ঢাকা: জনগণের সেবক পুলিশ মাঝেমধ্যেই মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে হাজির হচ্ছে জনগণের সামনে। সর্বশেষ গত শনিবার রাজধানীর আগারাঁওয়ে তিন ফটো সাংবাদিক পিটিয়ে আরো একবার জনবিরোধী কর্মকাণ্ডের ন্যক্কারজনক নজির গড়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও অঞ্চলের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) শহীদুল ইসলাম।
অপরদিকে দায়িত্ব পালনে একনিষ্ঠ থেকে জীবন দেওয়ার অবিস্মরণীয় নজিরও গড়েছেন তারই কোনো কোনো পূর্বসুরি।
১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় জীবন দেন পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) সিদ্দিকুর রহমান। টঙ্গি-কালিগঞ্জ মহাসড়কে ব্যারিকেড আগলে থাকা কনস্টেবল মো. মামুনুর রশিদ পিষ্ট হন ডাকাতের গাড়ির চাকায়। চট্টগ্রামে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাকাত ধরে অনন্য নজির গড়েন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. বাবুল আক্তার।
তবে আত্মত্যাগের এসব অনন্য উদাহরণের চেয়ে শহিদুলের সহকর্মীরা আইন অপব্যবহারে ধিক্কারজনক কাণ্ডই ঘটাচ্ছেন হরহামেশা। অতীত ঘাঁটলে এমন ঘটনার নজির মিলবে ভুরি ভুরি।
চাপাতি দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র কুপিয়ে পুলিশের সুনাম নষ্ট করেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হেলাল উদ্দিন। বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকসহ এমিপদের পিটিয়ে ন্যক্কারজনক নজির গড়েন এডিসি হারুন অর রশিদ ও এসি বিপ্লব কুমার। খেলার মাঠে সাংবাদিক পেটান ডিসি আলী আকবর, পুলিশ সার্জেন্ট আনোয়ার ও এনামুল হক। চার দলীয় জোট সরকারের আমলে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠেন এসপি কোহিনুর মিয়া।
পুলিশের এই মারমুখী আচরণকে ফৌজদারি অপরাধ মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। রাষ্ট্রীয় সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথেচ্ছ আচরণকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
তবে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে পুলিশকে ব্যবহারের কারণে মানুষ সংবিধানের সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা এও মনে করছেন, সাময়িক বরখাস্ত, বদলি, আর কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহারের মতো বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা এসব সমস্যার সমাধান নয় মোটেও। এজন্য সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা হওয়া প্রয়োজন।
বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় জীবন দেন এএসআই সিদ্দিকুর
তখনো ভোরের আলো উঁকি দেয়নি। ইতিহাসের বর্ববরতম হত্যাকাণ্ডের নির্মম পরিসমাপ্তি হলো বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। সেদিনের সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র শেখ রাসেল। নৃশংস আক্রমণে বাদ যাননি রাজনীতির বাইরে থাকা একেবারে অন্তপুরের নারীরাও।
ইতিহাসের মহানায়ককে রক্ষা করতে ১৫ আগস্টের সেই কালরাতে এগিয়ে এসেছিলেন মাত্র তিনজন বীরপুরুষ। তাদের মধ্যে একজন হলেন পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) সিদ্দিকুর রহমান। নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে সে রাতে এএসআই সিদ্দিকুর তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
ডাকাতের গাড়িতে পিষ্ট কনস্টেবল মামুন
রাত আনুমানিক আড়াইটা। গোপন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে, একদল ডাকাত অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ সময় পুলিশ তাদের ধরতে গেলে উপস্থিতি টের পেয়ে টঙ্গীর দিকে পালানোর চেষ্টা চালান তারা। তাদের আটক করার লক্ষ্যে টঙ্গী-কালিগঞ্জ মহাসড়কে ব্যারিকেড দেয় পুলিশ। কিন্তু ডাকাতরা ব্যারিকেডের ওপর গাড়ি চালিয়ে দিয়ে কনস্টেবল মো. মামুনুর রশিদকে হত্যা করে।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাকাত ধরেন এএসপি বাবুল
২০১১ সালের এক রাতে হাটহাজারীর ধলই গ্রামে অবস্থান নেওয়া ডাকাত দলকে ঘিরে ফেলে পুলিশ। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ডাকাতরা গুলি ছোঁড়ে। তৎক্ষণাৎ ওই সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. বাবুল আক্তার তার পিস্তল থেকে ছয় রাউন্ড ও তার নির্দেশে অন্য অফিসাররা ৪১ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১১ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে।
অসম সাহসী এ তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে ২০১২ সালের পুলিশ সপ্তাহে বাংলাদেশ পুলিশ পদকে ভূষিত করা হয়।
ছাত্র কোপানো ওসি হেলাল
অপরদিকে ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এক ছাত্রকে থানার ভেতরে রামদা দিয়ে কুপিয়ে আহত করেন খিলগাঁও থানার সাবেক ওসি হেলাল উদ্দিন। কিছুদিন পর কাদেরকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে উচ্চ আদালতের নির্দেশে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয় হেলাল উদ্দিনকে।
পুলিশের ‘নির্যাতনের শিকার’ কাদের গত ২৩ জানুয়ারি ওসি হেলালের বিরুদ্ধে খিলগাঁও থানায় মামলা করেন। ‘মিথ্যা’ অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ হেফাজতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এরপর ২ এপ্রিল নির্যাতনের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরের করা মামলায় খিলগাঁও থানার সাবেক ওসি হেলাল উদ্দিনকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন আদালত। জামিন নাকচের আদেশে বিচারক বলেন, ‘আসামির বিরুদ্ধে কাদেরের মামলা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। আইন রক্ষকের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ গুরুতর। মামলায় অজামিনযোগ্য ধারা রয়েছে। এ পর্যায়ে তাই তার জামিন আবেদন নাকচ করা হল। ’
এমপি পেটানো এডিসি হারুণ, এসি বিপ্লব
৬ জুলাই বিরোধী দলের ডাকা হরতাল চলাকালে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের নেতৃত্বে সংসদ ভবনের সামনের রাস্তায় বের হওয়া বিএনপির এমপিদের মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়েন এডিসি হারুন অর রশিদ ও এসি বিপ্লব কুমার। শরীরের পোশাক খুলে ফারুককে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেন তারা।
এমনকি দৌড়ে সংসদ সদস্য ভবনে (ন্যাম ভবনে) গিয়েও নিস্তার পাননি ফারুক। সেখান থেকে টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় এন ফের তাকে পেটায় হারুন-বিপ্লব বাহিনী। এক পর্যায়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। গালিগালাজ করা হয় অকথ্য ভাষায়।
খেলার মাঠে সাংবাদিক পেটানো পুলিশ
২০০৬ সালের ১৬ এপ্রিল। চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ চলাকালে বিনা উস্কানিতে সাংবাদিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ। তৎকালীন ডিসি (পোর্ট) আলী আকবর কিলঘুষি মেরে ষাটোর্ধ ফটো সাংবাদিক জহিরুল হককে আহত করেন। ভেঙে যায় তার ক্যামেরাও। আকবরের নির্দেশে পুলিশ সার্জেন্ট আনোয়ার ও এনামুল হকও সাংবাদিকদের নির্যাতন করেন। সার্জেন্ট আনোয়ারের রাইফেলের বাঁটের আঘাতে মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত পান ফটো সাংবাদিক অনুরূপ টিটু। পুলিশের নির্বিচার লাঠিপেটায় আরো আহত হন সাংবাদিক শামসুল হক টেংকু, রুহুল আমীন রানা, সাইদুর রহমান শামীম, অভিজিৎ ও আরিফুর রহমান বাবুসহ ২০ জন।
জোট আমলের এসপি কোহিনুর
২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল পৌরসভার নির্বাচনে তৎকালীন ময়মনসিংহের এসপি কোহিনুর মিয়ার বেপরোয়া গুলিবর্ষণে প্রাণ হারান সুজন ও তাহের নামে দু`ব্যক্তি। এছাড়াও ২০০৬ সালে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ধানমণ্ডি-২৭ নম্বরে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে এসপি কোহিনুর মিয়ার নির্দেশে পুলিশ শান্তা মাসি নামে আওয়ামী লীগের এক নারী কর্মীর ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়।
অসিম সাহসিকতার জন্য এএসআই সিদ্দিকুর, কনস্টেবল মামুনুর ও এএসপি বাবুল পুলিশ পদক পেলেও বিচার হয়নি সেই সব নির্যাতনকারী পুলিশ কর্মকর্তার, যারা সংবিধান ও উচ্চ আদালতের তোয়াক্কা না করে জনগণের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন। আর বেশিরভাগ সময়ে তাদের রোষাণলে পড়ছেন সাংবাদিকরা।
এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ঢাকা মহিলা পলিটেকনিকের ছাত্রীদের বিক্ষোভের ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের নির্মমতার শিকার হন তিন আলোকচিত্র সাংবাদিক। তাঁরা হলেন- খালেদ সরকার, জাহিদুল করিম ও সাজিদ হোসেন। পরে অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে ৯ পুলিশকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত ও এসিকে প্রত্যাহার করা হয়।
পুলিশের নির্যাতনের বিষয়ে আইন কি বলে
‘সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনের আশ্রয় লাভ এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। ’
৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না। ’
এ ব্যাপারে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘পুলিশ এ ধরণের অপরাধ করার পর তাদের সাময়িক বরখাস্ত ও বদলি করার মানে হচ্ছে জনগণকে ধোঁকা দেওয়া। আমরা অতীতেও দেখেছি, আবার বর্তমানেও দেখছি- এ ধরণের পুলিশ কর্মকর্তাদের ক’দিন পরে আরো সম্মানজনক স্থানে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ’
তিনি বলেন, ‘এ ধরণের অতি উৎসাহী যারা আইনের অপব্যবহার করছেন তাদের অবশ্যই আদালতের কাঠগড়ায় একদিন না একদিন দাঁড়াতে হবে। এটাই সর্বকালের ও সব দেশের ইতিহাস। ’
সাংবাদিক নির্যাতনের বিষয়টি কি ধরণের অপরাধ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পেশাগত দায়িত্বপালনকালে সাংবাদিকদের ওপর নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে। এটা এক ধরণের ফৌজদারি অপরাধ। এজন্য প্রশাসন চাইলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। ’
তিনি বলেন, ‘শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থা নিলে হবে না। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ আমলে নিতে হবে। আর এর জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়ার দরকার। ’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কারণে পুলিশের আচরণ এ রকম হয়েছে। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। রাজনীতির উর্ধ্বে রাখতে হবে। ’
তিনি বলেন, ‘সাধারণত আমাদের দেশে প্রশাসন বিরোধীদের দমনের জন্য পুলিশকে ব্যবহার করে থাকে। এটা একটা উপনিবেশিক আইনের অধীনে চলছে। এ জন্য পুলিশে ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, মে ২৮,২০১২
এমইএস/ সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর