এই প্রথম ইচ্ছা করছে, কারো জন্যে রাজপথে নামি। এই প্রথম ইচ্ছা করছে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলি, ‘তোরা থামা এই বিধ্বংসী খেলা’---।
পরের কথাটি কি বলবো তা আর মাথায় আসে না। যেমন করে মাথায় আসে না, যে মানুষটি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য এতো কিছু করলেন, এতো সম্মান বয়ে আনলেন। আর আজ তাকে এইভাবে প্রতিনিয়ত অপমানে বিদ্ধ করা হচ্ছে!
গত বছরের ৯ মার্চের পত্রিকার পাতায় আগের দিন ড. ইউনূসের শুনানি শেষে আদালত থেকে বেরিয়ে আসার ছবিটা দেখেছিলাম। দেখে বুকের ভেতর কেমন জানি করে উঠেছিল, হয়ত চোখের কোণে পানিও চলে এসেছিল। নোবেল বিজয়ীকে কি একটু বয়স্ক লাগছিল না, তার হাসিটা কি একটু মলিন হয়ে যায়নি? সেই ৯ মার্চের সকল পত্রিকার শিরোনামে ছিল অব্যাহতির আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা রিট আবেদনের রায়ের খবর। ওই দিনের রায় কোনো মঙ্গলবার্তা বয়ে আনেনি। উচ্চ আদালতের রায় এটাই হবে তা অনেকেরই জানা ছিল।
তবুও আশায় ছিলাম, সরকারের তথা সংশ্লিষ্টদের যদি শুভ কিছু করার ইচ্ছা থেকে রায়টা ড. ইউনূসের পক্ষে যায়! কিন্তু তা আজ পর্যন্ত হয়নি। আর কখনো হবে বলেও মনে হয় না।
যে মানুষটা বলেছিলেন ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্যকে একদিন মিউজিয়ামে পাঠাবেন’। অথচ, আজ তাকেই মিউজিয়ামে পাঠানোর সব ব্যবস্থা আমরা করছি!
৮ মার্চের শুনানিতে অংশ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, ‘নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর মানুষ নির্মোহ হন। কিন্তু তিনি গ্রামীণ ব্যাংকে থাকতে চান। ’ তিনি কিভাবে জানবেন, এ মোহ কিসের?। এ মোহ দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসার মোহ। এ মোহ নিজ হাতে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানের প্রতি।
প্রধানমন্ত্রী ইউনূসকে ‘গরিবদের রক্তচোষা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। আর প্রধানমন্ত্রীর পুত্র তার লেখা খোলা চিঠিতে ড. ইউনূসকে বলেছিলেন ‘প্রতারক এবং চোর’। আর আজ সরকারের প্রথম সারির মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদ তার নোবেল পাওয়া নিয়েই প্রশ্ন তুললেন! শুধু প্রশ্নই তুললেন না, এ পর্যন্ত যারা যারা নোবেল পেয়েছেন, তাদের যোগ্যতা নিয়েই সন্দিহান হলেন! তার মতে, এক হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে মিল দিলেই নাকি নোবেল পাওয়া যায়!
