কাজের যতো অতলেই ডুবে থাকি না কেন, মেয়ের সংগে যোগাযোগটা রক্ষা করি। দিবা-রাত্রি ১০/১২ বার কথাতো হবেই।
ইদানিং ওর তরফ থেকে ফোন বেশি আসতে শুরু করেছে। এক কল থেকে আরেক কলের দূরত্ব কমছে। প্রতিবার ফোন করেই জানতে চায়- বাবা তুমি কোথায়, ভাল আছো, অফিসের বাইরে যাওনি তো? যদি বলি অফিসেই আছি তাহলে মেয়ে আমার স্বস্তি পায়। আর যদি বলি বাইরে আছি, তাহলে বলে,``পুলিশ নিয়ে কোনো রিপোর্ট করো না বাবা। ওদের সংগে ঝগড়া করো না। `` জানতে চাই, ``কেন?`` উত্তর আসে, ``দেখছো না ওদের হাতে কতো আংকেল মার খেলো। বাবা পুলিশতো সাংবাদিকদের ধরে ধরে পেটাচ্ছে। তুমি ওদের কাছে যেও না। ``
মেয়েকে বলি, ``পুলিশ তো আমাদের বন্ধু। `` মেয়ের উত্তর, ``বন্ধু বুঝি বন্ধুকে পেটায়?`` প্রতিউত্তর খুঁজে না পেয়ে প্রসংগ পাল্টাই। কিন্নরী, মানে আমার মেয়ের মধ্যে আতংকের বীজ ঢুকেছে সেদিন থেকে, যেদিন চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে পুলিশের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন ফটো সাংবাদিকরা। কিন্নরী তখন বেশ ছোট। ওর মা ফটো সাংবাদিক। তাই পুলিশ যখন খেলার মাঠে সাংবাদিকদের লাথি মারছিল, তখন টিভিতে সেই ছবি দেখে কিন্নরী কেবল বলতে পেরেছিল, ``মা, পুলিশ তোমাদের মারছে কেন?``
এরপর ও আরো খানিকটা বড় হয়ে দেখেছে গিয়াস মামাকে (দেশ টেলিভিশনের গিয়াস আহমেদ) কিভাবে পিটিয়েছে তেজগাঁও থানাপুলিশ। এছাড়া চলতে-ফিরতে পথে ঘাটে দেখেছে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পরও কিংবা ওর মায়ের হাতে ক্যামেরা দেখার পরেও পুলিশের চোখ রাঙানি এবং হয়রানি। আর গত ক`দিনেই মধ্যেই দেখতে পেলো আগারগাঁও এবং আদালতপাড়ায় সাংবাদিকরা কিভাবে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হলো।
পত্রিকা এবং টেলিভিশনে নির্যাতনের ছবি দেখে কিন্নরী এখন রীতিমতো আতংকিত। ওর মাকেও বলছে ক্যামেরা যেন ভুল করেও পুলিশের দিকে তাক না করে। কেবল যে মা-বাবাকে নিয়েই সে উদ্বিগ্ন তা নয়। সব সাংবাদিক মামা-খালাদের নিয়েও ভয়ে আছে। পুলিশের সংগে রিপোর্টারদের দেখলেই ও আমার উপর ক্ষেপে যাচ্ছে, ``বাবা কেন পুলিশের কাছে পাঠালে ওদের? `` সেটা যে টেলিভিশনের রিপোর্টারই হোক। আমি বলি খবর জোগাড় করতে হলে পুলিশের কাছে তো যেতেই হবে। কিন্নরীর উত্তর শুনে থমকে যাই, ``বাবা ওরা খবর দেবার লোভ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে মারতে পারে। আমি ওকে বোঝাই, `` মা, পুলিশ তো আমাদের নিরাপত্তা দেয়। আমাদের যদি কোনো বিপদ হয় তখন তো পুলিশ এসেই আমাদের রক্ষা করবে। দুষ্ট লোকদের ধরবে। `` কিন্তু আমি বুঝি ভুলেই গিয়েছিলাম মেয়ে আমার পত্রিকা পড়তে শিখেছে। টিভির খবরও দেখে নিয়মিত। ওকে কিভাবে ফাঁকি দেবো? ও যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর টিপসটিও জেনে গেছে। তাই কিন্নরীও আবদার করছে, যে পথে পুলিশ আছে সেই পথে যাওয়া যাবে না। দূরে থাকতে হবে।
ওর আরো মজার আবদার হচ্ছে, ``বাবা, পুলিশ দেখলে হর্ন বাজাবে?`` শুনে তো আমি অবাক--`` হর্ন কেন বাবা?`` মেয়ের উত্তর: ``কেন দিনাজপুর যাওয়ার সময় দেখোনি ট্রাকের পেছনে লেখা থাকে ১০০ হাত দূরে থাকুন। হর্ন বাজান। সাংবাদিকরা তো আর হর্ন বাজাতে পারবেনা বাবা, সবাইকে বাঁশি কিনতে বলো। পুলিশ দেখলেই বাঁশি বাজাবে। `` কিন্নরীর ভয় তাড়াতে বললাম, ``মা, এখন আর ভয় নেই, দেখোনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন- পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে। ``
কিন্নরী হেসে উঠলো। বললো, ``বাবা, তুমি আমার সংগে দুষ্টুমি করছো!``
লেখক: তুষার আবদুল্লাহ, বার্তাপ্রধান ও পরিচালক: সময় টেলিভিশন
বাংলাদেশ সময় ১৯০৫ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
Jewel_mazhar@yahoo.com