বাংলাদেশের সরকার, রাষ্ট্রীয় কাঠামোটি বুর্জোয়া চিন্তার। আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুটি দলও বুর্জোয়া চিন্তা-চেতনার।
আমেরিকা-ভারত-বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ জাতীয় যে সব দেশ-সংস্থার সঙ্গে সরকার সুসম্পর্ক রক্ষার চেষ্টায় জেরবার, সে সবও মুক্তবাজার অর্থনীতির হালের নাম-সাকিনের বুর্জোয়া দেশ-সংস্থা।
কাজেই এ সরকারের লোকজন কথাবার্তার সময়ও তাদের এসব অবস্থান-কেবলার বিষয়ে সংযত-সতর্ক থাকবেন, এমনটিই আশা করাটা বাস্তবসঙ্গত। এর বাইরেও কিন্তু পথ আছে। যেমন চীন-ইরান-উত্তর কোরিয়া। সরকার চাইলে সাহস-সামর্থ থাকলে তার চলতি ফর্মেটের বাইরে গিয়ে এসব রাষ্ট্রের পথেও হাঁটা দিতে পারে। কিন্তু নিজে বুর্জোয়া চিন্তা-কাঠামোর কাঁচের ঘরের মধ্যে বসে থেকে অন্যকে ঢিল ছুঁড়বেন, এটা সংশ্লিষ্টদের জন্য কত বিপদজ্জনক, তা তাদের জানার কথা।
হিলারি ক্লিনটনের সফরের পর থেকেই সরকারি লোকজনের কথাবার্তায় স্পষ্ট, তারা মানসিকভাবে ফুরফুরে-ভালো নেই, স্বস্তিতে নেই! এমনিতে শুরুতে হিলারির সফর নিয়ে সরকার তথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির আহলাদের শেষ ছিলোনা। ড ইউনুসের সঙ্গে সরকারি কাইজ্যা, অহি নকুল সম্পর্ক সত্ত্বেও হিলারি বাংলাদেশ সফরে আসছেন, এটিকে সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য হিসাবে দেখানোর-বলার চেষ্টা হচ্ছিল! এমনও বলার চেষ্টা হয়েছে যে হিলারির সফরকে সামনে রেখে ড ইউনূসের যুক্তরাষ্ট্র সফর, কানপড়া এসব কোন কাজে দেয়নি!
মার্কিনিরা বরাবর একটা ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে থাকে। আনুগত্যে বড় সমস্যা দেখা না দিলে সাধারণত বিপক্ষনেয়না। এর কারণে সরকারের দাবিটি তখন সত্য মানতে ইচ্ছেও করেছে। কিন্তু হিলারি ঢাকা নেমেই তার উল্টো বার্তা দেওয়া শুরু করলেন! ঢাকা ল্যান্ড করেও বিমান থেকে নামেননি প্রায় এক ঘন্টা! এদিকে ফুল হাতে বিমান বন্দরে অধীর দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি! হিলারিকে অভ্যর্থনা জানাবেন, তার সঙ্গে একটা গ্রুপ ছবির সৃষ্টি হবে! কিন্তু হিলারি নামেন না! ওই অবস্থায় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মনে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল, আয়াতুল কুরসি তিনি পড়ছিলেন কীনা, তা তিনিই বলতে পারবেন! কোন দেশে কোন অতিথি গিয়ে হোস্ট কান্ট্রির সঙ্গে এমন আর কখনো কেউ করেছেন কীনা, তা আমার জানা নেই। সবাই দেখলেন হিলারির বিমানে গিয়ে উঠলেন ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা। যিনি সারাদেশ ঘুরে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন! সম্ভবত তার কাছ থেকেই বাংলাদেশের সর্বশেষ নানাকিছুর ব্রিফিং পেয়েছেন হিলারি। ড ইউনূসতো আগে থেকে যা যা করার তা করেছেন! অতএব এরপর থেকে ঢাকায় যতক্ষণ ছিলেন, সরকারকে নানাভাবে শাসানি ছাড়া কিছু দিয়ে যাননি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এরপর থেকে আমরা এসবের প্রতিক্রিয়া প্রথম দেখি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের বক্তব্যে। তার পরে পুরা বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের ক্ষোভক্রোধ-হতাশা আরও উদগীরণ করে ঢেলে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম!
গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ড ইউনূসের দাবিকে রাবিশ বলে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। ড ইউনূস বলেছেন, গ্রামীণ ব্যাংক সরকার দখল করে নিয়েছে। আর অর্থমন্ত্রী বলেছেন গ্রামীণ ব্যাংক আর দশটি সরকারি ব্যাংকের মতোই একটি। সরকারি নীতিমালা অনুসারেই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। হিলারি ঢাকায় বলেছেন গ্রামীণ ব্যাংক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার খুশি না। তিনি নিজে বিষয়টি ওয়াশিংটনে বসে মনিটর করছেন ইত্যাদি! একটা স্বাধীন দেশের জন্য এসব কী বিপদজ্জনক কথাবার্তা।
মনমোহন সিং যদি বলতেন দিল্লিতে বসে তিনি ঢাকার সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম মনিটর করছেন, তাহলে কী প্রতিক্রিয়া হতো? স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে কী এর বিরুদ্ধে ধেই ধেই প্রতিবাদের শোরগোল শুরু হয়ে যেতোনা? কিন্তু হিলারির এসব বক্তব্যের পর তা হয়নি। কারণ হিলারিকে যিনি দাওয়াত করে এনেছেন সেই ড ইউনূস যতটা না বাংলাদেশি, এর চেয়ে তার মার্কিন প্রভুদের প্রতি আনুগত্য বেশি। বিএনপিও এর বিরুদ্ধে বলেনি বা বলার নয়। সঙ্গত কারণে উল্টো দলটি এতে পুলক অনুভব করেছে! আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে থাকলে এমনই করতো। সবার যে কেবলা এক!
নিজের স্বার্থের বাইরে জীবনে ড ইউনূস কোথাও একটি কথাও বলেননি বা বলেননা! নিজের স্বার্থে যে কাউকে দেশের বিরুদ্ধে লাগাতেও তার জুড়ি নেই! গ্রামীণ ফোনের ইনকামিং কলচার্জের বিরুদ্ধে শুরুতে সরকার ব্যবস্থা নিতে গেলে ড ইউনুস তখন তার বন্ধু অথবা প্রভু মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের দিয়ে সরকারকে যে শাসিয়েছিলেন, তা কী আমরা ভুলে গেছি? আর মার্কিন বার্তাটি পেয়ে তখন এই আওয়ামী লীগ সরকারই এ ব্যাপারে চুপ মেরে গিয়েছিল। এরপরও সত্য যে ড ইউনূসের নেতৃ্ত্বের কারণেই গ্রামীণ ব্যাংকের আজকের বিকাশ হয়েছে। অর্থমন্ত্রী গ্রামীণ ব্যাংককে আর দশটি সরকারি ব্যাংকের মতো দাবি করলেও কার্যত তা নয়। সোনালী-রূপালী ব্যাংকেরা গ্রামের কাদামাটির পথ দিয়ে কখনো হেঁটে যায়নি। আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে দুনিয়ার কোথাও টেকসই উন্নতি হয়নি, সেটিও সত্য। কিন্তু এগুলো দিয়ে যে দেশের গ্রামীণ জনপদে টিকে থাকার নতুন একটি চেষ্টা শুরু হয়েছে এবং এনজিওদের টাকা বিদেশ থেকে সরকারি অনুমোদনের মাধ্যমে দেশে আসে সে বিষয়টিও সত্য। যে টাকা বা প্রক্রিয়া দিয়ে দেশের উন্নতি হয়না, সে টাকা কেন ঢুকতে দেওয়া হয় বা প্রক্রিয়াগুলোর কেন অনুমোদন দেয়া হয়, সে দায়দায়িত্বও সরকারের নয় কী? বা বিদেশি অনুদান সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল সরকারের সঙ্গে এনজিওগুলোর পার্থক্য কী? ড ইউনূসের ব্যাপারেও নানামত সত্ত্বেও তার নোবেল প্রাপ্তিতে আমরা খুশি হয়েছি। কারণ আমরা যে একটি বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামোরই বাসিন্দা। বিদেশি সার্টিফিকেট পক্ষে গেলে আমাদের ভালো-মোলায়েম লাগে। আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত-বুর্জোয়া রাষ্ট্রে আমরা যাই-থাকি। কারন আমাদের সরকার, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের দেশে নিরাপদ থাকার স্বপ্ন দেখাতে পারেনা।
এবার ড ইউনূস শুধু একা না, ব্রাকের চেয়ারপার্সন ফজলে হাসান আবেদকে সঙ্গে নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসার বৈঠক শেষে মিডিয়াকে এসে বলেছেন, তারাও চান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক।
