ব্যারিস্টার মওদুদকে সর্বশেষ চারিত্রিক সনদটি দিয়েছেন তার সাবেক নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পতিত এই স্বৈরশাসক সম্প্রতি এক সভায় বলেছেন, ‘তিনি(মওদুদ) আমার উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
আমরা যখন এরশাদকে নামানোর আন্দোলন করছিলাম, ‘মাইনকার চিপায়’ পড়ে এরশাদ যখন পদত্যাগের ঘোষণা দেন, তখনও উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ টেলিভিশনে আমাদের সংবিধান বোঝাচ্ছিলেন! এরপর এরশাদের পদত্যাগ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে যখন গণ অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেল, দেশের মানুষজন রাস্তায় নেমে এরশাদের দালালদের খুঁজছিল, তখন সেই মওদুদ অতি বিচক্ষণতায় হাওয়া হয়ে যেতে পেরেছিলেন! সে কারণে এখনও মওদুদের মুখে যখন মানুষ সংবিধানের বয়ান শুনে, ঘৃণা জমে বৈকি!
১৯৯১-৯৬ সালের পার্লামেন্টেও মওদুদ ছিলেন এরশাদের দলে। সেই পার্লামেন্টে মওদুদ কী ভাষায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বলতেন, তা অনেকের মনে আছে! সেই মওদুদই আবার মিশে যেতে সমর্থ হলেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে। ২০০১ সালে বিএনপি সরকারের আইনমন্ত্রী থাকাকালে সবার আগে যা করেন তা হলো, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার ঠেকানো! মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে বঙ্গবন্ধু’র স্নেহধন্য মওদুদ এভাবেই জাতির পিতাকে তার প্রতিদান দিয়েছেন!
প্রথমে জিয়া পরে এরশাদ এবং সবশেষ খালেদার সরকারে তার যে প্রতিভার (!) মূল্যায়ন হয়েছে, এর বিশেষ কারণ আইন বিষয়ে তার কুটবুদ্ধি! আজ দ্রুত বিচার আইন নামের যে বিতর্কিত মামলায় বিএনপিসহ ১৮ দলের নেতারা কারাগারে, এই আইনটিও মওদুদের মস্তিষ্কপ্রসূত! কুট অথবা দুষ্ট বুদ্ধির জোরে তিনি তখন এ মামলায় চার্জশিটের পর জামিনের বিধান পর্যন্ত রাখেননি!
মওদুদের এই অবদানটি (!) আমাদের নজরে এনেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনটি সর্বশেষ এপিএস-ভায়া-হয়ে-জড়িত অর্থ কেলেংকারিতে কলঙ্কিত! তারই গঠন করা তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তিনি সর্বশেষ নিজেকে নির্দোষও ঘোষণা করেছেন! কিন্তু যে দাগ যেখানে যা পড়ে, যতই ঘষাঘষি- ধোয়াধুয়ি করা হোক, তা কি পাবলিকের মন থেকে অত সহজে যায়? সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যখন বদনাম মাথায় নিয়ে ঝিকাতলার বাড়ির ঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের আরেকটি সমস্যা দেখা দিয়েছিল! তাহলো আজ সুরঞ্জিত মওদুদ প্রতিভার(!) যে দিকটি তুলে ধরেছেন, তা সময়মতো, ঠিকমতো তুলে ধরার মতো দ্বিতীয় ব্যক্তিটিও যে আওয়ামী লীগের নেই! কিন্তু এখন সুরঞ্জিতদের দায়িত্বটা কি? আইনটির ত্রুটির যে দিকটি তুলে ধরা হলো, তা কি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার দরকার না? পার্লামেন্টে কিন্তু সে জোর তাদের ভীষণভাবে আছে। এখন যদি এই ত্রুটির সংশোধন না করা হয়, তাহলে কিন্তু এই দাদারাও ভবিষ্যতে এর ফেরে পড়বেন। কারণ `এই দিনই দিন না আরও দিনআছে!` খালেদা জিয়ার চোখমুখে প্রতিশোধের স্ফুলিঙ্গ দেখছেন না শ্রীমান সুরঞ্জিত?
আমাদের দেশে সেই বিশেষ ক্ষমতা আইন থেকে শুরু করে নানা আইন তৈরির সময় এমন দুষ্টের দমন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তাসহ নানা ভালো ভালো কথা এর মুখবন্ধে বলা হয়েছে। কিন্তু মনের ভিতর যে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের বিষয়টি যে সব সময় বড় থাকে, সেটিও কোন লুকোছাপার বিষয় না। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশের আইন-বিচার সবকিছুই যেন এখনও সমাজের দুর্বল লোকজন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জব্দ ও শায়েস্তা করার জন্য কাজ করে!
