দেশব্যাপী সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবাদের ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার পাল্টে কালো জমিনের ওপর সাদা হরফে ‘J’ যুক্ত প্রোফাইল পিকচার ব্যবহারের অভিনব প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। এর কোন কোন ‘J’ আবার লাল।
এখন এত সহস্র ‘J’ যুক্ত প্রতিবাদ প্রোফাইল দেখে মনে হবে এর চেয়ে নিকৃষ্ট মানের কোন সরকার আর কোনদিন বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসেনি! তাহলে কী অতীতের সব সরকারই ছিল দুধে ধোয়া উকৃৎষ্ট মানের? বা এই সরকার পড়ে যাবার পর বিএনপি-জামায়াতের যে সরকার ক্ষমতায় ফিরে আসবে, সেটি খুব উকৃৎষ্ট মানের হবে? যেভাবেই ঘটুক এ পরিস্থিতি দেখেশুনে কিন্তু সবচেয়ে খুশি হয়ে আছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী! তাদের প্রধান সব যুদ্ধাপরাধী নেতাদের জেলে রেখে মনখারাপ অবস্থায় দেশের সহস্রাধিক সাংবাদিককে সরকারের বিরুদ্ধে একাট্টা দেখে ‘না চাইতেই বৃষ্টি’তে তাদের হৃদয়ে যেন বিশেষ শান্তির হাওয়া বইছে! যদিও আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যারা এ ধারার প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগ জামায়াত-শিবির বিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে। আমি আওয়ামী লীগ-বিএনপি না করলেও আমার অনেক লেখা আওয়ামী লীগ-বিএনপি ওউন না করলেও কিন্তু এভাবেই এনজয় করে।
সোশ্যাল নেটওয়ার্ক হিসাবে ফেসবুক জনপ্রিয় হবার পর স্বাধীনতা দিবস-বিজয় দিবসকে সামনে রেখে লালসবুজ জাতীয় পতাকার সিম্বলিক ছবি সহ অনেকে কয়েকদিনের জন্য প্রোফাইল পিকচার করেন। ক্রিকেটে টাইগারদের ছবি অথবা বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ছবি সহ’ও প্রোফাইল পিকচার করেন অনেকে। কিন্তু প্রতিবাদের এই প্রোফাইল পিকচারটি কতদিন চলবে? সাংবাদিক নির্যাতনকারী এই সরকার বিদায় না হওয়া পর্যন্ত? বিএনপি-জামায়াতের সরকার না আসা পর্যন্ত? আমি যে আওয়ামী লীগ-বিএনপি করিনা তা জাতীয় প্রেসক্লাবের আওয়ামী লীগ-বিএনপি ফোরামের সাংবাদিক নেতারাই ভালো জানেন। কিন্তু এই ‘J’ যু্ক্ত প্রতিবাদের প্রোফাইল পিকচারের মাধ্যমে আমার বন্ধুদের অনেকে বুঝে অথবা না বুঝে কী আরেকটি রাজনৈতিক পক্ষের পারপাস সার্ভ করছেন না? এখন যে পুলিশ নির্যাতন করছে এরা দলীয় পুলিশ। আগে যে পুলিশ নির্যাতন করতো তারাও ছিল দলীয় পুলিশ। আগামীতে সরকার বদলের পর যে পুলিশ আসবে তাদেরকেও বেহেস্ত থেকে আনা হবে না। অতএব এসব নির্যাতন চলতেই থাকবে। যতদিন এসব নির্যাতন চলতে থাকবে ততদিন তথা আদি ও অনন্তকাল কী তাদের এই প্রোফাইল পিকচার চলবে? আমার বন্ধুদের প্রতি বিনীত প্রশ্নটি থাকলো। একই সঙ্গে বলে নেই, এসব আমার একদম ব্যক্তিগত চিন্তা। এ চিন্তা ভুল-শুদ্ধ যাই হোক তা আমার। এ নিয়ে আমাকে যেন কেউ ভুল বোঝেন। যার যার প্রোফাইল পিকচার কে কী ভাবে রাখবেন না রাখবেন, এটি একান্তই তার।
নির্যাতনকারী এই রাষ্ট্রের মতো, রাষ্ট্রের লাঠিয়াল পুলিশের মতো আমাদের যে কত হাজার হাজার বন্ধু নিজেদের মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের হাতে প্রতিদিন নির্যাতিত হচ্ছেন সে খবরও আমরা সবাই কমবেশি জানি, কিন্তু সেভাবে তা বলছিনা বা বলতে পারছিনা। ওয়েজবোর্ড সপ্তম না অষ্টম এ প্রতিযোগিতা দেখে আমার হাসি পায়। সারাদেশের সহস্র পত্রিকা-মিডিয়ার মধ্যে বড়জোর দশ-বারোটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান এসব ওয়েজবোর্ড যথাযথ মানে। টকশো’গুলোতে যে সব মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বেশি সোচ্চার, তারাই তাদের পত্রিকায় কখনো এসব ওয়েজবোর্ডের পরোয়া করেন না। ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন হয়েছে, এমন মিথ্যা সার্টিফিকেট দিয়ে টাকা কামান এক শ্রেনীর সাংবাদিক নেতা! সারাদেশের মফঃস্বল সাংবাদিকদের বাজারদর অনুসারে সংসার চালানোর মজুরি না দিয়ে শুধু একটি আইডি কার্ড অথবা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাইক্রোফোনের প্রতীক সম্বলিত ডান্ডা হাতে ধরিয়ে ‘করে খা’ জাতীয় বার্তা সহ মাঠে-ময়দানে ছেড়ে দিয়েছেন ঢাকাবাসী অনেক মিডিয়া মোঘল! এদের নির্যাতন কী এসব পুলিশি নির্যাতনের চেয়ে মোলায়েম?
