দুর্নীতি নিয়ে দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তব্য সংসদে টেনে আলোচনা করতে গিয়ে সরকারি জোটের এমপিরা যে পরিস্থিতি তৈরি করলেন, অধ্যাপক সায়ীদের মতো একজন ব্যক্তিত্বকে সংসদে নিয়ে এসে মাপ চাওয়ানোর যে দাবি তুললেন, এর সবিস্তার দেখেশুনে মনে হবে আসলে যেন মৌচাকে ঢিল পড়েছে!
অধ্যাপক সায়ীদ অবশ্য এরই মধ্যে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন, টিআইবি’র অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় তিনি ‘সাংসদ’ শব্দটিও ব্যবহার করেননি। এরপরেও যে ‘চোরের মনে পুলিশ পুলিশ’ প্রতিক্রিয়া এসেছে, তাতে এসবের গন্ধ-দুর্গন্ধ আগামীতে আরও ছড়াতে পারে।
তারা বলেছেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সাংসদদের ‘চোর-ডাকাত’ বলেছেন! এভাবে তিনি সাংসদ ও সংসদের সার্বভৌমত্বে আঘাত করেছেন! সব ঠিক আছে। কিন্তু তারা নিজেরাই এসবের মর্যাদা রাখেন বা রাখতে পেরেছেন কি?
মুজিবুল হক চুন্নু সেই দলের এমপি, যে দলের নেতাকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়ে বলেছেন, তিনি একজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি। (ভদ্রলোকদের চোর-ডাকাত বলা যায় না, তাই অভিধানে তাদের জন্য ‘দুর্নীতিবাজ’ জাতীয় কিছু শব্দের ব্যবস্থা করা হয়েছে!) আদালতের সেই যুগান্তকারী রায়ের জন্য এরশাদ আইনানুগ পাঁচ বছর দেশের কোনও নির্বাচনেও দাঁড়াতে পারেননি। সর্বশেষ দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ক্ষমতা দখলের দায়ে তাকে বিচারের সম্মুখীন করতে বলেছে।
এসবের দায়দায়িত্ব কিন্তু সবার আগে দেশের আইনসভা তথা সংসদের ওপর পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশের দেউলিয়া রাজনীতির কারণে এরশাদ উল্টো ক্ষমতাসীন জোটের শরীক! সরকার নিজের সুবিধামতো আদালতের রায়কে কাজে লাগিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে নিয়েছে। কিন্তু এরশাদ ইস্যুতে ‘নীরব কেন কবি’! এসব দুর্নীতি না সুনীতি? সংসদের একদল এমপি মাসের পর মাস সংসদে না এসে বেতন-ভাতা নিয়ে খান! বিদেশ ভ্রমণ থেকে শুরু করে সব সুযোগ-সুবিধা নেন। আরেকদল তাদের এসব দিয়েও সংসদে ধরে রাখতে চায়। এসব দুর্নীতি না সুনীতি?
শেখ ফজলুল করিম সেলিম আজকাল সংসদে প্রায় যাকে-তাকে ধরে এনে নাস্তানাবুদ করতে বলেন! নিজের দিকেওতো তার একটু তাকিয়ে কথাবার্তা বলা দরকার। গত ১/১১’র পর কী অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল? কে তার নেত্রীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ছিল? যে সাক্ষ্যের অডিও ক্লিপিংস এখনও অনলাইনে বিনামূল্যে পাওয়া যায়! কী কারণে তাকে মন্ত্রিত্ব-বঞ্চিত করেছেন, তারই ভগিনী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা?
এখন যে লোকজনের এপিএস’এর গাড়িতে মধ্যরাতে সত্তুর লাখ টাকার বস্তা ধরা পড়ছে, অন্যতম শীর্ষ রেল কর্মকর্তাসহ আটক গাড়িটা ছেড়ে দেয়ার জন্য সারারাত ধরে তদবির চললো, মন্ত্রীকে মন্ত্রণালয় ছেড়ে চলে যেতে হলো, এরপর নিজের গড়া তদন্ত কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রী নিজেকে ধোয়া তুলসীপাতা ঘোষণা করলেও সেই কালিমা কি ধুয়ে মুছে গেছে? নাকি তা সম্ভব?
পাঁচমাস বয়সী মন্ত্রীর এপিএস’র অ্যাকাউন্টেই জমা আছে ৯১ লাখ টাকা! রেল কর্মকর্তাসহ একেকজনের ঢাকাসহ নানা জায়গায় নিজের নামে, স্ত্রীর নামে ফ্ল্যাট-প্লট-কৃষিজমি, ব্যাংকের এফডিআরসহ কতোকিছু (!), একটি নির্বাচিত সংসদ কী করে এসব সহ্য করতে পারে?
দেশের স্বপ্নের পদ্মা সেতু আটকে গেছে! মনোরেলের একটা পিলারও কোথাও করা যায়নি! এসব তো আটকেছে এই সংসদেরই একজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কারণে, তাই নয় কী? যশোরে যে সরকারি দলের হুইপ অধ্যক্ষ আব্দুল ওহাবের ওপর হামলা হলো, মানুষের ক্ষোভের আগুনে পুড়ল তার গাড়িসহ নানা সরকারি সম্পদ, সেই হামলার সঙ্গে জড়িত এলাকাবাসী গত নির্বাচনে তাকে ভোট দিয়ে এমপি বানাননি? ভোটাররা উল্টো এমপিকে কেন মারতে যাচ্ছে তা কী খতিয়ে দেখার দরকার না?