ড. মোহাম্মদ ইউনূস এবং বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কখন ও কি কারণে এই টানাপড়েন, তা আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাছে পরিস্কার না হলেও এটা প্রকাশিত হয়, যখন নোবেলজয়ী ঘোষণা দেন তিনি রাজনীতিতে আসছেন। এটা আরও জটিল হয় ২০০৭ সালে প্রফেসর ইউনূস যখন ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতি টাকা বানানোর উপায় ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা বাংলাদেশের সকল সাধারণ মানুষের মনের কথা হলেও রাজনীতিবিদরা ভালোভাবে নেননি। সে সময় বর্তমান বিরোধী দলীয় অনেক রাজনীতিবিদ তাকে ভীষণভাবে আক্রমণ করে কথা বলেছিলেন। আজও বিরোধী দলের মৌন সমর্থন রয়েছে তার বিপক্ষে বলে আমার মনে হয়।
তবে বর্তমান বিরোধী দল যদি আবার ক্ষমতায় যায়, তবে রাজনৈতিক ভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে হলেও তারা ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের পদ ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে আমার মনে হয়। সেদিক থেকে বাইরের দেশের কিছুটা চাপও থাকবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা প্রফেসর ইউনূসকে বড় শত্রু মনে করেন। যার কারণ, ব্যক্তিগত ঈর্ষা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা। আর কি কি কারণ থাকতে পারে, তা রাজনীতিবিদরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে ইউনূস সাহেবের আবার সময় এসেছে, নতুন করে রাজনীতি নিয়ে ভাবার। তিনি হয়তো কিছু করতে পারবেন না। কিন্তু তার দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসতেও পারে।
আমার লেখার উদ্দেশ্য এসব তথ্য-উপাত্ত নয়। আমি ভীষণ ভয়ে আছি, এসব ঝামেলায় পড়ে ড. ইউনূস আবার না মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। তাই আমার প্রার্থনা, তিনি যেন শারীরিক এবং মানসিকভাবে শক্ত থেকে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারেন।
কাকতালীয় ভাবে যারা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান, তারা মনে হয় শান্তিতে থাকতে পারেন না। ২০১০ সালের শান্তিতে নোবেল বিজয়ী লিউ ঝিয়াওবো গৃহবন্দি, ২০০৩ সালের পুরস্কারপ্রাপ্ত শিরিন এবাদির নোবেল শান্তি পুরস্কার বাজেয়াপ্ত ছাড়াও তার হিসাবও (অ্যাকাউন্ট) জব্দ করেছিল সে দেশের সরকার।
২০০১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল নেলসন ম্যান্ডেলাকে। আমরা সবাই জানি, তিনি বহু বছর জেলে থেকেছেন।
১৯৯১ সালে অং সান সূচি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান৷ তার ছেলে আলেকজান্ডার এবং কিম তার হয়ে পুরস্কারটি গ্রহণ করেন৷ ১৯৯৯ সালে অং সান সূচির স্বামী মাইকেল এরিস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান৷ মারা যাবার আগে তিনি চেষ্টা করেছিলেন, মিয়ানমারে এসে সূচির সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক সরকার তাকে দেশে প্রবেশাধিকার দেননি৷ অং সান সূচি তার ছেলেদের কাছ থেকে এখনো বিচ্ছিন্ন৷ ২২ বছর ধরে গৃহবন্দী ছিলেন অং সান সূচি৷ কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশের মানুষ এবং নিজ দলের প্রতি তার দায়িত্ব তিনি ভুলে যাননি৷
আমরাও চাই, এই কঠিন সময়ে মনোবল ঠিক রেখে ড. ইউনূস- আপনি দেশের কথা মানুষের কথা ভাববেন। কবির সুমনের তোমাকে চাই গানটির শেষের ক’টি লাইন কেন যেন আপনাকে বলতে ইচ্ছা করছে- ‘দিন বদলের খিদা ভরা চেতনায়, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দিন ঘোচার স্বপ্নে, ভীষণ অসম্ভবে,.. এই বিভ্রান্তিতে- তোমাকে চাই। ’
আমরা দেখতে চাই, পরনে সেই খদ্দরের কোর্তা অথবা গ্রামীণ কাপড়ের পোশাক গায়ে দিয়ে, মুখে সেই মিষ্টি হাসি নিয়ে মাইক্রোক্রেডিট, সামাজিক ব্যবসার মতো নতুন নতুন মানুষের জীবন উন্নয়নের ধারণা নিয়ে সারা বিশ্ব দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন ড. ইউনূস।
মনিরুল ইসলাম মনির : প্রভাষক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযূক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
amoniruk@yahoo.co.uk
বাংলাদেশ সময় : ১৩৪৯ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১২
সম্পাদনা : অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর