পুলিশ নিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী টুকু সাহেবের সাম্প্রতিক মন্তব্যের কথা ভাবতে ভাবতে আক্কেল সাহেব ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। না হেঁটে কি উপায় আছে? ঢাকার রাস্তায় যে জ্যাম থাকে, তাতে পায়ের গতি যে কোন গাড়ীর গতির চেয়েও অনেক বেশী।
আক্কেল সাহেব ভাবছিলেন, কোন কারণে টুকু সাহেব সাংবাদিকদের পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন? পুলিশতো জনগণের সেবক। সাংবাদিকরা কি জনগণের কাতারে পড়ে না? সে যাইহোক, কতোটুকু দূরত্বে থাকবেন তারা? লাঠির আগার শেষ সীমা পর্যন্ত নাকি গুলির গতির শেষ গন্তব্য পর্যন্ত? তিনি অবশ্য দূরত্বটা মেপে নির্ধারণ করে দেননি। হতে পারে সেটা আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারিত হবে।
কিন্তু শুধু সাংবাদিক কেন? নারী কিংবা সাধারণ নাগরিক, যারা প্রতিনিয়ত পুলিশ কর্তৃক ধর্ষণ কিংবা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে? তারা কেন কাছাকাছি থাকবে? উত্তরবঙ্গের ইয়াসমীন কিংবা সীমা থেকে শুরু করে সেদিনকার আদালত চত্ত্বরে এক তরুণীকে শ্লীতাহানির চেষ্টা করা হোল। এরপরেও নারী কিভাবে আইনের রক্ষক (ভক্ষক নয় কি!) পুলিশের কাছাকাছি থাকতে ভরসা পাবে। নির্যাতিতা সেই মেয়েটি দাবি করেছে, একজন লম্পট পুলিশ তার গলা থেকে চেইন টান দিয়ে নিয়ে যায়। প্রতিবাদ করাতে এক থাপ্পড়ে এক কানের দুল ছিঁটকে পড়ে হারিয়ে যায়। সেই সাথে কানটাও ছিঁড়ে যায়।
মেয়েটা বড় বোকা! দুল নিয়েছে, তো কি হয়েছে! সাহস করে প্রতিবাদ করার কি আছে! এবার কানের দুল এবং কানটা হারিয়ে হোলতো শিক্ষা! সাংবাদিক আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হইচই না পড়লে বাপ মা বেটির খবর ছিল। সাংসদ পিটিয়ে এই পুলিশরা প্রমোশন পায়, সাংবাদিকের হাত গুঁড়িয়ে দিয়েও কাঁচকলা দেখায়। সেকথা ভুলে গেলে, তুমি অখ্যাত নারী। এইতো সেদিন এদেরই জ্ঞাতি ভাই একজন বড় নেতার পকেট থেকে মোবাইল মেরে দিয়েছিল। মাঝে মাঝেই শোনা যায় ছিনতাই কাজে অংশ নিয়ে ধরা পড়ার কাহিনী। ঘুষ কাহিনীতো মামুলী ব্যাপার!
সাগর-রুনীর কিংবা সেই সৌদী দূতাবাস কর্মকর্তার হত্যাকারী এবং ইলিয়াসের অপহরণকারীর টিকিটি ছুঁয়ে দেখতে না পারলেও কোনো কোনো ব্যপারে আমাদের পুলিশ বাহিনী ‘টিয়ে পাখির হাত দেখার কৌশল’ অবলম্বন করে বেশ ফললাভ করছে। রাস্তার জ্যোতিষি যেমন টিয়ে পাখি দিয়ে একটা খাম তুলে আন্দাজে বলে দেয় কার ভাগ্যে কি আছে। ঠিক তেমনি আমাদের পুলিশ যাকে তাকে ধরে, যেমন ইচ্ছে তেমনভাবে কাউকে ডাকাত, কাউকে চোর বানিয়ে ফেলতে পারে। তাতে আইন শৃঙ্খলার কোন ফায়দা না হলেও ব্যক্তিগতভাবে বেশ লাভবান হওয়া যায়। এভাবে উপরের চাপ থেকে যেমন মুক্তি মেলে ঠিক তেমনি বাড়তি কিছু আয়ের সংস্থানও হয়।
তরুণীর বাবাকেও সে রকম কিছু একটা করার ইচ্ছে ছিল। তার সংগে নারী লোলুপতা যোগ হয়ে নতুন ঝামেলা না বাঁধালে বেচারার খবর ছিল। এরপরেও উৎড়ে গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু বাঁধ সাধে কিছু ‘দুই পয়সার’ সাংবাদিক এবং কিছু উচ্ছন্নে যাওয়া কালো কোটের উকিল। দুদিন আগেও তিনটার প্যাঁদানী দেখে সাংবাদিকদের হুঁশ হয়নি।
হঠাৎ আক্কেল আলীর মশকরা করার ইচ্ছে হয়। সে ভাবছে, হয়তো একদিন এমন হবে, পুলিশ রাস্তা থেকে একজনকে ধরে এনে বলছে, ‘ওস্তাদ সারাদিন কোন ইনকাম নাই। শেষমেষ একটা মুরগী ধরে এনেছি। কোন পাত্রে রোস্ট করবেন’?
