জনপ্রশাসনে বিগত ১০ বৎসরের ওএসডি এর সংখ্যা জানাতে সম্প্রতি মহামান্য আদালত এক রুল জারি করেছেন জেনে সম্বিত ফিরে পেলাম। সময়ের ব্যবধানে ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমিও একজন ওএসডি।
সেসময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের পরিবর্তিত আচরণ দেখে অনুমিত হয়েছিল, আমি যেন নিম্নশ্রেণীভুক্ত এক প্রাণীতে রুপান্তরিত হয়ে গেছি। প্রতিকারের প্রত্যাশায় তৎকালীন স্বাস্থ্য সচিব ফজলুর রহমানের সাক্ষাৎ প্রার্থী হলে তিনি ব্যস্ততার অজুহাতে সাক্ষাৎ দেননি। যে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হিসেবে দিনরাত শ্রম দিয়েছি তারা যেন আমার প্রতিপক্ষ রূপে আবির্ভূত হলেন। অগত্যা ২৪শে আগষ্ট ২০০২ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ওএসডি হিসেবে যোগদানপত্র দাখিল করার মাধ্যমে আমার ওএসডি জীবনের শুরু হল।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে সেসময় আমাকে আমার অপরাধ জানানো হয়নি। শেষ দেখার মানুষ আমি, তাই শুরু হল আমার ঘটনার পেছনের ঘটনা জানার অভিযান। বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছিলাম আমার ওএসডি এর পেছনে সরকারি কর্ম কমিশনের হাত রয়েছে। পরবর্তীতে নিশ্চিতভাবে জানলাম, বিভিন্ন অভিযোগে চার বৎসর পূর্বে কৃত আমার ‘সহযোগী অধ্যাপক’ এর সুপারিশ বাতিল করা হয়েছে! সেসময়, একবেলা সরকারি কর্ম কমিশন আর অন্যবেলা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ঘোরাঘুরির মাধ্যমে পার করা জীবনের নিকৃষ্টতম দিনগুলির কথা মনে হলে এখনও শিউরে উঠি। সেই সময়ের অনুসন্ধানে আমি দেখেছি, সরকারি কর্ম কমিশনে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া বিড়ালসম বাঘদের হম্বিতম্বি।
জেনেছি কী অনিয়মেই না পড়েছে দেশের সর্বোচ্চ নিয়োগের সুপারিশকারী কর্তৃপক্ষ। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের ফর্দ দেখে হাসব না কাঁদবো ভেবেই আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। অভিযোগের একটিও সত্য নয় অথচ ব্যবস্থা নেওয়ার আগে সরকারি কর্ম কমিশন আমাকে কারণ দর্শানোর কোনো সুযোগ দেওয়ার অথবা পূনঃতদন্ত করার প্রয়োজন অনুভব করেনি।
তৎকালীন সদস্য ডা. সোহরাব আলী আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে অথবা হওয়ার উদ্দেশে যে মূল ভুমিকা পালন করেছিলেন তা বের করতে আমার কোনো অসুবিধা হল না যখন নথিতে দেখলাম তার নোটসমূহ। মিথ্যাকে সত্য বানাতে তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন, “সিভিল সার্জন আদর করে আমাকে দিয়ে ২/১ টি ময়না তদন্ত করিয়েছেন, আমি আর্থসামাজিক প্রতিপত্তি খাটিয়ে অভিজ্ঞতার সনদ যোগাড় করেছি” ইত্যাদি ইত্যাদি!
দেখেছি, ফরেনসিক মেডিসিনের তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক ডা. হাসানুজ্জামান ভূঁইয়া কিভাবে অবিরামভাবে আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা অভিযোগনামা দাখিল করেছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, যে অভিযোগনামার ওপর ভিত্তি করে সরকারি কর্মকমিশন আমার সহযোগী অধ্যাপকের সুপারিশ বাতিল করেছিল ইতিপূর্বে দাখিল করা হবুহু একই অভিযোগনামার ওপর দেশ-বিদেশে গোপন তদেন্ত সরকারি কর্মকমিশন অভিযোগের কোনোরকম সত্যতা খূঁজে পায়নি। শুধু কি তাই, একই অভিযোগের কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাদীর উপস্থিতিতে যে তদন্ত করেছিল সেখানেও আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো সত্যতা তারা খুঁজে পান নি।
প্রিয় পাঠক, আমি ফরেনসিক মেডিসিনে বাংলাদেশের প্রথম পিএইচডি। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা, দীক্ষা, অভিজ্ঞতায় আমি খব একটা ফেলে দেওয়ার মত নিশ্চয়ই নই। অথচ আমাকেই কিনা কী অন্যায় ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হল!
মনে পড়ে, আমি যখন ইউএনডিপি ফরেনসিক কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০১ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করি, তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম আমার শিক্ষা আর অভিজ্ঞতার আলোকে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পদায়ন করেন। আপাত দৃষ্টিতে তা আমার জন্য সুখকর হলেও সরকার পরিবর্তনে আমাকে আওয়ামী লীগের অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত করা সহজ হয়ে পড়ে, যদিও কোনোকালেই কোনো দলের সাথে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না।
আমি দেশের জ্যেষ্ঠ এবং বিজ্ঞ আইনজীবীদের পরামর্শে আদালতের স্মরণাপন্ন হই। মন্ত্রণালয় তার আপন স্টাইলে সরকারি কর্ম কমিশনের হবুহু একই অভিযোগের ভিত্তিতে আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করে। একাধিকবার আমাকে বিভাগীয় মামলার শুনানিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মহোদয়ের কক্ষে হাজিরা দিতে হয়।
মনে পড়ে, ২০০৫ সালে আমি সেখানে হাজির হলে, স্বাস্থ্যঅধিদপ্তরের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আমার দলিলাদি পরীক্ষা করে আমার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে স্বীকার করেও অজ্ঞাত কারণে কোনওরকম আদেশ প্রদানে অতিরিক্ত সচিব (লুৎফুল কবীর) মহোদয় বিরত থেকেছেন। আমার অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা হয়েছে।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে ডাকা হলে আমি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মহোদয়ের কক্ষে শেষবারের মত হাজির হই। অতিরিক্ত সচিব মহোদয় স্বাস্থ্যঅধিদপ্তরের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আমার অভিযোগ খণ্ডানোর দলিলাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে আমাকে স্বপদে যোগদানের আহ্বান জানান। আমি স্ব-ব্যাখ্যায়িত কারণে আমার অপারগতা জানাই এবং ২৫ বৎসর পূর্তিতে পূর্ণ সুবিধায় আমাকে সরকারি চাকরি থেকে অবসর প্রদানের অনুরোধ জানাই। অবশেষে, স্বারক নং স্বাপকম/ শৃংখলা-১/১-২৭/২০০৩-১১৭ তারিখ ২৫/১/২০১২ আদেশে আমার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ থেকে আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
যে দেশকে সেবা দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে আমি আমার জাতিসংঘের চাকরি থেকে ইস্তেফা দিয়েছিলাম, মানসিক ধকলে সেখানে সেবা দেওয়ার আর কোনও অভিপ্রায় এখন আমার অবশিসষ্ট নেই। তাছাড়া, নিজ যোগ্যতায় আমি এখন ফরেনসিক বিষয়ে মালয়েশিয়ার একমাত্র অধ্যাপক এবং মালয়েশিয়ার সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সিনিয়র ফরেনসিক কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত আছি।
প্রিয় পাঠক, “পিকচার আভি বাকি হ্যায়। ” আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি মানহানি মামলার। গণ্ডমূর্খের মাথা কাউকেই ছাড় দেওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। আমি প্রকাশ করতে চাই সেই সব চরিত্রের যারা অজ্ঞ হয়েও বিজ্ঞের চেয়ারে বসেছিলেন। যাদের কারণে দেশ তার শ্রেষ্ঠ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞকে হারিয়েছিল। আমার জন্য দোয়া করবেন।
পাদটিকা : অনেকেই আমার ইতিবৃত্য শুনে মন্ত্রণালয়ে কত টাকা খরচ হয়েছে জানতে চান! আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হুমায়ুন কবির, অতিরিক্ত সচিব একেএম আমির হোসেন, উপসচিব আনোয়ারা বেগম, সিনিয়র সহকারি সচিব সাগরিকা নাসরিন ও সাইদুর রহমানের প্রতি সর্বোচ্চ কৃতজ্ঞতা রেখে বলছি, তারা প্রত্যেকেই অতি সৎ, ভদ্র, অমায়িক এবং তাদের মত অফিসাররা আছেন বলেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখনও টিকে আছে।
লেখক: ড. (ডা.) মোহাম্মদ নাসিমুল ইসলাম
এমবিবিএস, এমসিপিএস, ডিএলএম, এলএলবি, এফআরসিপি, পিএইচডি, অধ্যাপক ও সিনিয়র ফরেনসিক কনসালট্যান্ট, ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা, মালয়েশিয়া
বাংলাদেশ সময় : ২১৫২ ঘণ্টা, ০৭ জুন, ২০১২
সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
ahsan@banglanews24.com