১২ বছর পেরিয়ে গেল কিন্তু সাংবাদিক শামছুর রহমান হত্যার বিচার হলোনা। শামছুর রহমানের পলাতক খুনি, বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামের সাবেক দেহরক্ষী পাগলা সেলিম ভারতে ধরা পড়া স্বত্তেও সরকার কেন তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে এই বিচার ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ নিচ্ছেনা, এ রিপোর্ট পর্যন্ত আজ পর্যন্ত দেশের মিডিয়ায় কেন হলোনা, তা মাথায় আসেনা। ঢাকার মিডিয়ায় টিকতে না পেরে জার্মানি চলে গেছেন শামছুর রহমানের মেয়ে সেঁজুতি। দীর্ঘদিন বেতন না পেয়ে শুধু স্ত্রীর বেতনের টাকায় সংসার চালাতে পারছেন না দেখে সাংবাদিকতাই ছেড়ে দেবার কথা কেন ভাবছেন শামছুর রহমানের ভাই সাংবাদিক সাজেদ রহমান? এসব কী আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? গত বিএনপি-জামায়াত আমলে হাওয়া ভবন সরকারের সঙ্গে খাতির করে তেজগাঁও শিল্প এলাকার রাস্তা গায়েব করা প্লট যেসব মিডিয়া মালিক লাফিয়ে পড়ে নিয়েছিলেন, যে বিষয়টি আজ হাইকোর্টে উঠে এসেছে, নৈতিকভাবে কোন মিডিয়া মালিক কী এমন নিতে পারেন? এসব অনৈতিকতার বিরুদ্ধেই কী সব সময় মিডিয়া সোচ্চার ভূমিকা পালন করেনা? সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র তথা পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অবশ্যই আমরা করবো। কিন্তু আমাদের ঘরের অনৈতিকতা-বঞ্চনা-নির্যাতন-বঞ্চিত-লাঞ্ছিত-নির্যাতিত অসহায় সহকর্মীদের কথাও যেন ভুলে না যাই।
একেরপর এক সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় অবস্থা লেজেগোবরে হবার পর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক মাহবুবুল হক হানিফ বলে দিলেন সরকারকে বিব্রত করার জন্য এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে! সাগর-রুনিকে বেডরুমে খুন করা হয়েছে সরকারকে বিব্রত করতে? সে ঘটনার পর খুনিদের ধরতে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিল কে? তা তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী না অন্য কেউ? পুলিশ থেকে সাংবাদিকদের দূরত্বে থাকতে বলেছেন তাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী না অন্য কেউ? এমন কিসিমের মন্ত্রীদের কেবিনেটে ধরে রেখে সরকার বিব্রত না আনন্দিত-পুলকিত হয়? প্রেসক্লাবের সামনে সাংবাদিক নির্মূলের ব্যানার কারা লাগিয়েছে? সরকার কী এসবের দায় এড়াতে পারে? বিডিনিউজের ঘটনার হোতাদের র্যাব ৪৮ ঘন্টা না যেতেই ধরে ফেললো, কিন্তু সাংবাদিক নির্যাতনকারী পুলিশে সদস্যদের যাদের ছবি-ভিডিও সব আছে, সবগুলোকে একসঙ্গে চেনা যায়, পুলিশ নামের এই কলংঙ্কগুলোকে অত ভনিতা না করে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করে গারদে নিয়ে গেলে সরকারের কী সমস্যা হতো? না এই পুলিশ রাস্তায় বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের গরু-ছাগলের মতো পেটায় বলে তাদের গায়ে হাত দিতে সাতবার ভাবতে হয় সরকারকে? মাহবুবুল আলম হানিফ কী মানবেন যে তাদের সরকার যে কার্যকর একটি সরকার সে ধারনাটিই এরমাঝে দেশের মানুষ অথবা সাংবাদিকদের বেশিরভাগের মনের মধ্যে এরমাঝে ঢুকে গেছে। এখন ক্ষমতার পড়ন্ত বেলায় এসেও যদি অকার্যকর-ব্যর্থ মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে কেবিনেট ঘষামাজা না করা হয়, তাহলে শুধু তাদের এসব মুখস্ত বয়ান দেশের মানুষ শুনবে-মানবে কেন?
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১০৪০ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০১২
এমএমকে