আগে লক আপে ঢোকা। রাতে আমদানী (ঘুস বেশী হলে ৫৪ ধারা, সেটা মনঃপুত না হলে টাকা অনুযায়ী মামলায় জড়ানো) হিসাবে ব্যবস্থা। চোর ডাকাত একটা বানানো হবে। কিছু না হোক, রিমান্ড ব্যবসায় কিছু বাড়তি আয় তো হবে’।
সর্বনাশা কথা হলো, তদন্তের আগে আদালতে উপস্থিত প্রতিটা পুলিশ কর্মকর্তা সরাসরি ধর্ষনপ্রবণ পুলিশগুলোর পক্ষ অবলম্বন করে। সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকার সংস্থা সরাসরি প্রত্যক্ষভাবে সাহায্যের জন্য এগিয়ে না আসলে নিশ্চিতভাবে মেয়েটি এবং তার মা বাবা থানার ভিতরে পুলিশ হেফাজতে আরেকবার নির্যাতনের শিকার হোত। মেয়েটির বাবাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হোত ডাকাতির মামলায় এবং মটর সাইকেল চুরির আরেকটি সাজানো মামলায়। মেয়েটিকে রাস্তার বাজে মেয়ে আখ্যা দিয়ে অপমানের মাথায় শেষ পেরেকটা ঠুকে দেয়া হোত। থানা আদালতে দৌঁড়াদৌড়ি করে সর্বশান্ত হতো একটা নিরীহ পরিবার।
আক্কেল মিয়ার মনে পড়ল, সেদিন সকালে এক বন্ধুর সংগে আলাপচারিতার কথা। সে বলছিল, পুলিশের এই আচরণ নতুন কোন ঘটনা নয়। এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার গল্প প্রসংগে তাকে বলে, প্রায় দু’যুগ আগে ঢাকায় ভাইয়ের সংগে রাতে সিনেমা দেখে ফেরার পথে সন্দেহভাজন হিসেবে টহল পুলিশ দু’জনকে গাড়িতে তুলে নেয়। মেয়েটিকে গাড়িতে তোলার সময় এক বৃদ্ধ পুলিশ তাকে অশ্লীলভাবে ধরে বলছিল, ‘ওঠ মা ওঠ। গাড়ীতে ওঠ’। কিছুদূর গিয়ে ভাইটিকে পুলিশ ছেড়ে দেয়। মেয়েটির ভাগ্যে থানায় গিয়ে বা চলতি পথে গাড়ির ভিতরে কি ঘটেছিল, পুলিশ অফিসার সেটা আর উল্লেখ করেনি।
মিডিয়া এখন বেশি সচেতন এবং সারা বিশ্বে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীন। সেই সাথে জনগণের ভিতরেও আগের সেই কুসংস্কার কিছুটা থাকলেও দিনে দিনে কমছে। ‘লজ্জাই নারীর ভূষণ’ বলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার আপ্তবাক্য দিয়ে নারীর প্রতি অত্যাচারকে ‘না’ বলতে উৎসাহিত করা হোত। এখন নারী সেই লজ্জা বা কুসংস্কারের পাহাড় ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছে। বলা শুরু করেছে তার বিরুদ্ধে ঘটা সহিংসতা বা অন্যায়কে। নারীর এই এগিয়ে আসাটাই হয়তো কাল হয়ে দাঁড়াল পুলিশ ক্লাবের ভিতরে শ্লীলতাহানির প্রচেষ্টাকারী সেই ধর্ষন উন্মুখ পুলিশগুলোর জীবনে।
আক্কেল আলীর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, এবারও এই অপরাধপ্রবণ পুলিশ সদস্যদের কিছুই হবে না। ইতিমধ্যে সে আঁচ করতে পেরেছে বিষয়টা। তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের একযোগে অপরাধী সহকর্মীর পক্ষে অবস্থান, টুকু মন্ত্রীর ‘দূরে থাকার’ পরামর্শ এবং সাহারার ‘পুলিশ অনেক ভাল’ মন্তব্য আক্কেল আলীকে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে বিব্রত করেছে। মনে হয়েছে পুরো ঘটনাচক্রই অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রয়াস মাত্র। তার আলামতও বেশ স্পষ্ট। পুলিশের বিরুদ্ধে চলমান এতো সমালোচনার