বাঙালির সর্বজনীন উৎসবের পরিনতি কি হতে যাচ্ছে যৌথ পরিবারের মতো, যৌথতা ভেঙ্গে অনু পরিবারের লেবাস নেওয়া? প্রশ্নটা বরষার প্রথম দিনের নয়। ভাবনায় এসেছে গত কয়েক বছরের উৎসব উদযাপনে গণমাধ্যমের কভারেজ নিয়ে।
এবার পহেলা আষাঢ়ে বর্ষাবরণের অনুষ্ঠান ছিল দুটি। দুটোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। চারুকলার লিচু তলার আয়োজক ছিল উদীচি শিল্পী গোষ্ঠী। আর সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠীর আয়োজনে বর্ষাবরণ অনুষ্ঠান হয়েছে হাকিম চত্বরে। দুটি অনুষ্ঠানেরই খবর আমাদের জানা ছিল। এবং লিচু তলার অনুষ্ঠান দেশ টেলিভিশন ও হাকিম চত্বরের অনুষ্ঠান চ্যানেল আই সরাসরি সম্প্রচার করবে জানা ছিল সেটাও। তারপরও সময় টেলিভিশন লিচু তলা থেকে বর্ষাবরণের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারের পরিকল্পনা নেয়। এর প্রথম কারণ হলো দেশ টেলিভিশন অনুষ্ঠানটির পুরো অংশই সরাসরি সম্প্রচার করবে, আর সময় সংবাদ শুধু খবরে সর্বোচ্চ দুই মিনিট করে সরাসরি সম্প্রচার করবে। এতে দেশ টেলিভিশনের পুরো অনুষ্ঠান সম্প্রচারের বেলায় প্রভাব পড়ার কথা না। দ্বিতীয় কারনটি হলো উদিচীর লিচু তলার বর্ষাবরণ অনুষ্ঠানটিকে সময় সংবাদের কাছে সর্বজনীন অনুষ্ঠান বলে মনে হয়েছে। তাই সাধারন ইভেন্ট কভার করার মতো করেই খবরে এক-দুই মিনিটের সরাসরি সম্প্রচারের প্রস্তুতি নিয়ে পহেলা আষাঢ় ভোরে লিচু তলায় গিয়ে হাজির হয় সময় টিম। উৎসব প্রাঙ্গণে গিয়ে সময়ের সংবাদ কর্মীরা উদীচির কর্মীদের সম্প্রচারের পরিকল্পনা ও আনুসঙ্গিক বিষয়ে ধারনা দেন। এবং উদিচীর পক্ষ থেকে অনাপত্তির কথাই জানান হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও সেলফোনে উদিচীর সংগঠকদের সঙ্গে কথা বলি এবং তারা আমাকে সবুজ সংকেত দেন। সময় সংবাদ কর্মীরা এই অনাপত্তি পেয়ে যখন সকাল আটটার সংবাদে সরাসরি সম্প্রচারে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন, ঠিক সেই সময়ে এসে দেশ টেলিভিশনের কর্মীরা এসে বাধ সাধেন এবং ক্যামেরার লেন্সের সামনে হাত দিয়ে বাধা দেন। এই পরিস্থিতিতে প্রথম দফায় খবরের শুরুতে সময় সংবাদ লিচুতলা থেকে সরাসরি সম্প্রচার করতে পারেনি। তখন নিজেই দেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান বন্ধুজন পারভেজ চৌধুরীকে ফোন দেই। তিনি জানালেন- অনুষ্ঠানটির জন্য তাদের স্পন্সর রয়েছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঢাকায় নেই। তার সঙ্গে কথা না বলে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি এই বলে যে- অনুষ্ঠানটি উদীচির। এবং বর্ষাবরণ অনুষ্ঠান আর সব অনুষ্ঠানের মতো সাধারণ কোন অনুষ্ঠান নয়। অনুষ্ঠানটি দেশ টেলিভিশনের নিজস্ব আয়োজনের অনুষ্ঠানও নয়। তাই সময় এক, দুই মিনিটের জন্য সরাসরি সম্প্রচারে যেতেই পারে। তাৎক্ষণিক ভাবে তিনি আমাকে কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরতি টেলিফোনে পারভেজ চৌধুরী আমাকে সবুজ সংকেত দেন। সময় সংবাদ পরে নয়টা এবং দশটার বুলেটিনেও বর্ষাবরণের সরাসরি সম্প্রচার করে। দেশ টেলিভিশন অবশ্য দশটার আগেই সরাসরি সম্প্রচার থেকে বেরিয়ে