হুমায়ুন আহমেদের দেয়াল উপন্যাসের অংশ বিশেষ অ্যটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতের নজরে আনার পর আদালত এ ব্যাপারে যে পরিশীলিত একটি নির্দেশনা দিয়েছেন, তা নিয়ে দেখলাম অনেকেই কথা তুলেছেন।
বলা হচ্ছে, আদালত এ ব্যাপারে খবরদারি করতে পারেনা।
মজার ব্যাপার সংবিধানের ব্যাখ্যার জন্যেও যেখানে আমরা আদালতের শরণাপন্ন হই, যে কোন সাংবিধানিক ব্যাখ্যার জন্য রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সংসদ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হন, এবং সংবিধানে আদালতকেই এর কর্তৃপক্ষ নিযুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেখানে একটি বই নিয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিতর্ক-সমস্যা এড়াতে আদালতের কাছে যাওয়াতে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে, তা কিন্তু শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমরও সুনির্দিষ্ট করে বলেননি! এই একটি বই বা উপন্যাস কী সংবিধানের চেয়ে বড় কিছু? হুমায়ুন আহমেদ যে বদরুদ্দীন উমরের পছন্দের লেখক তালিকায় ছিলেন, তাও এর আগে কিন্তু আমাদের জানার সুযোগ হয়নি।
সারা দুনিয়াতেই ঐতিহাসিক ঘটনাবলী আদালতে বিচার-বিবেচনার জন্যে গেলে বিচারের রায়ের মাধ্যমে যে দলিল তৈরি হয়, পরবর্তীতে সেটি স্বীকৃত রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহারের একটি রেওয়াজ প্রচলিত আছে। এর একটা দৃষ্টান্ত বলি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে গণহত্যা নিয়ে যে সব বই পড়ানো হয়, তাতে বাংলাদেশ নিয়ে কিছু পড়ানো হয়না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিভূক্ত আন্তর্জাতিক গ্রন্থগুলোর কোনটিতেই কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যার উল্লেখ বা বিবরণ নেই। এমনকি আর্মেনিয়ার গণহত্যায় যেখানে সাড়ে তিন হাজারের মতো লোক নিহত হয়েছিলেন, সে গণহত্যার ঘটনাক্রমও কিন্তু এসব বইয়ে অন্তর্ভূক্ত আছে।
এ বিষয়টি সিডনিতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে সংশ্লিষ্ট একজন শিক্ষকের নজরে আনলে তিনি এর জবাবে বলেন, বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার ঘটনাটির আসলে কোন আইনানুগ স্বীকৃত আদালতে বিচার হয়নি। যদি কখনো এর বিচার হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট আদালতের রায়ের মাধ্যমে এর একটি রেফারেন্স তৈরি হবে। খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তখন সেই রেফারেন্সের আলোকে বিষয়টি সংযুক্ত-সন্নিবেশিত হবে এ সংক্রান্ত গ্রন্থরাজি এবং পাঠ্যসূচিতে।
আজ দেশে এই বিচার প্রক্রিয়াটি শুরুর পর এর বিরুদ্ধে বোধগম্য পক্ষগুলোর উতালা অবস্থা দেখে কিন্তু আমার সেই শিক্ষকের কথা পড়ে। এখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কাছে বিচ্ছিন্নভাবে যার যার মতো এর বিবরণ-গল্প আছে। এসব শুনে-পড়ে আমরা কেউ বিশ্বাস করি অথবা কেউ করিনা। কিন্তু এখানে এ সংক্রান্ত কিছু মামলার বিচার ঠিকমতো হলে, এসবের রায়কে কেন্দ্র করে যে রেফারেন্সটি তৈরি হবে তা কিন্তু আগামিতে দেশে-বিদেশে সুনির্দিষ্ট একটি ডকুমেন্ট হিসাবে উদ্ধৃত-ব্যবহার-মূল্যায়িত হবে। তাই এ বিচার নিয়ে একাত্তরের ঘাতকচক্র তাদের দোসরদের মূল ভয়টি সেখানেই।