খুব স্বাভাবিক বিএনপি তাদের এই বক্তব্যে আরও খুশি-আশ্বস্ত আর আওয়ামী লীগ ক্ষুদ্ধ হয়েছে! যা প্রকাশ পেয়েছে সৈয়দ আশরাফুলের সর্বশেষ বক্তব্যে। এ নিয়ে নিজেদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে উল্টো নোবেল পুরস্কারের নাড়ি ধরেও টান দিয়েছেন সৈয়দ আশরাফ! প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, কোথায় গিয়ে চিপস আর ওয়াইন খেলে নোবেল পুরস্কার পাওয়া যায়, তা তিনি জানেন! অর্থনীতিবিদ ড ইউনূসকে শান্তির জন্য কেন নোবেল দেওয়া হলো, সে প্রশ্নও তুলেছেন! ড ইউনুসকে কেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তা তখন একটি বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে নোবেল কমিটি। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধের প্যাটার্নকে পছন্দ করেছে বুর্জোয়া চিন্তা-কাঠামোর নোবেল কমিটি। তাই তারা তাকে তা দিয়েছে।
কিন্তু সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে থেকে এ নিয়ে যে ভাষায় কাঁচের ঘরে বসে শাসকদল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ঢিল ছোঁড়ার মতো গোটা নোবেল কর্তৃপক্ষ তথা সুইডিশ একাডেমির ইন্টিগ্রিটিকে কটাক্ষ করেছেন, এর কিন্তু একটা খবর হবে।
এমনিতে পদ্মা সেতুসহ নানান সমস্যায় ভুগছে সরকার। মনোরেলও আর ঢাকার মাথার ওপর দিয়ে চলছেনা। জাপানসহ যেখানে যার কাছে হাত পাততে হয়, তারাও কিন্তু সবাই সে সব বুর্জোয়া চিন্তা-কাঠামোর বাসিন্দা। চলতি হাজার সমস্যার সমাধান যেখানে সরকার করতে পারছেনা, ইউনুসকে আক্রমন করতে গিয়ে নোবেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গায়ে পড়ে যে বাড়তি ঝামেলা টেনে আনা হলো তা তারা কীভাবে সামাল দেবে তা কেউ জানেনা।
সৈয়দ আশরাফুলের বক্তব্যকে বেসুরো অথবা পুরনো মনোঃকষ্টের বহিঃপ্রকাশ হিসাবেও দেখা হতে পারে। কারণ এই নোবেলের জন্য কারা কোথায় কী পরিমান কাঠখড় পুড়িয়েছেন, তা অনেকে জানেন! ড ইউনুসের নোবেলের পর সরকারি কেউ কেউ এমনও বলার চেষ্টা করেছেন যে, নোবেল কমিটি ভুল করে তা ইউনুসকে দিয়ে ফেলেছে! বাংলাদেশে শান্তির জন্য নোবেলের উপযুক্ত ছিলেন শেখ হাসিনা এবং সন্তু লারমা। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির জন্য তারা এর পাওনাদার ছিলেন, ইত্যাদি। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি আওয়ামী লীগ সরকারের অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। চুক্তিটি যদি ঠিকমতো কার্যকর করা হতো তাহলে এরজন্যে সংশ্লিষ্টরা ভবিষ্যতেও নোবেল পুরষ্কারের জন্য বিবেচিত হতে পারতেন। কিন্তু সর্বশেষ কী অবস্থা সেই শান্তি চুক্তির? চুক্তিটি বাস্তবায়ন নিয়ে যে গড়িমসি, প্রতারণা হয়েছে এবং এখনও চলছে, এতেতো ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তিটি ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ অবস্থায় উল্টো অশান্তির দলিল হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গেছে! এরপর আবার ‘বিশ্ব শান্তির জন্য শেখ হাসিনার রূপরেখা’ উপস্থাপনের নামে গত তিন বছর কারা কারা সরকারি পয়সায় দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জায়গামতো পৌঁছতে-ভিড়তে না পেরে এক রকম প্রমোদ ভ্রমনের নামে করেছেন সরকারি অর্থের মচ্ছব, তাতো কেউ না জানলেও জানার কথা শেখ হাসিনা আর সৈয়দ আশরাফুলের!
কাজেই এসব না করে তিনি কী চিপস আর হোয়াইট ওয়াইন খেতে সংশ্লিষ্টদের তার চেনা জানা সেই রেস্টুরেন্টে পাঠাতে পারতেন না? এমনভাবে যদি সম্ভব হয় তাহলে একটি নোবেল পুরস্কারের ব্যবস্থা করে দেন না সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম! এমনিতে আপনি মাসের পর মাস অফিসে না গিয়েও মন্ত্রীত্ব রক্ষার রেকর্ডধারী! সীমান্তে হত্যাকাণ্ডেও আপনি বিব্রত হন না! তেমন একটি নোবেলের ব্যবস্থা করা গেলে কিন্তু আপনার বুড়ি আর কারও ছোঁবার সুযোগ থাকবে না। ট্রাইটা শুরু করবেন? প্লিজ!
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১১২৬ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১২
এমএমকে