আবদাল ভাই কিছুদিন আগে একটি মেইল করেছিলেন। সৈয়দ আবদাল আহমেদ।
ব্যক্তিগত সম্পর্কের চাইতে লেখাটিই আমার কাছে বড়। আবদাল ভাইর সেই ই-মেইলেরও জবাব দেয়া হয়নি। কারণ আমার ইচ্ছা ছিল বিষয়টি আমি খোলাসা করে লিখবো। এখানে সে লেখাটাই লিখছি।
মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা, একাত্তরে মিরপুর এলাকার ‘কসাই’ বলে পরিচিত কাদের মোল্লা, শেরপুর-জামালপুর অঞ্চলের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের বিচার শুরু হয়েছে। এই কাদের মোল্লা-কামারুজ্জামান দুজনেই কিন্তু জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য! আবদাল ভাই যে প্রেসক্লাবের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। বাংলাদেশের জন্মবিরোধী পাকিস্তানপন্থী যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী আবার তাদের পত্রপত্রিকার নামগুলোও বেছে বেছে নিয়েছে! দলীয় মুখপত্রের নাম দৈনিক সংগ্রাম! দলীয় সাপ্তাহিকের নাম ‘সোনার বাংলা’! বাঙ্গালি যখন মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রাম করছে, জামায়াত সংগ্রাম করছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের পক্ষে! মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী নাম দিয়ে খতম করছে, আবার সেগুলোও সগৌরবে (!) দৈনিক সংগ্রামে ছেপেছেও! ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, একাত্তরের সেই সংগ্রামের ফাইলই আজ জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের বিচারে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের কাছে বড় দলিল হয়ে দাঁড়িয়েছে!
`সাপ্তাহিক সোনার বাংলা`র সম্পাদক হিসাবে কামারুজ্জামান জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য হন। আর কাদের মোল্লাকে প্রেসক্লাবের সদস্য করা হয় সংগ্রাম পত্রিকার কেয়ার অফে! বাংলাদেশের সাংবাদিক সংগঠনগুলো আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই রাজনৈতিক দলের নামে বা লেজুড় ফোরামে বিভক্ত। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফোরাম, সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের মতো আইনজীবী সংগঠন সমূহ, এমনকি ডাক্তারদের সংগঠনও এমন দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে বিভক্ত! আওয়ামী ফোরামে বামপন্থী অথবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংগঠন-ব্যক্তিরা যেমন আছেন, তেমনি বিএনপির ফোরামের সঙ্গে জামায়াতসহ ডানপন্থী দল, চীনপন্থী দল বা ব্যক্তিরাও আছেন। সে হিসাবে আমার আবদাল ভাই যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা-কামারুজ্জামানেরও নেতা!
আমরা যখন সাংবাদিকতায় আসি, তখন আমাদের কাছে জাতীয় প্রেসক্লাব স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের এক রকম কন্ট্রোল টাওয়ার অথবা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ! প্রেসক্লাবের সদস্য সাংবাদিক মানে আমাদের চোখে বিশেষত অভিজাত এক চরিত্র! আমরা যারা প্রেসক্লাবের সদস্য নই, তারা প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কত কৌশলে যে মাঝে মাঝে প্রেসক্লাবে ঢুকে যেতাম! তখনও কাদের মোল্লা-কামারুজ্জামানদের প্রেসক্লাবের ভিতরে বসা দেখতাম। ঘৃণায় অথবা রাগে শরীর রি রি করতো! কারণ সাংবাদিকতায় আসার আগে সারাদেশ পায়ে হেঁটে ঘোরার সময় আমার