পচাত্তরের পনের আগষ্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাক্রম নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। এ বইগুলোর অনেকগুলোর তথ্যই একটির সঙ্গে আরেকটি সাংঘর্ষিক। খবর সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজানের নামে ছাপা ‘আমি রাসেল বলছি’ বইটির কথা হয়তো অনেকের মনে আছে। একসময় বইটি বহুল পঠিত-মুদ্রিত হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারে আসামি-সাক্ষীদের বর্ণনা-জেরার মাধ্যমে রাসেল হত্যাকাণ্ডের যে বৃত্তান্তটি উঠে এসেছে, হত্যা মামলার রায়ের নথি প্রকাশের পর ‘আমি রাসেল বলছি’ গ্রন্থের রূপক কাহিনীটি হারিয়ে গেছে।
‘বিষাদ সিন্ধু’ লেখার জন্যেও মীর মোশাররফ হোসেন কারবালার ময়দানে ছিলেন না। বিয়োগান্তক ঘটনাটি নিয়ে পুঁথিসহ প্রাপ্ত নানা সাহিত্য, লোকমুখে শোনা গল্প, এসবের মাধ্যমে লেখা উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’ নিয়ে বাংলাদেশে কখনো কথা উঠেনি। অথচ আমি ইরাকের কারবালা’য় ইমাম হোসেনের(রাঃ) সমাধি পরিদর্শনে গিয়ে সেখানকার মুদ্রিত নথিপত্রের সঙ্গে ‘বিষাদ সিন্ধু’র অনেক অমিল দেখেছি। কিন্তু এসব নিয়ে আমাদের এখানে কখনো কোন প্রশ্ন না ওঠার কারন ঘটনাটির কোন আদালতে বিচার হয়নি বা সর্বজন অনুসরনীয় কোন রেফারেন্সও তৈরি হয়নি।
‘দেয়াল’এর বিষয়টি লেখকের প্রতি মর্যাদা উল্লেখপূর্বক আদালতে যে ভাষায় উত্থাপিত হয়েছে, হুমায়ুন আহমেদকে সম্মান জানিয়ে আদালত যে ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন, তা এর আগে বাংলাদেশে আর কোন লেখক বা গ্রন্থের বেলায় হয়েছে কীনা তা আমার জানা নেই।
বাংলানিউজের তথ্য অনুসারে এ ব্যাপারে আদালতের ভূমিকার বিষয়টি স্বয়ং হুমায়ুন আহমেদও পছন্দ করেছেন। নিউইয়র্কে থাকাকালীন পাওয়া কোন একটি বিদেশি রেফারেন্স গ্রন্থের তথ্য যথেষ্ট যাচাই না করে ‘দেয়াল’এ ব্যবহার করায় যেখানে অনুশোচনায় ভুগছেন খোদ হুমায়ুন আহমেদ, সেখানে বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন প্রশ্ন তোলার উদ্দেশ্য নিয়েইতো প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ পুরো বিষয়টি জাতির পিতার ভাবমূর্তি সংশ্লিষ্ট। ভারতে মহাত্মা গান্ধী বা পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ব্যাপারটিওতো স্পর্শকাতর। বাংলাদেশেই শুধু জাতির পিতার বিষয়টি নিয়ে ঐকমত্যের অভাবের সুযোগে হুমায়ুন আহমেদও বিদেশি রেফারেন্সে ‘দেয়াল’ লিখে ফেলেছিলেন যে, জাতির পিতা হত্যাকান্ডে তার টুঙ্গিপাড়ার গ্রামের মানুষও খুশিতে তার গ্রামের বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়ির সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়েছিল! যা আমরা যারা টুঙ্গিপাড়া গিয়ে বিভিন্ন সময়ে সেখানকার গ্রামবাসী, এমন কী স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গেও কথা বলে কখনো আবিষ্কার করতে পারিনি!
না শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমর বাম রাজনীতির লোক, ‘জাতির পিতা’য় বিশ্বাসী নন। শেখ মুজিব বিরোধী ঘরানার লোক হওয়াতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা গ্রন্থটি সত্যনিষ্ঠ করতে আদালতের উদ্যোগকেও তাই অপছন্দ করেছেন তিনি!
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৫ ঘন্টা, ১৮ মে ২০১২
এমএমকে/