প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের উপর রাখাইনরা ভয়াবহ নির্যাতন চালাচ্ছে। উক্ত ঘটনাবলী নিকট অতীতে ইউরোপের বসনিয়া হারজেগভিনা, ভারতের গুজরাট, এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিনের জাতিগত সহিংসতাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
মিয়ানমারের এই জাতিগত দাঙ্গা পৃথিবীর সব ধরনের পৈচাশিকতাকে হার মানাচ্ছে। কারণ এক দিকে রোহিঙ্গাদের স্বদেশীরা খুন, ধর্ষণসহ নানা রকম নির্যাতন করেছে। সম্পদ, ঘর-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালাচ্ছে, উপাসনালয়ে অগ্নিসংযোগ করছে। নিজ দেশের প্রশাসন তাদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা না দিয়ে বরং রোহিঙ্গাদের শত্রু মগ-রাখাইনদেরকে উসকে দিচ্ছে।
অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ বিপদগ্রস্তদেরকে আশ্রয় দিচ্ছে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতিগত দাঙ্গা হয়েছে কিন্তু প্রতিবেশীরা আশ্রয় দিচ্ছে না এমন ঘটনার নজির খুব একটা পাওয়া যাবে না।
প্রাণ ভয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশু, নারী-পুরুষ দুর্গম পাহাড়-পর্বতে লুকিয়ে আছে অথবা ভঙ্গুর কাঠের ছোট্ট নৌকায় ঝড় বাদলার দিনে নদীতে, সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে। কারো কাছে সামান্য খাবার দাবার আছে কারো কাছে কিছুই নেই। যারা নাফ নদীর ওপাড়ে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে পর্যন্ত আসতে পেরেছিল কিংবা সেন্টমার্টিন উপকুলে আশ্রয়ের জন্য গিয়েছিল তারা মনে করেছিলÑ এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচেছে। কিন্তু যখন বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষীদের তথা বাংলাদেশ সরকারের বন্দুক তাদের চোখে পড়েছে। তারা তখন বেঁচে থেকেই মরে গেছে।
এ প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের হাতে লেখা একটি চিঠি পড়লাম। তিনি নাফ নদীতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি নৌকার প্রসঙ্গে লিখেছেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি ১৯৭১ সালের মে মাসে তার নিজের জীবনের স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, আমরা বাংলাদেশের মানুষরা সেই স্মৃতি ভুলে গেলাম কি করে? আমি জাফর ইকবাল স্যারকে জানাতে চাইÑ বাংলাদেশের মানুষ ভোলেনি। বাংলাদেশের মানুষ এত নিষ্ঠুর নয়। হবেও না কোনো দিন।
শুধুমাত্র আমাদের শাসকরাই সেই কথা ভুলে গেছেন। যদিও বর্তমান সরকারের অনেক মন্ত্রীই ১৯৭১ সালে ভারতে শরণার্থী হয়েছিলেন। শাসকরা কিভাবে ভুলে গেলেন? ‘মানুষ মানুষের জন্য’। মানবতাবাদীদের কাছে আমার প্রশ্ন: বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় না দেওয়া কি মানবতা বিরোধী অপরাধ নয়? চল্লিশ বছর পুর্বে সংঘটিত মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য তো এখন বাংলাদেশে বড় বড় রাঘব-বোয়ালদের বিচার হচ্ছে।
যদি কোনো দিন মানবতা বিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা পরিবর্তন হয় তাহলে কিন্তু আজকের শাসকরাও একদিন একই বিচারের সম্মুখীন হতে পারেন। বাবার মুখে শুনেছিÑ ১৯৭১ সালে কলকাতা, আগরতলার বাসে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দেখলে স্থানীয়রা সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে বসতে দিয়েছিল। আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবা আজ বেঁচে নেই। ভাবতে কষ্ট হয়Ñ এই দেশের জন্যই কি আমার বাবা যুদ্ধে গিয়েছিলেন?
পত্রিকায় খবর এসেছে বাংলাদেশের স্থানীয় জনগণ রোহিঙ্গাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে চাচ্ছে। কিন্তু সেই হাত সরিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা তথা সরকার। এ কেমন নিষ্ঠুরতা! এ কেমন অমানবিকতা! বাংলাদেশ সরকার এসব করছে কেন? বরং বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের উপর কেন কুটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে না? এরইমধ্যে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এসেছে যে, দাতা দেশসমুহ মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিষয়ে উদ্বিগ্ন।
তাহলে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে এখনই কেন আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারকে কোনঠাসা করা হচ্ছে না? আমরা জানি, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এরইমধ্যে প্রায় ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে। এটাও স্বীকার করছি বিপুল জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়া বাংলাদেশের পক্ষে বাড়তি জনসংখ্যার ভার গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে গত শতকের শেষ দিকে যখন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল তখন কেন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? এরইমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে যে কথা বলেছেন তা নিয়ে অনেক দ্বিমত আছে। তিনি বলেছেনÑ ‘জামায়াত ইসলাম মিয়ানমারের দাঙ্গায় মদদ যোগাচ্ছে। ’ জামায়াত ইসলামী নাকি আল-কায়দা মদদ জোগালো সেটা এখানে মুখ্য নয়। মানবতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে ভুমিকা রাখতে হবে।
তিনি এও বলেছেন ‘এমন নয় যে সে দেশের সরকার রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করছে। ’ আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা ইসরালের ন্যায় মগ ও রাখাইনদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য এ পর্যন্ত আরাকানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালিয়েছে। তম্মধ্যে, বিটিএফ, ইউএমপি, শিউ কাই, নাগাজিন, মাইয়াট মন, সেব, নাগামিন নামে এমন আরো অনেক অপারেশন পরিচালনা করেছে।
অপারেশনগুলোর মাধ্যমে আরাকানের রোহিঙ্গাদের পুর্বপুরুষের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করে মগ এবং রাখাইনদের প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। বসতভিটা থেকে উচ্ছেদকৃতরাই বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে উদ্বাস্তু হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার কি এসব জানে না? না জানার কথা নয়।
বর্তমানেও আরাকানে রোহিঙ্গাদের সাথে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তিতর্ক নয়, মানবতার দিকটি বিবেচনা করুন। বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেওয়া কিংবা দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলির প্রশ্ন আসছে কেন? দয়া করে তাদেরকে আশ্রয় দিন। সারা পৃথিবী এখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে।
ই-মেইল: nayonshakhawat@yahoo.com
লেখক, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসল, অস্ট্রেলিয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১২
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর