সাংবাদিকদের নির্যাতন করছে পুলিশ । মারছে, মেরেছে।
ফটো সাংবাদিকদের পিটিয়ে আহত করার পর সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয় নি। বরং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু পুলিশ থেকে সাংবাদিকদের সাবধান থাকার কথাটাই বলেছেন। প্রতিমন্ত্রী এই কথাটা বলে যতটা না সাংবাদিকদের সতর্ক থাকার তাগিদ দিলেন, তারও চেয়ে বেশি অপমান করলেন গোটা পুলিশ বাহিনীকেই। কারণ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তার কথার মধ্য দিয়েই বুঝিয়ে দিলেন পুলিশ তার হাতের নাগালের মধ্যে পেলে কামড় বসাতেই পারে। নিরাপত্তাজনিত কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর বিভিন্ন বাসা-বাড়ি কিংবা কোনো কোনো জায়গায় একটা কথা প্রায়শই লক্ষ্য করা যায়----‘বিওয়ার অব দ্য ডগ’’ । সাবধান থাকাটার জন্যেই মূলত এগুলো করা হয়ে থাকে। এখন হয়ত বাংলাদেশের অভিজাত এলাকায় এই শব্দগুলো শোভা পায়। সত্যি বলতে কি, পশ্চিমা দেশের কুকুরগুলো কিন্তু কামড় মেরে কয়েক বছরেও একবার নিউজ আইটেম হয় না। সেখানে আমাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পুলিশ বাহিনীকে নিজেই একটা স্তর নামিয়ে দিলেন এবং প্রমাণ করলেন, আজকের বাংলাদেশে তার এই অতি সাবধানী পুলিশ বাহিনী তাকে কিংবা তার মতো অনেককেই শুধু পাহারা ও সুরক্ষা দেয়। জনগণকে কিংবা সাংবাদিকদের নয়।
সাংবাদিকরা আক্রান্ত হয়েছেন। এ খবরটি গুরুত্বসহ এসেছে সব গণমাধ্যমেই। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সত্যি কথা হলো, বাংলাদেশের পুলিশ শুধুই কি সাংবাদিক পেটায়? এ প্রশ্নটির উত্তর কিন্তু খুবই সোজা। বাংলাদেশের পুলিশ মূলত তার চিরাচরিত নিয়মের মধ্যেই কাজগুলো করেছে। যখন সাংবাদিক নিপীড়নের খবর আমরা পত্রিকায় পড়েছি, ঠিক তখনই আদালতপাড়ায় একজন পিতাকে বাঁচাতে গিয়ে পুলিশ কর্তৃক পুলিশ ক্লাবে নিরীহ তরুণীর শ্লীলতাহানির খবর বেরিয়েছে। এসমেয়ই পড়েছি আমরা তিন সাংবাদিক ও দুই আইনজীবীকে পেটানোর সংবাদ। এর পরদিনও নাকি গাজীপুরে পুলিশ এক আসামিকে ধরে সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দিয়ে নিজেদের চোখের সামনে খুনই করিয়ে ফেললো। এর আগের ঘটনাগুলোতো আমরা জানি। বিরোধী দলের চিফ হুইপ আক্রান্ত হয়েছিলেন, আহত হয়েছিলেন, বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। লিমন-কাদেরদের দিয়ে র্যাব-পুলিশের অপকর্মের ফিরিস্তি আরও বাড়ানো যাবে। সোজা-সাপটা কথা হলো সারাটা দেশেই পুলিশ বাহিনী এক ধরনের বেপরোয়া ।
২) সম্প্রতি সাংবাদিকদের পেটানোর পর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডটি আবারও গণমাধ্যমে আসছে। আসছে একারণে যে, এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কোনো সুরাহা হচ্ছে না। এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে পুলিশ ও সরকারের সরকারের নির্লিপ্ত থাকার ব্যাপারটা উঠে আসছে। হত্যাকাণ্ড নিয়ে যদি সরকার নির্বিকার থাকে, সাংবাদিক নিপীড়ন নিয়ে যদি সরকার পুলিশের পক্ষে সাফাই গায়, তাহলে সাংবাদিকদের মতোই জনমতও একটু একটু করে সরকারের বিপক্ষে যাবে।
সাংবাদিক হত্যার বিষয়টি নতুন কোনো ইস্যু নয়। এর আগে দক্ষিণাঞ্চলে সাংবাদিক মানিক সাহা, হুমায়ূন কবির বালু, শামছুর রহমান, গৌতম দাসদের হত্যা করা হয়েছে। শামছুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সাথে এমনকি বিএনপি সরকারের মন্ত্রী তরিকুল ইসলামের জড়িত থাকার কথা সবসময়ই উচ্চারিত হয়। অর্থাৎ কোনো সরকারের আমলেই সাংবাদিক নিরাপদ ছিলেন না। অনেক নির্যাতন-হত্যার মধ্যি দিয়েই সাংবাদিকদের এগুতে হচ্ছে। সাংবাদিক হত্যার ঘটনাগুলো মূলত একটা স্বার্থান্বেষী মহলই ঘটায়। প্রশাসনের উপরের জায়গাগুলোতে এদের একটা বিরাট প্রভাব কাজ করে।