সাবজেক্টটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় বিবরণ সংগ্রহ করা। মুক্তিযোদ্ধা এবং স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের ইন্টারভ্যু করে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরদের নৃশংস কাহিনীগুলোও সংগ্রহের চেষ্টা করেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাটি কখনোই আমি জানার বা সংগ্রহের চেষ্টা করিনি! কারণ আমার কাছে গুটিকয় স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া দেশের আর সবাই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মুক্তিযোদ্ধা। আমি বরঞ্চ এলাকায় এলাকায় রাজাকারদের তালিকাটি সংগ্রহে বেশি যত্মবান ছিলাম। খুব বড় নয় সে তালিকা।
এলাকার সিনিয়র লোকজনের কাছে প্রায় সব নামই মুখস্ত। সারাদেশে নৃশংস প্রকৃতির যেসব স্বাধীনতা-বিরোধী রাজাকার-আল-বদর চরিত্রের সন্ধান আমি পেয়েছি, কাদের মোল্লা-কামারুজ্জামান তাদের অন্যতম! ঢাকার মিডিয়ায় এসে দেখি সে দুজনও কিনা কেতাদুরস্ত রাজনৈতিক নেতা! পত্রিকার সম্পাদক! জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য! মগবাজারের অফিসে আমাকে বিভিন্ন সময়ে জামায়াতের নীতি-আদর্শ, একাত্তরের ভূমিকা এসব বোঝাতেন কামারুজ্জামান! আমিতো তার এলাকা থেকে পাওয়া আমলনামা জানি! তাই সেই বয়সের সাহসে তাদের দুর্গের ভিতর সামনা-সামনি বলেও দিতাম, সব বুঝলাম, কিন্তু এখানে খুন-রেপ করাটা ঠিক হয়নি! মুখের ওপর এমন কথা শুনে অপ্রস্তুত বলতেন, ``না না আমি রেপ করিনি!``
সেই কামারুজ্জামানকে দেশের সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় ও সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রেসক্লাবের অভিজাত সদস্য (!) হিসাবে দেখতে কেমন লাগতে পারে তা বোধগম্য। এখনকার নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের কেমন লাগে, জানতে ইচ্ছে করে।
নয় বছর ক্ষমতার সময়ে অনেক চেষ্টা করেও এরশাদ কোনদিন জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢুকতে পারেননি। তখনও তার কিছু পোষ্য সাংবাদিক প্রেসক্লাবের সদস্য ছিলেন ঠিক, কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস ছিলো না। কিন্তু এরশাদবিরোধী আন্দোলনে মিশে যাওয়াতে কাদের মোল্লা-কামারুজ্জামানের মতো সাংবাদিক নামধারী বাংলাদেশবিরোধী জামায়াতিরা ছিলেন প্রেসক্লাবে অবারিত!
এরপর যখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলন শুরু হয় তখনও জামায়াতিরা প্রেসক্লাবে অবারিত! যুদ্ধাপরাধী পক্ষের জামায়াতিদের মতো আবদাল ভাইরাও আমাদের সামনে শহীদ জননীকে উপহাস করে বলতেন ‘জাহান্নামের ইমাম’! আমার কাছে অবাক লাগতো যে বিএনপিপন্থী সাংবাদিক অনেকেরও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এমন যেন, গোলাম আযম না, তাদেরই বিচার হয়ে যাচ্ছে! কারণ জামায়াতি সাংবাদিকরাও যে তাদের ফোরাম করেন! গোলাম আযমের বিচারের গণআদালতকে কেন্দ্র করে যেদিন গোটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জনসমুদ্র, সেদিনও জাতীয় প্রেসক্লাবে জামায়াত ছিল অবারিত, নিরাপদ! এখন এবারই প্রথম রাষ্ট্র যখন আমাদের শহীদ পরিবারগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি মেনে নিয়ে এই বিচার শুরু করেছে, তখন রাজধানী ঢাকা শহরে শুধু নয়, সারা দেশের মধ্যে সেই বিচারবিরোধীদের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাটির নাম জাতীয় প্রেসক্লাব!
