ঢাকা, শনিবার, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বড্ড কঠিন সময় পার করছি আমরা

নিজামুল হক বিপুল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫৯ ঘণ্টা, জুন ২, ২০১২
বড্ড কঠিন সময় পার করছি আমরা

কঠিন সময় পার করছি আমরা। সত্যিই কঠিন সময়।

আমরা যারা সংবাদ মাধ্যমে কাজ করছি, তাদের জন্য। কোনো ভয়-ভীতি কিংবা অন্য কোনো অদৃশ্য কারণে নয়, খোদ রাষ্ট্র এখন তার চতুর্থ স্তম্ভকে সহ্য করতে পারছে না। আবার সরাসরি এটাকে নিষিদ্ধ করেও দিতে পারছে না। কারণ নিষিদ্ধ করলেও খুব একটা সুবিধা পাওয়া যাবে না। বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। তথ্য-প্রযুক্তি গোটা বিশ্বকে প্রতিটি মানুষের নাগালের মধ্যে এনে দিয়েছে। তাই সরকার ভিন্নপথে লেলিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, যাদের স্লোগান—‘সেবাই পুলিশের ধর্ম। ’

ধর্ম যাই হোক না কেন- পুলিশ যে এখন সরকারের নির্দেশনা পালন করছে, তাতে কারো কোনো সন্দেহ নেই, সন্দেহ থাকার কথাও না। যদিও রাষ্ট্রের গুরুত্ত্বপূর্ণ আসনে বসা উপদেষ্টা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের হাতে সাংবাদিক নির্যাতন কিংবা আক্রান্তের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন। এগুলো দিয়ে পুরো পরিস্থিতিকে বিবেচনা করা সম্ভব হবে না। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেছেন, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের তুলনায় বর্তমান সরকারের সময়ে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা কমই ঘটছে। এসব কথা শুনে মনে প্রশ্ন জাগে, যেটা ঘটছে সেটা তাদের কাছে কম হয়ে গেছে। তারা একটু বেশিই আশা করেছিলেন বোধ হয়!

আবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, সরকারকে বিব্রত করতে এসব ঘটানো হচ্ছে। তার এই কথা শুনে মনে হচ্ছে-এমন বক্তব্য দিয়ে তিনি নিজেকে সত্যিকার চালাক লোক ভাবছেন, আর সবাই বোকার স্বর্গে বসবাস করছে। খুবই হাস্যকর তার এমন উক্তি। কারণ রাষ্ট্রযন্ত্র তাদেরই নিয়ন্ত্রণে। ওইখানে পুলিশের যারা চাকরি করছেন এবং রাজধানীতে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন, কমবেশি তারা সবাই সরকারের পছন্দের লোক। শুধু তাই নয়, এই পুলিশ কর্মকর্তারা অত্যন্ত দম্ভ নিয়ে বলে বেড়ান, ‘আমরা গোপালগঞ্জের লোক, বৃহত্তর ফরিদপুরের লোক’। তাই হানিফের কাছে প্রশ্ন-গোপালগঞ্জ-ফরিদপুরের বাসিন্দা দাপুটে পুলিশ কর্মকর্তারা কি আপনার সরকারকে বিব্রত করছে, নাকি সরকারের নির্দেশেই সাংবাদিক পেটাচ্ছে?

সরকারের পেটুয়া পুলিশ বাহিনী যে গত কয়েকদিনে খুব সচেতনভাবেই সাংবাদিকদের ওপর হামলে পড়েছে, রাজপথে অবলীলায় সাংবাদিক বন্ধুদের পিটিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ সরকারের পুলিশ (স্বরাষ্ট্র) মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর কথায় পুলিশের এমন সাংবাদিক নির্যাতনকেই আস্কারা দেওয়ার প্রমাণ মেলে।

আগারগাঁওয়ে প্রথম আলোর তিন ফটো সাংবাদিক খালেদ সরকার, জাহিদুল করিম ও সাজিদ হোসেন পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরদিন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু তো রাখঢাক না রেখেই বললেন, সাংবাদিকরা পুলিশের কাছ থেকে একটু দূরত্ব রেখে কাজ করলে ভালো। কিন্তু কেন? সাংবাদিকরা কি কাউকে মারতে যাচ্ছেন? নাকি পুলিশের কাজে বাধা দিচ্ছেন? তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো একটি স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর চেয়ারে বসে টুকুর এমন বক্তব্য শুধু বেমানানই নয়, এটা স্পষ্টত পুলিশকে সাংবাদিক পেটানোর উৎসাহ যোগানোরই শামিল। তা না হলে এর একদিন পরই পুলিশ পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় আবারো সহকর্মী তুহিন হাওলাদার, প্রশান্ত কর্মকারসহ তিন সাংবাদিকের ওপর হায়েনার মতো হামলে পড়তো না। এ ঘটনায় আহত হন একাধিক আইনজীবীও। সেখানে পুলিশ ছিল আরো বেপরোয়া। কারণ পুলিশ কর্তৃক এক তরুণীকে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদ করা এবং ওই তরুণীকে উদ্ধার করার কারণেই পুলিশ চড়াও হয় সাংবাদিক ও আইনজীবীদের ওপর।