৩) পুলিশের তো মানুষের নিরাপত্তা দেবার কথা। পুলিশ প্রয়োজনে অপরাধীদের ধরবে, থানায় নেবে, আদালতে তুলবে। পশ্চিমা স্ট্যান্ডার্ডে আমরা কিংবা আমাদের পুলিশ প্রশাসন চলবে না। কিন্তু ন্যূনতম মানবিক দায়িত্বটুকুতো থাকা প্রয়োজন। এ দায়িত্বটুকু থাকে না কেন? এ প্রশ্নটিই আমাদের ভাবায়। পুলিশ বিভাগে যখন লোক নিয়োগ হয়, তখন অনিয়মের কথাটা উঠে আসে। লাখো-কোটি টাকা ঘুষ লেন-দেনের ব্যাপারটাও ওপেন সিক্রেট। কিন্তু এই ওপেন-সিক্রেটের মাঝেও কাজ করে ‘লীগ-জাতীয়তাবাদী নিয়োগ’। যারাই ক্ষমতায় আসেন, তাদের ক্যাডারদের দিয়ে শূন্য পদগুলো পূর্ণ করা হয়। এবং প্রত্যেক ক্যাডারই নিজ নিজ পৃষ্ঠপোষকদের মিশন বাস্তবায়নে রাজপথে থাকেন, ঠেঙ্গান। মিশন বাস্তবায়ন করে কিংবা বড় ভাইদের প্রয়োজনে রাজনীতিক, সাংবাদিক কিংবা জনগণের উপর এক হাত নিয়ে এরা মিডিয়ায় লাইমলাইটে আসেন। এবং একসময় তারাই পদোন্নতি পেয়ে বড় বড় পদ পেতে সক্ষম হন। আর সেজন্যেই বিএনপি আমলের কোহিনুর এবং এই সরকারের হারুনদের আদর্শ নিয়েই পুলিশ বাহিনী মাঠে থাকে।
সাংবাদিকরা ক্ষুব্ধ। শুধু সতীর্থদের বিচারের দাবিতেই নয়, এমনকি নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এই প্রতিবাদের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মতোই প্রধানমন্ত্রীও যেন উষ্মা প্রকাশ করছেন। গত দুদিন আগে তিনি বলেছেন, কিছু কিছু মিডিয়া সরকারের বিরুদ্ধে না বললে না-কি ভাত হজম হয় না। প্রধানমন্ত্রীর এ কথা দিয়ে মিডিয়ার উপর ক্ষোভ ঝেড়েছেন। কিন্তু আমরা ভেবে পাই না কেন যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীরা ভুলে যান, মিডিয়া শুধু প্রশংসা কিংবা চাটুকারিতা করার জন্যেই নয়। পৃথিবীর সব দেশেরই গণমাধ্যম কোনো না কোনোভাবে সরকারের-সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরার চেষ্টা চালায়। সাধারণ মানুষের গোচরে-অগোচরে ঘটমান জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক ঘটনাগুলোকে তুলে ধরা সংবাদকর্মীদের পেশা এবং দায়িত্ব। এ দায়বোধ ভাত হজম করার জন্যে নয়।
সাংবাদিক বলি কিংবা সাধারণ মানুষ বলি দেশে চলমান গুম-হত্যা-নির্যাতন মূলত প্রচলিত সমাজব্যবস্থারই চিত্র। যে সমাজব্যবস্থাটা কোনো সরকারই ভাংতে পারছে না। সব সরকারই নিজেদের প্রয়োজনে বিভিন্ন বাহিনীকে ব্যবহার করে।
স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে ব্যবহৃত এসব বাহিনী হয়ত তাদের অজান্তেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আর সেকারণেই ঐ একই বাহিনী ভাড়াখাটা মাস্তানদের মতো সময়ে সময়ে, এমনকি সরকারের পটপরিবর্তনের পর আগে যাদের পিটিয়েছিলো তাদের নির্দেশেই অন্যদের পিঠায়। আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই পুলিশ যা করছে তা সরকারের কোনো এজেন্ডার অংশ নয়। কেউ কেউ বলছেন, অতি উৎসাহী পুলিশ সরকারকে ডোবানোর জন্যে এ কাজগুলো করছে। মন্ত্রী-এমপিদের কথাবার্তা শুনলে কিন্তু তেমনটা মনে হয় না। সেজন্যে সংযত হতে হবে সরকারকে। সাংবাদিক এবং পুলিশের মধ্যে "নিরাপদ দূরত্ব’’ নয়,বরং বন্ধুসুলভ সৌহার্দ্যের বাতারবণ তৈরি করাই এখন সরকারেরই দায়িত্ব।
faruk.joshi@gmail.com
লেখক: যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
Jewel_mazhar@yahoo.com