোনভাবে উঠলাম সেই চালায়।  দশ মিনিটের মতো ওই অবস্থায় ছিলাম। হঠাৎ বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলোচ্ছ্বাসের প্রচণ্ড স্রোতে চালাসহ ভেসে যেতে লাগলাম পূর্ব দিকে। প্রায় আধ কিলোমিটার যাবার পর চালা থেকে ছিটকে পড়ে গেলাম আমি। হাবুডুবু খাচ্ছিলাম পানির সাগরে। মনে হলো এখানেই জীবন শেষ।  

এমন সময় হঠাৎ ভেসে উঠলাম পানির উপরে। সামনে পেলাম ঝড়ে ডাল পালা ভেঙ্গে গিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে থাকা একটা কড়ই গাছ। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম গাছটি। এক একটি ঢেউ এসে চলে যাচ্ছিল মাথার উপর দিয়ে। গাছটি জড়িয়ে ধরে ঢেউয়ের ধাক্কার মুখে অনেক কষ্টে নিজেকে টিকিয়ে রাখছিলাম। ঢেউ যাবার পর মাথাটা কোনভাবে পানির উপরে তুলে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। গাছটির ডালপালা না থাকায় উপরে উঠারও কোন সুযোগ ছিলনা। তখন গভীর রাত। পানির নিচে ডুবে গেছে পুরো উপকূলীয় এলাকা। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। মনে হচ্ছিল যেন সাগর মাঝে ভাসছি আমি। ঘরের চালা, গাছ পালা, খড় কুটো ইত্যাদি স্রোতের সাথে ভেসে যাচ্ছিল আমার কাছ দিয়েই। পানিতে ভাসতে থাকা এক নারীকে দেখলাম গোঙাতে গোঙাতে এসে ঠেকেছে একটু দূরে আরেকটি গাছের সঙ্গে। কিন্তু এ সময় গাছটি ধরে বাঁচার চেষ্টা করার মত শক্তিও তার ছিল না। কিছুক্ষণ পরে সেখানেই তাকে নিথর হয়ে ভাসতে দেখলাম। এভাবে অনেক আদম সন্তানের লাশ ভেসে যেতে দেখেছি খুব কাছে থেকে। সেই গাছটি বুকে নিয়ে ঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের সাথে যুদ্ধ করেই কেটে যায় সারারাত।

রাত অনুমান তিনটার পর থেকে পনি কমতে শুরু করে। পানি কমে যাওয়ার পর সকাল ৭টার সময় নেমে আসি রাতভর বুকে জড়িয়ে রাখা গাছটি থেকে। তখনো বুক সমান পানি। পানি সাতরে কোনভাবে উঠে এলাম বাড়ির সামনের রাস্তায়। এ সময় রাস্তার দু’পাশে দেখা যাচ্ছিল কেবল লাশ আর লাশ। চিৎ, কাত, উপুড় হয়ে পড়ে থাকা বিবস্ত্র নারী পুরুষের লাশ, সন্তান বুকে মায়ের লাশ, গরু-ছাগলের অসংখ্য মরদেহ। চোখের সামনে ভেসে যাওয়া আম্মা-ভাগিনী, প্রতিবেশি কারো বেঁচে থাকার আশাই করতে পারছিলাম না তখন। ভিটেতে ফিরে দেখি ঘরের কোন অস্তিত্ব নেই।  

শূন্য ভিটেয় ভেজা কাপড়ে বসে কাঁদছেন আম্মা। তিনি জানালেন, খড়সহ ভেসে যাবার পথে অলৌকিকভাবে একটি গাছ ধরে রাতভর পনির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচেছিলেন। একইভাবে বেঁচে যান ভাগিনী বিলকিসও। কিন্তু চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় জেঠাত ভাই ফয়েজ, তার ছেলে বাদশা ও মেয়ে সহ আমাদের বাড়ির তিনটি পরিবারের ১৬জন সদস্য। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মিলেনি এদের অনেকের লাশের সন্ধান।

জীবনে সুখ-দুঃখের অনেক স্মৃতি আছে। কত স্মৃতি ভুলে গেছি আবার কত স্মৃতি ইচ্ছে করেই ভুলে থাকি। কিন্তু বত্রিশ বছর আগেই মৃত্যুভয়াল সেই রাতটির স্মৃতি ভুলতে পারিনা। মনে মনে ভাবি, আমার জীবনের পর্বটাও ওখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। একটি গাছকে অবলম্বন হিসাবে দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সেদিন বাঁচিয়ে রেখেছেন বলেই আজও এই পৃথিবীর বাসিন্দা আমি।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে)  

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০২৩
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।