সুমন নামের কিশোরটি ফিরে এসেছে নয় মাস পর। এই নয় মাসে সে জেনেছে কিভাবে মার খেতে হয়।
দৈনিক কালের কণ্ঠ জানিয়েছে, ঢাকার চকবাজারের জয়নাগ রোডের ২২/খ বাড়িতে ২০১১ সালের ৩০ জানুয়ারি রাতে রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে ঐ বাড়ির গৃহকর্মী আকলিমার। গৃহকর্তা বরকত মুন্সী আকলিমা বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠত হয়ে মারা গেছে বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আটমাস পর এ মৃত্যুর রহস্য অন্যদিকে মোড় নেয়। প্রমাণিত হয় এটা কোনো মৃত্যু নয়; এটা আসলে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা। আর সেজন্যেই পুলিশ খুঁজতে থাকে ধর্ষককে। ধরে নিয়ে যায় ঐ বাড়িতে কাজ করা কিশোর সুমনকে।
তারপর সুমনের কিশোর-জীবনের এক শ্বাসরুদ্ধকর অধ্যায় চলে দীর্ঘ নয়টি মাসজুড়ে। চকবাজার থানার ওসির নির্দেশে থানার এসআই দিনের পর দিন তাকে নির্যাতন করেছেন। তাকে বলতে হবে সে-ই ধর্ষণ করেছে আকলিমাকে, তারপর হত্যা করেছে শ্বাসরোধ করে। কিন্তু কিশোর সুমন সে দায় নেবে কেন? তাইতো বারবার সেই অসত্যকে সে স্বীকার করতে রাজি হয়নি।
কিন্তু সুমনের দাবি, পুলিশের চরম নির্যাতনে বাধ্য হয়ে তাকে শেষ পর্যন্ত বলতেই হয়, সে-ই আকলিমার হত্যাকারী।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, হত্যাকারী আসলে কে ? যুক্তি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, কিশোর সুমনই (আসলে সে একটা ছোট্ট শিশু!) আকলিমাকে গলা টিপে মেরেছে। কিন্তু দুর্ভাগা আকলিমা যে শিশু সুমনেরই নির্যাতনের শিকার, তা বের করতে একজন পুলিশ অফিসারের দীর্ঘ নয়মাসব্যাপী নির্যাতন করতে হবে; তাও আবার সুমনের মতো একটা শিশুকে!আজকের এই সভ্য দুনিয়ায় এই বীভৎসতা কিভাবে মেনে নেওয়া যায়!
অপরাধী শিশু-কিশোরদের শারীরিক বা মানসিকভাবে পীড়ন করার কোনো ক্ষমতা পুলিশ কোথায় পেল? কোন আইনে বা কে তাদের এই ক্ষমতা বা এক্তিয়ার দিয়েছে? সভ্য দুনিয়ায় তো এটা কল্পনারও অতীত। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের আইনেও তা নিষিদ্ধ। এর ওপর স্রেফ একটি মিথ্যেকে সত্যে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে পুলিশ অফিসার যে নির্যাতন চালিয়েছেন তা ভয়াবহ অপরাধের পর্যায়ে পড়ে বললেও কম বলা হবে। অন্যদিকে আকলিমার ধর্ষণ কিংবা হত্যাকাণ্ড প্রমাণের জন্যে আজকের দুনিয়ায় বিজ্ঞান তো অনেক এগিয়ে। মৃত্যুর আট মাস পর যেখানে প্রমাণ পাওয়া গেছে আকলিমা প্রথমে ধর্ষণ এবং পরে শ্বাসরোধে হত্যার শিকার, সেখানে কে বা কারা এই জঘন্য কাণ্ড ঘটিয়েছে তা খুঁজে বের করতে বিজ্ঞানের কি খুব বেশি দূর যেতে হবে?
ডিএনএ টেস্টের ব্যাপারটা এখন খুব একটা বড় ধরনের ব্যয়ের মধ্যেও পড়ে না। না-কি সরকারের এই খরচ বাঁচাতে একজন কিশোরকে পুলিশ অফিসারদের এই নির্যাতন! যেহেতু সুমনের পরিবার আঙ্গুল তুলেছে ঐ গৃহকর্তা বরকত মুন্সীর পরিবারের দিকেই, সেহেতু আইন এবং এমনকি সাধারণ জ্ঞানেও মনে হয় প্রথমে এই পরিবার দিয়েই শুরু করা উচিৎ হত্যাকাণ্ডের তথ্যানুসন্ধান।
কোনো মহিলা কিংবা পুরুষ নিহত হলে দেখা যায় তার স্বামী কিংবা স্ত্রী কিংবা তার সাথে বসবাসরতরা থাকে পুলিশের প্রধান সন্দেহের খাতায়; সেখানে আকলিমার মত্যুকে গৃহকর্তার বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ হয়ে মত্যু বলে চালিয়ে দেবার পর কিশোর সুমনকে পুলিশ কেন খুনি বলে সন্দেহ করে বসলো---জনমনে এমন প্রশ্ন জাগাটাই তো স্বাভাবিক।
২) নরসিংদীতে গত ১০ জানুয়ারি ইমান আলী শেখ নামের একজন বিচারককে পুলিশ শরীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে। বিচারক তার পরিচয় দিয়েও রেহাই পাননি। স্বাভাবিকভাবেই বিচার বিভাগতো বটেই, সারাদেশে এর একটা কুপ্রভাব পড়েছে। একজন বিচারককে লাঞ্ছিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পুলিশ যে কত বেপরোয়া, কতো ক্ষমতাদর্পী আর বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে তা আবারও প্রমাণিত হলো। এ ঘটনায় বরাবরের মতো সেই নামকাওয়াস্তে শাস্তি---সেই তিনজন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
মাত্র ক’দিন হয়েছে পুলিশ সাংবাদিক পিটিয়েছে, খোদ আদালতপাড়ায় পিতার উপস্থিতিতে এক নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটিয়ে প্রতিবাদকারী সাংবাদিক ও আইনজীবীদের পিটিয়েছে। এর রেশটা এখনও শেষ হয়নি। এরই মাঝে ঘটিয়ে দিলো তারা আরেকটি ন্যক্কারজনক ঘটনা। তারা অপমান করলো গোটা বিচার বিভাগকে। যেন পেটালো তারা পুরো প্রতিষ্ঠানটিকে। জন্ম দিলো আরেকটা নতুন অপরাধের।
দিনের পর দিন যেন বেপরোয়া হয়ে উঠছে আমাদের পুলিশ। পুলিশ জনগণের বন্ধু না হয়ে এখন ক্রমেই যেন আতংক হয়ে আত্মপ্রকাশ করছে। কি এক অদৃশ্য শক্তি আছে তাদের পেছনে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী--কেউই এই বিভাগটিকে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে কোনো কথাই উচ্চারণ করেন না। বরং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু সাংবাদিকদের পুলিশ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। আর স্বরাষ্টমন্ত্রী সাহারা খাতুন তো সাংবাদিক পেটানোর পরদিনই নির্যাতক পুলিশের শাস্তিবিধানের বদলে পুলিশ বাহিনীর গদগদ প্রশংসাই করেছেন।
পুলিশের থেকে সাংবাদিকদের দূরে থাকার মানে হলো জনগণকে আরও দূরে থাকতে হবে পুলিশ থেকে। যদি সাংবাদিক, নারী, বিচারক, সুমন, লিমন,কাদের কিংবা সাধারণ মানুষদের পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কাছ থেকে দূরেই সরে থাকতে হয়, তাহলে তাদের কাজটা কি ? না-কি শধুই সরকার কিংবা সরকার দলীয় ভিআইপিদের সুরক্ষা দিতেই তাদের তৈরি করা হচ্ছে এখন থেকে?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি একটিবার ভেবে দেখেছেন, কিভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠছে জনগণের সেবক নামের এই গ্রুপটি? প্রধানমন্ত্রী কি একটিবারও চিন্তা করছেন না তার সরকারের অনেক অনেক সফলতা ম্লান হয়ে যাচ্ছে পুলিশ বাহিনীর একটা গ্রুপের এই হিংস্র-লেঠেল মনোবৃত্তির কারণেই ? স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কি মনে করেন না যে বাহিনীর অন্যায়কে তিনি আশকারা দিচ্ছেন, তার সেই বাহিনীই ফ্রাংকেনস্টাইনের দানব হয়ে উঠছে ক্রমশ (বিজ্ঞানী ফ্রাংকেনস্টাইন যে দানব সৃষ্টি করেছিলেন, সেই দানবের হাতেই একদিন তার মৃত্যু হয়েছিল)?
সাংবাদিক-নারী-সুমন-লিমন-কাদের কিংবা সাধারণ মানুষগুলোকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তার পুলিশ থেকে "দূরে দূরে’’ থাকার পরামর্শ দেবার পরপরই পুলিশ গিয়ে দেশের সম্মানের-মর্যাদার একটা জায়গায় হাত তুলল---বিচারকের গায়ে হাত তুলে দানবীয় কাণ্ডের সূত্রপাত ঘটাল। এ দানবীয় কান্ড রুখতে না পারলে অচিরেই চোখের সামনে ভেঙ্গে পড়তে থাকবে অনেক সৌধ, জাতি হিসেবে ভূলুণ্ঠিত হতে থাকবে আমাদের সব মর্যাদা ও অর্জন।
৩) দুর্ভাগা আকলিমার মরণ একটি সমাজের পচনকেই তুলে ধরছে। আকলিমার হত্যাকাণ্ডটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে পুলিশ ও ক্ষমতাবানরা নিষ্ঠুর খেলা খেলে আকলিমাদের নিয়ে; তারপর একসময় তাদের সরিয়ে দেয় পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে মৃত্যুর অন্ধকারে। আর দেখিয়ে দেয় পুলিশের মতো ‘আইনের রক্ষক’ বাহিনীর পীড়নে-লাঞ্ছনায় কিভাবে সুমনের মতো কিশোরেরা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে কিংবা স্রেফ ভাগ্যের জোরে দীর্ঘ ৯ মাস পর মৃত্যুর গ্রাস থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসে। এই পচনের দিকে কেউ তাকায় না। তাইতো রাজধানী থেকে জেলায়-উপজেলায় ফ্রাংকেনস্টাইনের দানবেরা বাড়ছে। কে রুখবে এদের, কারা রুখবে?
Faruk.joshi@gmail.com
ফারুক যোশী:যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময় : ১৯৩৫ ঘণ্টা, ১২ জুন, ২০১২
সম্পাদনা:জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
Jewel_mazhar@yahoo.com