এই লেখাটা নিয়ে অনেক সমালোচনা হতে পারে এবং কেউ কেউ এটাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগও পাবেন। মাঝে মাঝে যুক্তির কাছে আবেগের ধরাশায়ী হবার ঘটনা কম নয়।
গতকাল বাংলানিউজের একটা খবর নজরে এলো। ‘প্রধানমন্ত্রী হতে চায় পথশিশু সজিব’। রাজধানীর আইডিবি ভবনে অনুষ্ঠিত ‘পথশিশুদের সুরক্ষা এবং উন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে পথশিশু সজিব এভাবেই তার বক্তব্য তুলে ধরে। সিপের নির্বাহী পরিচালক রাজা ভাইয়ের সঙ্গে একটা সময়ে কর্মসূত্রে পরিচয় ছিল। তিনি অত্যন্ত সফলতা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে সমাজের অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তবে উল্লেখিত সেমিনারের কর্মসূচি সম্পর্কে আমার ধারণা নেই বিধায় সেই কাজের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করছি না। শুধু সজিবের স্বপ্নকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অন্য এনজিওদের কাজের কিছু চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে।
একটা সময়ে বিভিন্ন এনজিওর অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। বাংলাদেশের বহু জায়গা কাজের সুবাদে ঘুরে, বিভিন্ন এনজিওর অসংখ্য কাজ দেখেছি। কে কি হতে চায় বলতেই অন্তত অর্ধেকের বেশি শিশু ‘ডাক্তার’ কিংবা ‘ইঞ্জিনিয়ার’ বলে সমস্বরে চিৎকার করত। শুধু এনজিওর অপ্রাতিষ্ঠানিক স্কুল কেন, সজিবরা যে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়ে সেখানকার চালচিত্রগুলোও হুবহু একই রকমের। অনেকেই ভাবতে পারেন, বড় হতে চাওয়া দোষের কি হলো! কথাটায় আবেগ আছে, যুক্তি নাই। জীবনটা শুধু স্বপ্ন নিয়ে জুয়াখেলা নয়। একটা মানুষ কি হতে চায় সেই অনুযায়ী জীবনের শুরুতে তার প্রস্তুতি থাকবে। যে শিশুটি আজ স্বপ্ন দেখে প্রধানমন্ত্রী কিংবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবার তার প্রস্তুতিটা কি? যাদের তত্ত্বাবধানে কর্মসূচিগুলো চলে তাদের অনেকের সন্তানেরা নগরের ভালো ভালো স্কুলে পড়ে। মেডিক্যাল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই আবারো দেশের স্বনামধন্য কোচিং সেন্টারের তত্ত্বাবধানে থেকেও অনেকেই আশানুরূপ জায়গায় ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়। সেখানে সারাদিন ঢাকার রাস্তায় কাগজ কুড়িয়ে কিংবা মানুষের বাড়িতে কাজ করে মাত্র এক ঘণ্টা কি দুই ঘণ্টা পড়ে একটা শিশুর পক্ষে কি সম্ভব তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো? তাছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যে উদ্দেশ্য কিংবা কমপিটেন্সি লেভেল সেটার মাধ্যমে কি সম্ভব কারো পক্ষে উচ্চশিক্ষা অর্জন করা?
খামোখা মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষণকালের জন্য স্বপ্নসাগরে ভাসিয়ে এভাবে স্বপ্ন দিয়ে স্বপ্ন ভাঙার কোনো মানে হ্য় না। বরং বাস্তব স্বপ্নটা দেখানো উচিৎ যাতে একটা শিশু তার যোগ্যতা এবং বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে করতে পারবে। সজীব যে স্বপ্ন দেখছে, কিংবা সজিবের মতো আরো অনেক পথশিশু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবার যে স্বপ্ন দেখছে, সেটার বাস্তবায়নের জন্য এনজিওগুলোর পরবর্তী পরিকল্পনাগুলো কি? তাদের কর্মসূচিতো বয়সের ফ্রেমে বাঁধা। বয়স পার হলেই টার্গেট গ্রুপ থেকে বাদ পড়ে যায়। বড় হবার রেসে সজিবদের পরবর্তী দায়িত্ব কে নেবে?
আচ্ছা বাদ দিলাম সে কথা। সব কাজ যে একটা মাত্র সংস্থাকেই করতে হবে সেটাও নয়। কিন্তু পরের কাজটা কাউকে দিয়ে করানোর যে লিংক কর্মসূচি সেটা কি আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা কাজ করে, তাদের সন্তানদের জন্য কোটায় ভর্তি হবার সুযোগ আছে, সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্যও একই বিধান আছে। অথচ যাদের উপস্থিতি না হলে রাজনৈতিক নেতাদের মিটিং জমে না, এনজিওর কর্মসূচিও চলে না সেই অবহেলিত, বিশেষ করে শহরগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পথশিশুদের উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো কোটা নেই কেন? মনে রাখতে হবে পথশিশুদের মেধার কোন ঘাটতি নেই, গ্রামে গঞ্জে পড়ে থাকা গরীব কৃষক কিংবা রিকশাওয়ালার সন্তানদের মেধার কোনো অভাব নেই। শুধুমাত্র ছোটবেলা থেকে বঞ্চনার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার ফলে তারা মেধার বিকাশ ঘটাতে পারে না। এনজিওগুলো শুধু এই অবহেলিত শিশুদের মনে স্বপ্নের জাল না বুনে বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেবে কি তাদের অবস্থার এই দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসার? সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করুন না উচ্চশিক্ষায় এদের জন্য কোটা প্রথা চালুর ব্যাপারে। কিংবা ‘গুণগত’ এবং ‘বাজার উপযোগী’ কোনো কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর ব্যাপারে। সরকারের পক্ষ থেকে যে ভোকেশনাল শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে সেখানে গোয়াল আছে গরু নাই অর্থাৎ তেমন কোনো কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা নেই।
আমরা অনেকেই হয়তো জানি না, অস্ট্রেলিয়াতে একটা সময়ে অনেক শ্রেণীর মানুষ এসেছিল অভিবাসী হয়ে। বিভিন্ন কারিগরি দক্ষতা ছিল তাদের, যাদের আমরা আমাদের দেশে নিচু পেশা হিসেবে ঘৃণা করি। কিন্তু উন্নত বিশ্বে কারিগরী পেশার মূল্যায়নই আলাদা। এখানে বাথরুমের কমোড লাগানো কিংবা পানির টেপ সারানো মিস্ত্রী অথবা ইলেকট্রিশিয়ান মানেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। চুলকাটা নাপিত এখানে হেয়ার ড্রেসার। তাদের ভাবই আলাদা। বাংলাদেশ শুধু পিছিয়ে ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে। কারিগরি ক্ষেত্রে অনেকেরই সব যোগ্যতা আছে কিন্তু নেই শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একখানা সার্টিফিকেট। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে এখনো এইসব পেশার কদর আছে। এনজিওগুলো পথশিশুদের জন্য কিছু করতে চাইলে এককভাবে হোক কিংবা লিংক সৃষ্টি করে হোক, কিংবা সরকারকে দিয়ে উচ্চশিক্ষার কোটা পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে হোক, বাস্তবমুখি কিছু একটা করতে হবে যাতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে এরা টিকে থাকতে পারে।
বাস্তব উপযোগী এসব কিছু না করে আমাদের এনজিওগুলোর একটা ট্রাডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে তার উদ্দিষ্ট গোষ্ঠীকে (টার্গেট গ্রুপ) মাঝে মাঝে অবাস্তব স্বপ্ন দেখিয়ে মোহাচ্ছন্ন করে রাখার। এতে ওদের কোনো উপকার না হলেও সংশ্লিষ্ট এনজিওগুলোর কিন্তু পোয়াবারো। তাদের জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আসে। আমেরিকার কোনো প্রেসিডেন্ট কৃষক ছিল আর কে বাদাম বেচতো সেই উদাহরণ টেনে বাংলাদেশের কাউকে প্রধানমন্ত্রী হবার স্বপ্ন দেখানো কতোটুকু যৌক্তিক। আমেরিকায় যে বাদাম বেচে, তার সামাজিক প্রেক্ষাপট আর বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট এক নয়। সেখানে যে বাদাম বেচে, তার আয় রোজগারের সাথে আমাদের দেশের অনেক ভালো চাকরিওয়ালারও অনেক তফাৎ। এসব দেশে প্রায় প্রতিটা শিক্ষার্থী পড়ালেখার পাশাপাশি ক্লিনিং থেকে শুরু করে ফ্যাক্টরি কিংবা শপিং মলে কাজ করে নিজের পড়ালেখার খরচ নিজেই যোগাড় করে। বলতে গেলে ১৫/১৬ বছর থেকেই এরা স্বাবলম্বী।