পরেও গত মঙ্গলবার রাতে গাজীপুরের কালীগঞ্জে পুলিশ এক বালু ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে তার প্রতিপক্ষের হাতে ছেড়ে দেয়। অতঃপর তারা পুলিশের সামনেই তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। যেমনটি ঘটেছিল কয়েক মাস আগে ঢাকার অদূরে মিলন নামের এক যুবকের ভাগ্যে। সেই পুলিশগুলোর বরাতে কি হয়েছিল তার কোন ফলোআপ রিপোর্ট কোন সংবাদপত্রেই ছাপা হয়নি। নিতান্ত গোবেচারা আক্কেল আলীর কি সাহস হবে বাং]লানিউজকে পরামর্শ দেবার যে বিগত দিনগুলোর ঘটে যাওয়া চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলোর বর্তমান হাল হকিকত নিয়ে চলমান একটা পাতা খোলার! এতোবড় দুঃসাহস আক্কেল আলীর নেই। তবুও ভাবছে এ রকমটি করলে বাংলানিউজ জনকল্যাণে আরেকটি উদ্যোগের সাথে শরিক হতে পারবে। কারণ অনেক সময় প্রভাবশালী অপরাধীদল সংবাদ ভুলে যাবার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটা সময়ে ছাড় পেয়ে যায়। পত্রিকার এই অনুসন্ধানী ফলোআপ সংবাদ চালু হলে অনেক অপরাধীই সেই সুযোগটা আর পাবে না। এতে করে হয়তো অপরাধ প্রবণতার হারও কমতে পারে।
তবে আক্কেল আলী কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না যে, এতো কিছুর পরেও মন্ত্রী কেন জনগণকে বিশেষ করে নারীদেরকে পুলিশ হতে দূরে থাকতে বলেননি? হতে পারে নারী এবং সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ সরকারকে এতোটা বিব্রত করতে পারে না। ওরা দুর্বল। মন্ত্রী না বললেও আমরা ম্যাঙ্গো জনতা ‘চাচা আপন প্রাণ বাচা’ এই মন্ত্রে উদ্ধুদ্ধ হয়ে দূরত্ব বজায় রেখেই চলব।
এভাবে সবাই দূরে সরে গেলে পুলিশের কাছাকাছি থাকল কারা? রাজপথে অস্ত্র হাতে বিরোধী দলকে শায়েস্তা করতে সরকারি দলের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী? নাকি বিডিনিউজে হামলাকারী সেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী? কিংবা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার হাতিয়ার পুলিশের সোর্স বলে খ্যাত চিহ্নিত অপরাধীচক্র! হতেই পারে সে রকম। কারণ উভয়েরই অভিন্ন শত্রু এখন সাংবাদিক এবং জনগণ।
এভাবে সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আক্কেল আলী হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়াল বিকট আওয়াজে। কি ব্যাপার! তাকিয়ে দেখে পাশের গেটের গ্রীলের ফাক গলে বিশাল সাইজের একটা আস্ত কুকুর আগন্তুক টের পেয়ে ঘেউ ঘেউ করছে। আচমকা নজর পড়ল গেটের পাশে দেয়ালে সাটা, কাটা কাটা লেখার একটা বিজ্ঞপ্তি।
”কুকুর হইতে সাবধান!!!”
মিল খুঁজে পেল আক্কেল আলী টুকু সাহেবের কথার সাথে।
ভাবনায় পড়ে গেল সে। মন্ত্রী মহোদয় তাহলে কি বুঝাতে চেয়েছেন? একই কথা মন্ত্রীর মুখে এবং এ বাড়ীর দেয়ালে! ব্যাপারটা কি?
যাদেরকে উদ্দেশ্য করে অভিন্ন সাবধান বাণী, তাদের উভয়ের মধ্যে অমিল আছে পায়ে (দুই পা এবং চার পা)। কিন্তু মিলটা কোথায়?
mahalom72@msn.com
বাংলাদেশ সময় ১৯৪২ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০১২