আসে। একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল আরো দুইবার চারুকলারই বকুলতলায় বসন্তবরণ ও নবান্ন উৎসবের অনুষ্ঠানে। ঐ অনুষ্ঠান দুটির সরাসরি সম্প্রচার করছিল চ্যানেল আই। অবশ্য চ্যানেল আইর কাছ থেকে মৃদু যে আপত্তি উঠেছিল তা অবশ্য সেলফোনে অনুজ এক সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলাতেই মিটে যায়। ঐ দুইবার বেশ স্বচ্ছন্দে সময় সংবাদ সরাসরি সম্প্রচার করতে পেরেছিল। তিনদফার বেলাতেই বলতে পারি পারভেজ চৌধুরীর সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে আমার এবং সময়ের সঙ্গে দেশ টেলিভিশনের সৌহার্দ্য, চ্যানেল আই’র পেশাদারী মনোভাব ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য অবশেষে সময় সংবাদ সরাসরি সম্প্রচারে ঐ উৎসব গুলোতে যেতে পেরেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো যে ঋতু বরণের এই উৎসবের মতো সর্বজনীন উৎসব গুলোতে কেনো গণমাধ্যমের অংশ গ্রহণ বা সম্প্রচার সংরক্ষিত থাকবে?
বলা যায় পহেলা বৈশাখ বা বাঙলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানটির কথা। এই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছায়নট। রমনা বটমূলের এই অনুষ্ঠানটি এখন পরিনত হয়েছে বাঙালির বর্ষবরণের সর্বজনীন অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠানটি দীর্ঘ দিন সরাসরি সম্প্রচারের একক স্বত্ব সংরক্ষিত ছিল চ্যানেল আইয়ের কাছে। একে একে দেশে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা বাড়লেও সেখানে অন্যরা সরাসরি সম্প্রচার করার অধিকার অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারের একক স্বত্ব যখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের কাছে চলে গেল, তখন কিন্তু বিটিভির মাধ্যমে অন্য চ্যানেল গুলোও রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে পারছে। এখানে বলে রাখা ভাল চ্যানেল আই যখন বঙ্গবন্ধু কনভেনশন সেন্টার থেকে বর্ষবরণের দিন সুরের ধারার অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করছে, তখন কিন্তু অন্যান্য চ্যানেল ঐ অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারের বায়না তুলছে না। কারন ঐ অনুষ্ঠানটি সর্বজনীনতা পায়নি। যখন সর্বজনীন বাঙ্গালীর উৎসব আয়োজন গুলো কোন একটি একক গণমাধ্যমের করায়ত্ব হয়ে যায়, তখন সম্প্রচারের ব্যাপকতা থেকে অনুষ্ঠানটি ছোট একটি গণ্ডি বা পন্থিদের চৌহদ্দির মধ্যে আটকা পড়ে যায়। অনুষ্ঠানগুলো হয়ে পড়ে গণবিচ্ছিন্ন। তাই গণমাধ্যমের কাছে আর্জি জানানোর আগে যারা বাঙ্গালীর সর্বজনীন এই উৎসবগুলোর আয়োজন করে আসছেন তাদের কাছে বিনীতভাবে বলি- কোন গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকার বিনিময়ে বাঙ্গালীর উৎসবকে বন্ধক রাখার অধিকার কারো নেই। এই উৎসব সর্বজনীন, সর্বজনের। যদি উৎসব উপলক্ষ করে কোন গণমাধ্যম নিজস্ব কোন আয়োজন করে (যেটি এখন চ্যানেল আই করছে নিয়মিত) সেখানে তার ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব থাকবে শতভাগ। আর আম মানুষের উৎসব উন্মুক্ত থাকুক সব গণমাধ্যমের জন্য।
বাংলাদেশ সময় ১২১২ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১২
এমএমকে