প্রশ্ন জাগতে পারে, স্বপ্ন দেখা শিশুর স্বাধীনতা। কিন্তু যথাযোগ পরিকল্পনা এবং সহায়তা ছাড়া ‘স্বপ্ন দেখানো’ ম্যানিপুলেশন। অনেকে বলতে পারেন, একটা শিশু প্রধানমন্ত্রী কিংবা ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইলে এনজিওদের কি করার আছে? পিঠ বাঁচানোর যুক্তি হিসেবে এটা মন্দ নয়। কিন্তু এই যুক্তির মাধ্যমে মূলতঃ সমস্যার সমাধানের চেয়ে আরো বড় প্রশ্নকে সামনে আনা হবে। তখন এনজিগুলোর পুরো কার্যক্রমই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাহলে এনজিও শিশুদের কিভাবে ফ্যাসিলেটেশন দিচ্ছে যে, ক্লাসের পুরো শিশুদল তাদের বাস্তবতার বাইরে গিয়ে ফ্যান্টাসি জগতে ভেসে বেড়ায়। হত দরিদ্র শিশুদের নিয়ে এই স্বপ্নখেলার কি অধিকার আছে তাদের? বাংলাদেশে এনজিওদের কাজ করার ইতিহাস অতি পুরনো। কতোগুলো উদাহরণ তাদের হাতে আছে যে, এই পর্যায় থেকে শিশু সত্যি সত্যি উল্লেখিত স্বপ্নের গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছে? দু’‘একটা কুমীরছানা দেখানোর উদাহরণ নয়, দেখাতে হবে সেই পর্যাপ্ত সংখ্যা যেটা থাকলে তার উদাহরণ দেয়া যায়।
এ রকম স্বপ্ন বেপারী আমিও এক সময় ছিলাম। সংস্থার ইচ্ছা অনুযায়ী গ্রামে গ্রামে স্বপ্ন ফেরি করে বেড়াতাম। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা টগবগে তরুণ তখন। আফিমগ্রস্তদের মতো যুক্তির বাইরে সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা চালাতাম। কিংবা পেটের দায়ে করতে বাধ্য হতাম। একদিন স্বপ্ন কেনা নবম শ্রেণীর একটি মেয়ে আমাকে প্রশ্ন করে বসল, ভাইয়া আমাদের যে সচেতনতা, যে স্বপ্ন দেখাচ্ছে আপনাদের সংস্থা, আপনারা কি পারবেন এর শেষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে? একটা সময়ে মেট্রিক পাস করে স্বামীর ঘর করার স্বপ্ন দেখতাম। এখন আমি ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু জানি গ্রামের এই স্কুলে পড়ে সবার পক্ষে ডাক্তার হওয়া সম্ভব নয়। আমার রিকশাওয়ালা পিতা কখনো সেটা পারবেও না। এখন ডাক্তার হওয়া তো দূরের কথা, মেট্রিক পরীক্ষা দেবার আগেই আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। আগামী মাসে আমার বিয়ে। ছেলে লেখাপড়া জানে না। সে কি আমার ভাবনার সাথে চলতে পারবে? তার সঙ্গে কী করে বাকি জীবনটা এক সঙ্গে কাটাবো?
থমকে দাঁড়ালাম। আমিতো ছিলাম স্বপ্ন ফেরিওয়ালা। হারলে চলবে না। চট জলদি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘‘তোমার সেই বিখ্যাত উক্তিটির কথা মনে নেই? আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে একটা শিক্ষিত জাতি উপহার দেব! অন্তত তোমার চেতনা তুমি তোমার পরবর্তী প্রজন্মের ভিতরে দিয়ে দিতে পারলে তোমার প্রজন্ম তোমার স্বপ্নপূরণ করবে?’’
কথাটা একদম ভুল বলিনি। তারপরেও বলব, স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা এভাবেই কথার মারপ্যাঁচে বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়ায়।
mahalom72@msn.com
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৪ ঘণ্টা, ২৩ জুন, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
jewel_mazhar@yahoo.com