ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

‘ফোন রেডিয়েশন’ প্রযুক্তির মরণ ফাঁদ

আলম শাইন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৭ ঘণ্টা, মে ২১, ২০২৩
‘ফোন রেডিয়েশন’ প্রযুক্তির মরণ ফাঁদ

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যুগটা বিজ্ঞানের। বিজ্ঞানের অবদানেই আজ বিশ্ববাসী হরেকরকম সুবিধাদি ভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন।

সেই সুবাদে বলা যায়, ঊনবিংশ থেকে একবিংশ শতাব্দীর মানুষ অনেকটাই ভাগ্যবান আগের শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করা মানুষের তুলনায়। ঊনবিংশ-একবিংশ শতাব্দীর মধ্যে জন্মগ্রহণ করতে পেরে আমরা গর্বিত তাই। কারণ এ সময়েই আমরা পেয়েছি রেডিও থেকে শুরু করে হালের ফোর-জি কিংবা ফাইভ-জি মোবাইল ফোন পর্যন্ত। বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিকের সমন্বয়ে আমরা যা পেয়েছি তা সত্যিই বিস্ময়কর বটে। আমাদের প্রাপ্তির ছোট্র উদাহরণটি হচ্ছে, বিজ্ঞানের কল্যাণেই মানুষ পৃথিবী ছেড়ে মহাশূন্যে পঁইপঁই করে ঘোরার সুযোগ পেয়েছে। এটি মানবজাতির জন্য বিশাল এক প্রাপ্তি। বিজ্ঞানের কাছে এ প্রাপ্তি অস্বীকারের কোন উপায় নেই।  

শুধু তাই-ই নয়, বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিকের কারণেই আজ আমরা দুর্যোগ আবহাওয়ার আগাম তথ্যাদি পেয়ে থাকি, যাতে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির কবল থেকে রেহাই পান আমজনতাসহ আমাদের সহায়-সম্বলও। পৃথিবীর আরেক প্রান্তে কী ঘটেছে নিমেষেই খবর পেয়ে যাচ্ছি আমরা। সবকিছু মিলিয়ে আমরা বলতে পারি, এসব শুধু বিজ্ঞানের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে; অন্যথায় আদিম যুগের মানুষের মতো কাটাতে হতো আমাদের। গুহায় বসবাস কিংবা লতাপাতা পরিধান করে কাঁচা খাবারাদি খেয়ে জীবন যাপন করতে হতো। সোজা কথা আমাদের সভ্য হতে শিখিয়েছে বিজ্ঞান।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, বিজ্ঞানের আশীর্বাদে মানবজাতির গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে যেমন, তেমনি আয়ু হ্রাসও পাচ্ছে দ্রুত। বিজ্ঞানের অধিক হিতকর কাজে এক ধরনের অদৃশ্য দূষণের কবলে পড়ে বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মৃত্যুর পথে দ্রুত পা বাড়াচ্ছেন। যা খুব সহজেই টের পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ এ দূষণ হচ্ছে সম্পূর্ণ অদৃশ্য দূষণ। যে দূষণ খালিচোখে নজরেও পড়ছে না। এমনকি অনুভবও করা যাচ্ছে না, কারণ এটি থাকছে একেবারেই অদৃশ্য। এর প্রতিক্রিয়াও দীর্ঘমেয়াদি। আর সেই দূষণটি হচ্ছে ‘তড়িৎ চৌম্বকীয় দূষণ’। যার উৎস অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রপাতির সুবিধা নিতে গিয়ে মানুষ লিকোমিয়া, ব্রেইন টিউমার এবং ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ব্যাপক হারে। এছাড়াও এই দূষণের ফলে স্নায়ুতন্ত্রে সমস্যা, অবসন্নতা, স্মরণশক্তি লোপ, হজমে বিপাক, অল্প বয়সেই বৃদ্ধ এবং অকালমৃত্যু ঘটছে।  

তড়িৎ চৌম্বকীয় দূষণের শিকার শুধু এ দেশের মানুষই হচ্ছেন না, হচ্ছে সমগ্র বিশ্ববাসীই। তবে বেশি দূষণের শিকার হচ্ছেন যারা তড়িৎ বিকিরণ ক্ষেত্রে কর্মরত রয়েছেন। যেমন- পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত টেকনিশিয়ান, বিদ্যুতের লাইনম্যান, টেলিফোন বা সেলফোন টাওয়ারের ইলেকট্রিশিয়ান, ইলেকট্রিক রেলওয়ের অপারেটর। এসব পেশার লোকেরা অন্যান্য পেশায় কর্মরত লোকের তুলনায় দশ গুণ বেশি লিউকোমিয়াসহ ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে লস এঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষক ‘সুসান প্রিন্সটন মার্টিন’ ব্যাপক গবেষণা করে এর সত্যতা যাচাই করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘তড়িৎ চৌম্বকীয়নে শিশুরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে শিশুর মানসিক বিকাশে যেমনি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি শারীরিক বর্ধনশীলেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। উদাহরণ হচ্ছে, আমরা খবরে কাগজে মাঝে মধ্যে দেখি, বালকের বয়স দশ বছর অথচ দেখাচ্ছে পঞ্চাশ বছরের মতো। কপালের ভাঁজ কিংবা ঝুলে যাওয়া চামড়ায় বার্ধক্য ধরা পড়ছে। আসলে বয়স খুবই কম। পক্ষান্তরে আবার বেঁটে বামুনের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশুরা শারীরিক বিকাশে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে; যার ভূরি ভূরি প্রমাণও রয়েছে।

পরিসংখ্যান মোতাবেক জানা যায়, বর্তমান বিশ্বের দেড় শতাধিক কোটি মানুষ তড়িৎ চৌম্বকীয়নের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে যারা সেলফোন ব্যবহার করছেন তাদের প্রত্যেকেই এ দূষণের কবলে পড়ছেন। আর যুব সম্প্রদায়েরা তড়িৎ দূষণের শিকার হচ্ছে বহু গুণ বেশি। সেলফোনে তারা প্রতিনিয়ত গান শুনছে হেয়ারফোন কানে ঠেসে ধরে, ঘন্টার পর ঘণ্টা প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলছে; খেলছে গেমও। তার ওপর আবার অনবরত পড়ে থাকে ফেসবুকে। এতে করে ফোনসেটের অদৃশ্য তরঙ্গ যে তাদের কর্ণ প্রদাহসহ ব্রেইন টিউমার সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা তারা ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছে না। বিশেষ করে রাতের আঁধারে যারা ফেসবুকে পড়ে থাকেন, তাদের জন্য রয়েছে মহাবিপদ সংকেত। ফোনের নীল অলোকরশ্মি চোখসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে যা সহজেই তারা টের পাননি। এ চিত্র শুধু আমাদের দেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বের তরুণ সমাজে এটি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

উল্লেখ্য, হালে শুধু তরুণরাই নয়, বয়স্করাও ফেসবুকে আকৃষ্ট হয়ে নীল রশ্মির কোপানলে পড়ছেন। সেলফোনের তড়িৎ চৌম্বকীয়ন নিয়ে এ পর্যন্ত বহু গবেষণাও হয়েছে। ফলাফল বরাবরই একই রকম, মোটেই সন্তোষজনক নয়। সম্প্রতি ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিন ও কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গবেষণায় দেখা যায়, সেলফোন থেকে বের হওয়া মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন মানুষের মস্তিষ্কের ডিএনএ অণুকে ৫০ শতাংশ খণ্ডিত করছে। যার ফলে মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়ে যাচ্ছে আশংকাজনক হারে। গবেষণায় আরও দেখা যায়, যারা নিয়মিত সেলফোন ব্যবহার করেন, তাদের প্রত্যেকেই তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে চোখ, মুখ, নাক, গলা এমনকি মস্তিষ্কে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত করছে চোখের নরম টিস্যুকেও। সমীক্ষায় জানা যায়, দশ বছরের বেশি সময় ধরে যারা সেলফোন ব্যবহার করছেন, তাদের ব্রেইন টিউমার হওয়ার আশংকা অন্যদের চেয়ে ৪০ শতাংশ গুণ বেশি।  

আমরা জানতে পেরেছি ২০১০ সালে সুইডেন মেডিকেল ইন্সটিটিউট প্রায় এগারো হাজার সেলফোন ব্যবহারকারীর ওপর এক সমীক্ষা চালিয়েছে। সমীক্ষার ফলাফল থেকে জানা যায়, ‘সেলফোন ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারী তড়িৎ চৌম্বকীয় দূষণের শিকার হয়ে নিয়মিত ক্লান্তিবোধের পাশাপাশি মাথাব্যথা রোগে ভুগছেন’। এ গবেষণার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকরাও। তারা তৎসঙ্গে সতর্কবাণী জুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘তড়িৎ চৌম্বকীয়নের কারণে শিশুদের দেহকোষ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং জেনেটিক ড্যামেজও ঘটছে। ’ 

ভয়ংকর এ দুর্যোগের খবরের ওপর ভিত্তি করে ইউনিভার্সিটি অব পিটার্সবার্গ ও ক্যান্সার ইন্সটিটিউটের পরিচালক  ড. রোনাল্ড হেবারম্যান গবেষণা করে তার সংস্থার প্রায় হাজার তিনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তড়িৎ চৌম্বকীয়নের ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। তিনি সবাইকে জানিয়ে দেন, সেলফোন শরীর থেকে যেন খানিকটা দূরত্বে রাখা হয় এবং অবশ্যই যেন তা শিশুদের নাগালের বাইরে রাখা হয়, সেই বিষয়েও দৃষ্টি দেওয়ার কড়া হুঁশিয়ারি সংকেত দেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘রাতে শোয়ার সময় সেলফোন যেন তিনগজ দূরত্বে রাখা হয়। ’

গত দশক ধরেও আমরা জেনে এসেছি শুধু পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার ফলেই এ ধরনের অদৃশ্য দূষণ ঘটছে। উপরোক্ত বিষয়ের কারণে যে তড়িৎ চৌম্বকীয় দূষণ ঘটতে পারে তা আমাদের অনেকেরই অজানা ছিল। আমরা আধুনিক যন্ত্রপাতির সুবিধা ভোগ করে সবাই খানিকটা মজে গিয়েছি সত্য, কিন্তু এটি যে মানবজাতির জন্য প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়াবে তা হয়তো ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবেনি আগে, যে ভাবনাটা এখন ভাবতে হচ্ছে আমাদের। সেই ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বলতে হচ্ছে যে, সেলফোন বন্ধ করে নয় বরং উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে অথবা প্রকৃতি প্রদত্ত বায়ু তরঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে তড়িৎ চৌম্বকীয় দূষণের কবল থেকে বিশ্ববাসীকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হোন। সেই অনুরোধটিই জানাচ্ছি আমরা সেলফোন কোম্পানি এবং সেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে। আশা করি বিষয়টি মাথায় নিয়ে মানবকল্যাণে এগিয়ে আসবেন, সেই প্রত্যাশাই রইল আমাদের।  

লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।