বিশেষ ক্ষমতা আইনে প্রভাবশালী কাউকে ধরলে ভালো পেমেন্টের উকিল ধরে রিট মামলা দায়ের করে সে লোকটি বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল যারা এই আইনের ফেরে পড়েন, সে রকম উকিল ধরতে পারেন না, এমন কত শত শত লোক বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে যে আছে, তাদের খোঁজ কে রাখে? আইনে আছে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক ব্যক্তিদের একটি নির্ধারিত সময় পরপর হাইকোর্টে হাজির করে তাদের আদালতকে দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের হাইকোর্টে যারা যান, তারা মাঝে মাঝে এমন দৃশ্য দেখেন। এক সঙ্গে কোমরে দড়ি বাঁধা অনেক মানুষকে হাজির করা হয়েছে কোর্টে! এই একই মামলায় প্রভাবশালীরা মুক্তি পায়, এরা কেন পায় না, তা নিয়ে দায়িত্বশীল(!) কারও কিন্তু বিবেক কাঁদে না! এদেশে একদল আইনজীবী সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মেরে বা বিচারকের এজলাসের উদ্দেশে ট্রে ছুঁড়ে মেরেও মাফ পান, সাধারণ মানুষের কেউ এমন অপরাধ করলে কী মাফ পাবেন? পাঁচ হাজার টাকা ব্যাংকঋণ নিয়ে তা শোধ না করতে পারায় সার্টিফিকেট মামলায় দরিদ্র কৃষককে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু পাঁচ কোটি টাকা ব্যংকঋণ নিয়ে যে মেরে দেয়, তাকে রক্ষার অনেক কায়দাকানুন চালু আছে দেশে!
গাড়ি পোড়ানোর অবিশ্বাস্য মামলায় বিএনপি নেতাদের ধরা হয়েছে। যাদের ধরা হয়েছে, তারাইতো সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ফেরিঘাটের ভাতের হোটেলের প্লেট চুরির মামলা দিয়েছিলেন! এসব ঘটনাতেই স্পষ্ট, দেশ এসব রাজনীতিকদের হাত ধরে এগোচ্ছে না। দুনিয়া বদলাচ্ছে। কিন্তু আমাদের অবলম্বন এসব রাজনৈতিক নেতাদের রুচি বদলাচ্ছে না! এবং এসব কোনো ডিজিটাল আচরণও নয়। সবই এনালগ! পুরনো এনালগ! দেশে বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিরুদ্ধে সমলোচনা করে সব দল ক্ষমতায় যায়। ক্ষমতায় গিয়ে বদলায় না! দ্রুত বিচার আইনের মতো আরও কঠোর আইন করে! এই আইনে এমন বিধান রাখা হয়েছে যে, আত্মসমর্পণের জন্য বিচারিক আদালতে যেতে হয়। হাইকোর্টও বিভক্ত আদেশে তাদের বিচারিক আদালতে যেতে বলেছে। বিচারিক আদালত তাদের পাঠিয়ে দিয়েছে জেলে! যেখানে একশ দিনেও সাগর-রুনির হত্যা রহস্যের উদঘাটন হয় না, সেখানে অকল্পনীয় দ্রুতগতিতে দেওয়া হয়ে গেছে এই মামলার চার্জশিট! আর মওদুদ আহমদ তো সারাজীবন ক্ষমতায় থাকবেন ভেবে বিধান করে রেখেছিলেন, এই মামলায় চার্জশিট হয়ে গেলে আর জামিন হয় না! আর মওদুদ আহমদ আইন করেছেন বলে আনন্দে আছেন এখনকার নেতারা! যেন তারাও ক্ষমতায় থাকবেন সারা জীবন!
এসব রাজনৈতিক জেদাজেদি বন্ধ না হলে কিন্তু আগামীতে আরও খারাপের দিকে যাবে দেশ। দেশে আইন কমিশন আছে। এসব আইনের ত্রুটিগুলো নিয়ে সেখানে যান, হাইকোর্টে, সংসদে যান। মওদুদ আহমদ আমাদের কোনো ধোয়া তুলসি চরিত্র না। যারা তার করা আইনের বলে দাপট দেখাচ্ছেন, তারাও ধোয়া তুলসীপাতা নন। সময় থাকতে সতর্ক হোন, নিজেদের সংশোধন করুন।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১১৫৬ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১২
সম্পাদনা: এমএমকে- mmenonk@gmail.com;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর