ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

অনন্ত সে জীবন

স্বপন চক্রবর্ত্তী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৮ ঘণ্টা, মে ১২, ২০২৩
অনন্ত সে জীবন অ্যাডভোকেট পীযূষ কান্তি চৌধুরী

জীবন অনন্ত, কোনও জীবনেরই শেষ বলে কিছু নেই। তবুও অকস্মাৎ মৃত্যু এসে সেই জীবনের দৃশ্যতঃ ইতি টেনে দিয়ে যায়।

শোক ও অশ্রুর হাহাকারে চারপাশ বিদীর্ণ হয়। তারপরে, প্রাত্যহিক সংসারের দায়ভারে মানুষের নিয়ত অভ্যস্ত হয়ে যেতে হয় ঠিকই, তবুও পারে মৃত্যু মুছে দিতে একেবারে জীবনের অনন্ত প্রকাশ ও সম্ভাবনাকে। অনন্ত জীবনের আলো থেকে যায় চিরকাল এই পৃথিবী ছুঁয়ে, এই মহাকাল ছাপিয়ে।

হঠাৎ ছোট ভাইয়ের ম্যাসেজ এল, পীযূষ দা আর নেই। আমি তখন অফিসের ব্যস্ততার মধ্যে একটা টিম মিটিং-এ ছিলাম। ম্যাসেজটা পেয়ে হঠাৎ যেন চারপাশের সব আলো নিভে গেল। মিটিং চলছে, আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি, আমি আর মিটিং-এ নেই যেন। আমার সময় যেন থমকে গেছে, না ঠিক থমকে নয়, সময় আমাকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দূর অতীতের দিকে। সেই ছাত্রবেলা থেকে আজ অব্দি- আমার যত স্মৃতি ছিল তাঁর সাথে জড়িয়ে, সবই চিত্র-পরিক্রমার মত ফিরে ফিরে আসছে।
 
স্বনামখ্যাত অ্যাডভোকেট পীযূষ চৌধুরী বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত আইনবিদের নাম শুধু নয়, তিনি ছিলেন এক সুবিশাল মহীরুহ, সমাজের জন্যে, আত্মীয় অনাত্মীয় স্বজন পরিজন নির্বিশেষে তিনি ছিলেন এক নিবিড় ভরসার আশ্রয়। এমনই এক আশ্রয়- যা থাকলে সঙ্কটে মানুষের মনে বল বাড়ে, বিপদের দিনে প্রাণে ভরসা জাগে। সৈকত নগরী কক্সবাজার শহরেই তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তাঁর পিতামহ ও পিতাও ছিলেন কক্সবাজারের প্রথিতযশা আইনজীবী। কক্সবাজার আইনজীবী সমিতির তিনি সাধারণ সম্পাদক, সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন অনেকবার। ছিলেন নানা সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ও দায়িত্বে।

একাত্তরের প্রথম দিকেই হানাদার বাহিনীর হাতে তাঁর পিতা শহীদ হন। নিজেও যুক্ত হলেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। এর মধ্যেই পরিবারের সব দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁরই কাঁধে। হাসিমুখে তিনি পরিবারের সব রকমের দায়িত্ব পালন করেছেন সমস্ত জীবন। সেইসাথে হয়ে উঠলেন কক্সবাজারের অসংখ্য মানুষের নয়নের মণি, ভরসার শেষ আশ্রয়। কতভাবে যে আমরা সকলেই তাঁর কাছে ঋণী আছি তা ঠিক বলে শেষ করা যাবে না। কতভাবে যে এই শহরের মানুষ তাঁর কাছে আশ্রয় পেয়েছে, সে গল্পেরও কোন সীমা-পরিসীমা নেই। আমি তো প্রায়ই সবারই কাছে বলে থাকি, ‘সমুদ্র তীরে তিনি ছিলেন আরেক সমুদ্র’। এমনই বিশালতা ছিল তাঁর মমতাভরা, স্নেহময় অন্তরের।

বিভিন্নভাবে নিয়মিত খোঁজখবর নিতাম তাঁর প্রাত্যহিক অবস্থার। মনে মনে ভেবেছি অনেকবার, তাঁর কথা লিখব নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে। হয়ে ওঠেনি। আজ যখন লিখছি, তিনি আর নেই। সত্যিই কি তিনি নেই! প্রথমেই বলেছি, জীবন অনন্ত। তার শেষ বলে কিছু নেই। তাঁর মত মহীয়ান জীবন তো অপার অনন্তই। সে মহিমময় জীবনের আলো এই মহাবিশ্বের সমস্ত নক্ষত্র ছুঁয়ে চিরকাল থেকে যাবে, সন্দেহ নেই।  

পরবাস থেকে যখনই কক্সবাজারে গিয়েছি, প্রথমে যাঁর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ করেছি তিনি পীযূষ দা, পরিবারের অন্য সবার মত আমিও তাঁকে ডাকি- দাদামণি। তাঁর আশীর্বাদের হাত ছিল আমার মাথায় চিরকাল। মনটা বড্ড মুষড়ে পড়েছে। আরেকবার দেখা হলো না তাঁর সাথে, আর কখনও দেখা হবে না ভাবতেই প্রাণের গভীরে এক তীব্র সুনামির ঢেউয়ের আভাস পাচ্ছি।  

আমাদের সবার প্রিয় দাদামণির শ্রীশরীর সারা শহরের মানুষের হাত ধরে শ্মশানের দিকে যাবে, অনন্তের পথে সে যাত্রায় মনে মনে সামিল হয়ে রইলাম। জীবন তো এমনই। কখন কাকে কিভাবে কোথায় নিয়ে যাবে কেউই তো জানে না। মনে মনে তাঁর চরণ ছুঁয়ে বলি- ভালো থাকবেন দাদামণি, ভালো থাকবেন ওইপারেও। দেখা তো হবে আবার আমাদের সবারই সেইপারে।
 
লেখক: আমেরিকা প্রবাসী সাহিত্যিক ও আইনজীবী

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।