বড় কোনো জলবায়ু সম্মেলনে আমি কখনোই যোগ দিতে পারিনি। না রিওতে, না রিও প্লাস টোয়েন্টিতে।
তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে আমার আগ্রহের কমতি নেই। খাল-বিল-নদী-বন আমার শৈশবের সঙ্গী। সে কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে আমরা ধারণা স্পষ্ট। স্কুল থেকেই এ বিষয়ে আমি আগ্রহী ছিলাম। স্কুলে ও কলেজে খেয়াল করলাম ক্লাইমেট চেঞ্জ, সিএফসি, ওজোন স্তর, সি লেভেল রাইজ, বায়ো ডাইভার্সিটি এসব শব্দযুক্ত বিষয়ে কথা বললে সহপাঠীরাতো বটেই, শিক্ষকেরাও বেশ সমীহের চোখে তাকাতেন। আঁতেল আঁতেল ভাব ধরে রাখতে তাই এগুলো আরো বেশি বেশি পড়তাম। তখনই জেনে ফেলেছিলাম কার্বন ট্রেড কি? কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলো এগুলোর বিরোধিতা করে, বিনা দোষে আমরা কেন অপরাধী ইত্যাদি ইত্যাদি।
সিডর, আইলায় উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসলীলার পর এ নিয়ে আমি অনেক রিপোর্ট করেছি টেলিভিশনের পর্দায়। এর আগেও খবরের কাগজে বা টিভিতে সুন্দরবন, চিংড়িচাষ ইত্যাদি নিয়ে যেসব রিপোর্ট করেছিলাম, তার মূল চেতনাও ছিলো ক্লাইমেট চেঞ্জ, যাকে অনেকে উন্নত শক্তিধর দেশগুলোর নতুন রাজনীতি বলেও মনে করেন।
যাই হোক, এতসব প্যাঁচাল পাড়ছি যে কারণে, সে বিষয়ে আসা যাক। গত বেশ কয়েক বছর ধরে গ্রিন ইকোনোমি বা সবুজ অর্থনীতির কথা শুনে আসছি। প্রথম যখন শব্দটা শুনি, বেশ ভালো লেগেছিলো। সবুজ শব্দটাই কেমন যেনো ভালোলাগা মেশানো। সেই প্রতীতি থেকেই ভালোলাগাটা জোরালো হয়ে উঠেছিলো। এমন একটা অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে কার্বন নিঃসরণ হবে কম, নির্মল বাতাস, উর্বর মাটি, নিষ্কলুষ জল, জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে না টাকা রোজগার করতে গিয়ে। জীবন যাপন করতে গিয়েও আমরা নষ্ট করবো না আমাদের চারপাশের পরিবেশ। গরমে শীতল পরশ নিতে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ছড়িয়ে দেব না বাতাসে। দ্রুত ও আয়েশী ভ্রমণ করতে গিয়ে বাড়িয়ে দেবো না ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা। যথাসম্ভব প্রকৃতিকে অবিকৃত রেখেই চলবে আমাদের সভ্যতা নির্মাণের অব্যাহত প্রক্রিয়া। মাথা উঁচু করে থাকবে সেভেন সামিটস্, তরঙ্গ লহরী দুলবে ভোলগা থেকে পদ্মায়, জীববৈচিত্রের অভাব হবে না আমাজান থেকে সুন্দরবনের গহীনে। এমন সব সম্ভাবনার কথা শুনলে কার না ইচ্ছে হবে গ্রিন ইকোনমি গড়ে তুলতে!
কিন্তু খুব খটকা লাগলো পত্রিকার পাতায় একটা ছবি দেখে। একটা গ্রিন অ্যাপার্টমেন্টের ছবি ছাপা হয়েছে, যেটি এত উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন যে ফ্ল্যাটের মালিক বাড়ির বাইরে থেকে রিমোট দিয়েই গোটা বাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। মূল্যটাও খুব বেশি না। প্রতি বর্গফুট মাত্র ৩৫ হাজার মার্কিন ডলার! তৈরি হচ্ছে গ্রিন কার। দামটাও খুব কম। কয়েক মিলিয়ন ডলার। আরো অনেককিছু হচ্ছে গ্রিন। তবে ভালোটাতো আর সস্তায় হয় না, তাই দাম একটু বেশি। আর বেশি দাম কে দিতে পারে? এ প্রশ্নের জবাব নাইবা খুঁজলাম। তবে দুঃখ লাগলো এই ভেবে, এই গ্রিন ইকোনমি যাতে গড়ে ওঠে, তার জন্যে অনেক কথা বলেছি আমি, আমার সার্কেলে। দু’একটা আর্ন্তজাতিক সেমিনারেও গেছি। এরপক্ষে স্লোগান তৈরি করেছি। সেই স্লোগান রিওতেও পৌঁছেছে। কিন্তু এর সবই যে ধনীশ্রেণীর নতুন জীবন-যাপনের তরিকা নির্মাণের পথ ও পাথেয়, সেটা বুঝতে অনেক সময় লাগলো। তবে সবাই আমার মতো বোকা না। রিও ডি জেনিরিয়োতে প্রতিবাদী পরিবেশকর্মীরা তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। বলেছেন, আমরা গ্রিন ইকোনোমি চাই না। আমরা বাঁচতে চাই, সন্তানদের বাঁচাতে চাই।
সুন্দরবনে গোলপাতা কাটা নিষিদ্ধ করা হয়। এতে বাওয়ালীরা বিপাকে পড়েন। কারণ তারা গোলপাতা কাটেন ঠিকই, কিন্তু গোলের ‘মাইজ’ (মধ্যের) পাতা কাটেন না। এতে একই ঝাড়ে আবারও গোলপাতা জন্মায়। আবারও কাটা হয়। আবারও জন্মায়। কিন্তু পরিবেশ পণ্ডিতেরা, গোলপাতা লুটেরাদের আচরণ বিশ্লেষণ করে গোলপাতা কাটাই নিষেধ করে দিলেন। এতে শুধু বিপাকে পড়লেন বাওয়ালীরা। বননির্ভর মানুষেরা। তাদের বিকল্প জীবিকা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো। ভ্যান-রিকশাচালক বা পান-বিড়ি বিক্রেতা বানানোর চেষ্টা ছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এতে বেকারত্ব বাড়া ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ধরিত্রী সম্মেলন বা জলবায়ু সম্মেলনেও বারবার একই রকম সিদ্ধান্ত হতে দেখি, যাতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ানোরই নানা ইঙ্গিত থাকে। দুর্বল দেশগুলোর দুর্বলতা প্রসারেরই চেষ্টা থাকে। আর ক্ষমতাধরদের দাম্ভিকতা প্রদর্শনেরই মহড়া হয়ে থাকে। গ্রিনের নামে এগুলো হলেও অনেক সময় মনে হয়, এটা গ্রিডেরই নয়া প্রকাশ। একজন ৩৫ হাজার ডলারে স্কয়ার ফিট কিনে বিলাসবহুল জীবন যাপন করবে, আরেকজনের কারখানা বন্ধ করে তাকে কুঁড়েঘরে ঠেলে দেওয়া হবে... তেমন দুনিয়া টিকে থাকলেই কি আর না থাকলেই কি!
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১২
সম্পাদনা: আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
jewel_mazhar@yahoo.com