এটিই যেন তাদের নোম্যান্সল্যান্ড! অথচ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙ্গালির স্বাধিকার আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুর সঙ্গে এই প্রেসক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন প্রেসক্লাবের সদস্য অনেক সাংবাদিক। সেই শহীদ সাংবাদিকদের নামফলকসহ নানাকিছু প্রেসক্লাবের রেকর্ডে আছে। স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সদস্য সাংবাদিকদের কোনো রেকর্ড প্রেসক্লাবে সংরক্ষণ করা নেই বা প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ এর দরকারও মনে করেনি। সেই জাতীয় প্রেসক্লাব কেন বাংলাদেশবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবিরের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হবে? বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় এক সময়কার কুলীন পুরস্কার, ফিলিপস পুরস্কার বিজয়ীদের অন্যতম প্রিয় আবদাল ভাইকে কি বোঝাতে পেরেছি, কেন আমি তাদের ‘অভয়াশ্রম’ কথাটি লিখেছিলাম?
এখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম দুই ঘৃণিত চরিত্র কাদের মোল্লা-কামারুজ্জামানের ব্যাপারে জাতীয় প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ এবং এর সদস্য সাংবাদিকদের অবস্থান স্পষ্ট করতে বলবো। জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য কাদের মোল্লা-কামারুজ্জামানকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারের প্রতিবাদে-নিন্দায় কি প্রেসক্লাব নেতৃত্ব কোনো বিবৃতি দিতে পেরেছেন? তেমন একটি বিবৃতি তৈরি হয়েছিল জানি, কিন্তু কেন তা মিডিয়ায় পাঠানোর সাহস করা হয়নি, তাও ওয়াকিফহালরা জানেন। এমন একটি নৈতিক দুর্বলতা যেখানে স্পষ্ট, সেখানে এত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাংবাদিকের ভিড়ে তাদেরকে প্রেসক্লাবের সদস্যপদে ধরে রাখার নৈতিক যুক্তিটা কি? মনে রাখা ভালো যে, গুদামের পচা আলু ফেলে দেয়া হয়, নইলে তা ভালো আলুতেও পচন ধরায়!
তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশে গ্রেফতার, বিচার শুরু হয়েছে, অপরাধ প্রমাণিত হয়নি, এমন বলা হবে? তাহলে তাদের গ্রেফতারের নিন্দা-মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দেওয়া গেলো না কেন? বা এখনও কেন দেয়া যাচ্ছে না? বা প্রেসক্লাবের এত শত শত সদস্যের মধ্যে এ দুজন ছাড়া আর কারও বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ আছে কি? বা প্রেসক্লাবের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিকরা কি এমন দুজন চিহ্নিত সদস্যের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানটির সদস্য থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন? বিচার শেষ হয়নি, অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, এমন খোঁড়া যুক্তিতে যদি এমন চিহ্নিত দুজনকে প্রেসক্লাবের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রাখাটাই জরুরি মনে করা হয়, তাহলে তাদের সদস্যপদ কি আপাতত স্থগিত রাখার উদ্যোগ নেয়া যায় না? কত ঠুনকো, মামুলি অজুহাতেও তো সেখানে অনেকের সদস্যপদ বাতিল-স্থগিত করা হয়! জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য সাংবাদিকদের বিবেকের কাছে প্রশ্নটি রাখলাম। হয় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’, যে কোন একটি সিদ্ধান্ত তাদেরকে দ্রুত নিতে হবে।
এটি কোন লুকোছাপার বিষয় না। পষ্টাপষ্টি। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড, সাংবাদিক নির্যাতন, অষ্টম ওয়েজবোর্ড এসব ইস্যুতে সাংবাদিকরা প্রশংসনীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। প্রেসক্লাবে সদস্য এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন সদস্য দুজনের ব্যাপারেও তারা সিদ্ধান্তটি ঐক্যবদ্ধভাবেই নেবেন আশা করছি। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বড় কিছু আমাদের হতে পারে না, থাকতে পারে না। জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য সম্মানিত সাংবাদিকদের কেউ একাত্তরের বাংলাদেশবিরোধী খুনি-যুদ্ধাপরাধীর সহযোগী-দোসর হিসাবে রাস্তঘাটে ডাকুক, রিপোর্ট লিখুক তা-ও আমরা চাই না।
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
সম্পাদনা: নজরুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর Jewel_mazhar@yahoo.com