আর এ ঘটনার পর আরেক অ্যাডভোকেট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাহারা খাতুন পুলিশের পক্ষে সাফাই গেয়ে বললেন, ‘পুলিশ আগের চেয়ে ভালো’। উদাহরণ দিলেন নিজের আন্দোলনের সময়ে পুলিশি নির্যাতনে পায়ে আঘাত পাওয়ার কথা। কিন্তু এখন তো তিনি পুলিশের কর্তা হয়ে চেয়ারে বসে আছেন। তাকে রাজপথে আন্দোলন করতে হচ্ছে না। বরং সামনে- পিছে পুলিশের হুইসেল বাজানো প্রটোকল গাড়ি নিয়ে চষে বেড়ান সর্বত্র। শ্রদ্ধেয় সাহারা খাতুন একবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ার ছেড়ে রাজপথে নামুন, তারপর দেখুন কতোটা ভালো হয়েছে আপনার সোনার ছেলে পুলিশরা।

কোথায় আপনারা পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, শাস্তি দেবেন কৃত অপকর্মের জন্য, সেটা না করে বরং দিনের পর দিন পুলিশকে আস্কারা দিয়ে যাচ্ছেন। এর ফল যে খুব ভালো হয় না, সেটা দেখতে বেশি দূর যেতে হবে না। নিকট অতীতের দিকে চোখ ফেরালেই দেখতে পাবেন পুলিশ কতোটা ভালো হয়েছে। অবশ্য এটা সত্য, যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের চোখে রঙিন চশমা থাকে। তাই সবকিছুই তাদের কাছে রঙিন লাগে। ওই রঙিন চশমা দিয়ে সাংবাদিকদের মারধরের ঘটনা চোখে ধরা পড়বে না। তরুণী লাঞ্ছনার ঘটনা চোখে পড়বে না কিংবা রাজপথে আন্দোলনরত সংবাদকর্মীদের আন্দোলনের দৃশ্যও চোখে দেখা যাবে না। রঙিন চশমার ভারী আবরণে সবকিছুই ঢাকা পড়ে যায়। কেউ যদি ক্ষমতার মোহে পাগল হয়ে যায়, ভাবে তাকে আর কখনও ক্ষমতা ছাড়তে হবে না, তখনই এমন উদ্ভট যুক্তিহীন কথাবার্তা বলতে থাকে তারা।

১ জুন শুক্রবার ডিগবাজির রাজনীতিতে শীর্ষে থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, সাংবাদিক পেটানো সরকারের কালচারে পরিণত হয়ে গেছে। মি. মওদুদ- আপনি কি জবাব দেবেন, আপনাদের সময় খুন হওয়া সাংবাদিক যশোরের শামছুর রহমান কেবল, খুলনার মানিক সাহা, হুমায়ূন কবির বালুসহ আরো যেসব সাংবাদিক হারিয়ে গেছেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে তাদের বিচার কি আপনারা করেছিলেন? জবাবটা আমিই দিয়ে দিলাম-না, করেননি। কারণ ‘কেবল’ হত্যার সঙ্গে আপনার আরেক সহকর্মী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম জড়িত থাকার কথা সবাই জানে। এসব হত্যকাণ্ডের বিচার আপনারা করবেনও না। এখন আপনারা যেটা বলছেন বা করছেন, সেটা মূলত রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য করছেন। কারণ আপনারা সবাই একই গোয়ালের গরু। লংকায় গেলেই সবার চেহারা প্রকাশ পায়। সবাই রূপ পাল্টে ফেলেন। রাজপথে আন্দোলন করার সময় সাংবাদিকদের প্রয়োজন, তাই তাদের কথা বলেন। আবার ক্ষমতায় গেলে সাংবাদিকরা আপনাদের নানা অপকর্মের কথা যখন তুলে ধরে, তখন বিরক্ত হয়ে লেলিয়ে দেন রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী অথবা দলীয় ক্যাডারদের।

এখানে আরেকটি বিষয় জুড়ে না দিলেই নয়। গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর মৎস্য ভবন, প্রেসক্লাব এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু ব্যানার চোখে পড়ছে। যাতে লেখা আছে “বেআইনী সড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাংচুর ও বিনা কারণে পুলিশের ওপর আক্রমণ সমাজ সচেতন সাংবাদিকদের কাজ নয়- এদের চিহ্নিত করে নির্মূল করুন। ” সচেতন সাংবাদিক সমাজের নামে টানানো এই ব্যানার কিসের আলামত?

সাংবাদিকরা তো রাস্তা অবরোধ করছে না, গাড়ি ভাংচুর করছে না। আর পুলিশের ওপর সাংবাদিকরা আক্রমন করেছে এমন নজির বা দৃষ্টান্ত কোথায়ও আছে বলে আমার জানা নেই। এমন ব্যানার দেখে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে পুলিশ সচেতন সাংবাদিক সমাজের ভূমিকায়ও নেমেছে! বাহবা দিতে হয় বহু গুণে গুণান্বিত পুলিশকে। সাবধান... এমন খেলা বন্ধ করুন। না হলে আপনাদেরকেই ভুগতে হবে।
 
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ আওয়ামী লীগের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল পাহাড়সম। সেই প্রত্যাশা পূরণ তো দূরে থাক, তার ধারে কাছেও নেই। বরং প্রত্যাশা পূরণের যে হার সেটি মাইনাস... মাইনাস... মাইনাস... ১০০০ এ আছে। আর সাংবাদিকদের প্রত্যাশা ছিল স্বাধীনভাবে কাজ করার, সেটি তো প্রতি পদে পদে প্রমাণিত হচ্ছে। বাকিটা নাই-বা বললাম।
 
লেখক: বাংলাদেশ প্রতিদিনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

বাংলাদেশ সময়: ২২১০ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১২
সম্পাদনা: আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।