এভিয়েশন ব্যবসা থাকায় আওয়ামী লীগের আগের আমলে শেখ ফজলুল করিম সেলিমকে বিমান মন্ত্রণালয় দেয়া হয়নি। এটাই নিয়ম। আর এবার ক্ষমতায় এসে একজন ঠিকাদার দেখে বসিয়ে দেয়া হলো যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে? সমস্যাগুলোর গোড়া কোথায়? সমস্যাগুলো কী এমনি এমনি সৃষ্টি হয়ে গেছে?
শেখ ফজলুল করিম সেলিম অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদসহ বুদ্ধিজীবীদের গাড়ি-বাড়ির হিসাব নিতে বলেছেন। এমন কথা তারা আজকাল প্রায়শই বলেন। শহীদ মিনারে প্রতিবাদী ঈদ কর্মসূচির পরও এমন শুধু বলা নয়, অনেক হয়রানিও হয়েছে। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের ছাত্রদের অনেকে সরকারের সচিব, সামরিক-বেসমারিক আমলা, বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের সদস্য এমপি-মন্ত্রীও হয়তো এই সংসদ-কেবিনেটে আছেন। তারা দামি গাড়ি দৌড়াবেন, ভালো বাড়িতে থাকবেন আর অধ্যাপক সায়ীদের মতো ‘মাস্টাররা’ বস্তিতে না হয় বড়জোর আজিমপুর কলোনীর বাসায় থাকবেন, রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়াবেন, এটিই হয়তো বলতে-বোঝাতে চেয়েছেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম!
আল্লাহ পাক যখন ক্ষমতা দিয়েছেন, তখন উনারা শুধু অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ কেন, দেশের যত বিশিষ্ট ব্যক্তি আছেন, তাদের নাড়িনক্ষত্র খুঁজে বের করারও ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু তার আগেতো নিজেদের সাফসুতরো করা দরকার, তাই না প্রিয় শেখ ফজলুল করিম সেলিম ভাই? মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের তালিকা যেটি দেবার ওয়াদা ছিল সেটি এখন কোথায় কোন ডিপফ্রিজে পড়ে আছে? ক্ষমতায় যাবার আগের আর পরের? আমার মনে হয় এর দাবিতে এখন শেখ ফজলুল করিম সেলিমেরই বেশি সোচ্চার হওয়া উচিত। কারণ প্রশ্নটি তিনিই এখন সামনে নিয়ে এসেছেন। সংসদ ও সাংসদদের মর্যাদা অক্ষুন্ন-অটুট রাখার স্বার্থেই এটি দরকার।
সরকারের মেয়াদ যত কমে আসছে, সরকারি নেতারা পরবর্তী নির্বাচনের স্বার্থে যেখানে বিনীত ও নরম হবেন, উল্টো কেন যেন হয়ে যাচ্ছেন অসহিষ্ণু, দুর্বিনীত! দায়িত্বশীলরা একটুতে কেন যেন ভয় পেয়ে যাচ্ছেন! ভয় দেখাচ্ছেন! লক্ষণটা কিন্তু ভালো না। সরকারের এ মনোভাব দেখেশুনেই বুঝি দুর্বিনীত, বেপরোয়া ভাব দেখাচ্ছে পুলিশ! তারাতো এমনিতেই সারাদিন যাকে-তাকে পেটায়, মারে; অতঃপর সাংবাদিক মারা শুরু করলে তাতে অনেকের টনক নড়ছে! আবার এমনভাবে বলা হচ্ছে, মারছিস ঠিক আছে মার, কিন্তু সাংবাদিক মারিস নারে!
এসব পরিস্থিতির সৃষ্টি কেন হয়েছে, তা মোটামুটি লিখেছেন সরকারি দলেরই এমপিদের একজন গোলাম মাওলা রনি। সরকার যদি এসব প্রতিকারে মন দিতো, তাহলে তাদের ও দেশের ভালো হতো। কিন্তু জানি তো এর জন্যে উল্টো এমপি রনি’কেই খেসারত দিতে হতে পারে! আগামী নির্বাচনের নমিনেশন তালিকা থেকেই হয়তো এর মাঝে তার নামটা কাটা পড়ে গেছে লাল কালিতে! নিজেদের এমন একশ সমস্যা বহাল রেখে রোগের আসল-ওষুধ বাদ দিয়ে, সঙ্গে আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজদের রেখে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো ব্যক্তিত্বকে মাপ চাওয়ানো্র জন্য সংসদে টেনেহিঁচড়ে নেবার খায়েশ যাদের হয়েছে, দেশে-বিদেশে এমন কর্মের প্রতিক্রিয়া-পরিণতি কী দাঁড়াতে পারে তা কী তারা একটুও ভেবে দেখেছেন? ট্রাই করে দেখবেন? অধ্যাপক সায়ীদকে সংসদে যদি যেতে হয় তার সঙ্গে-পেছনে দেশের শিক্ষিত মানুষজনের বড় একটি মিছিলও কিন্তু হেঁটে যেতে পারে! সে মিছিলের কেউ কী আর উনাদের আগামীতে ভোট দেবে?
ফজলুলবারী : সিডনিপ্রবাসীসাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় : ১১৩৩ ঘণ্টা, ০৪ জুন, ২০১২
- অধ্যাপক আবু সায়ীদকে নিয়ে এমন আলোচনা ঠিক হয়নি: ডেপুটি স্পিকার
- সায়ীদ স্যারকে সংসদে তলব করুন, প্লিজ
- ‘ অধ্যাপক আবু সায়ীদকে সংসদে এসে ক্ষমা চাইতে হবে’
সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
ahsan@banglanews24.com;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
Jewel_mazhar@yahoo.com