ঢাকা, সোমবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

কক্সবাজারে ট্রেন যোগাযোগ: প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার প্রতিফলন

বিপ্লব বড়ুয়া | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০২৩
কক্সবাজারে ট্রেন যোগাযোগ: প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার প্রতিফলন

এ এক আশ্চর্য, বিস্ময়কর, অভূতপূর্ব, অবিশ্বাস্য— এভাবে শত শত শব্দে বিশেষায়িত করলেও আবেগ-আনন্দ শেষ করা যাবে না। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের সাথে দেশের অন্যান্য জেলার ট্রেন যোগাযোগ স্থাপন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার ইচ্ছাশক্তির সফল বাস্তবায়ন এবং সেই সাথে একটি অভাবনীয়, ঐতিহাসিক স্বপ্নের প্রতিফলন! নতুন কাজ করতে যত না সহজ, তার চেয়ে অধিকতর কঠিন পুরনো কাজকে পুনঃনির্মাণ পূর্বক উপযোগী করে তোলা।

চট্টগ্রাম টু কক্সবাজার রেললাইন করতে গিয়ে খুব বেশি ভুগিয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্তদের। কখনো কখনো কাজটি থমকে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম টু চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী পর্যন্ত আগে থেকেই ৪৮ কিলোমিটারের রেললাইন ছিল। এই লাইনটি ব্রিটিশদের করা। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দুরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই লাইনকে সম্প্রসারণ করে সৃদূর কক্সবাজারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাটি এই সরকারই প্রথম গ্রহণ করে। এটি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

আজকে স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসে কক্সবাজারের সাথে সমগ্র বাংলাদেশে ট্রেন যোগাযোগে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হতে দেখে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে অনেকের মতো আমিও সত্যিই গর্ব অনুভব করছি। ব্রিটিশ আমলের পুরনো লাইন দিয়ে কক্সবাজারের যোগাযোগ স্থাপন করতে গিয়ে কতবার যে জরিপ কার্য পরিচালনা করতে হয়েছে, তার হিসেব নেই। পথে পথে যখন জরিপ কাজ এবং শেষে জায়গা অধিগ্রহণ করা হচ্ছিল তখনো পর্যন্ত কারো বিশ্বাসে ছিল না এই অবিশ্বাস্য ঘটনার আসল রূপটি অতি সহসা ধরা দেবে। এবং একই সাথে চট্টগ্রাম টু দোহাজারী পর্যন্ত পুরনো নড়েবড়ে রাস্তা দিয়ে বৃহৎ পরিসরের ট্রেন চালানো সম্ভব হবে কিনা, এটি নিয়েও মানুষের মনে সন্দেহের কমতি ছিল না। কারণ আগে থেকে এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন কয়েকজোড়া লক্করঝক্কর ট্রেন চলাচল করতো। অতীব দুর্ভাগ্যের বিষয়, যে ট্রেনগুলি এই লেনে চলাচল করতো, তা দিয়ে যাতায়াত করা উপযোগী ছিল না।

আমার বাড়ি পটিয়ায় হওয়ার কারণে এক সময় ধলঘাট স্টেশন হয়ে শহরে যাতায়াত করতাম। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাড়ি থেকে ট্রেনে করে শহরে যাতায়াত করেছি। এরপর বিগত ৩৩ বছর পর্যন্ত এই রোড দিয়ে আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। তার একমাত্র সমস্যা অনুপযোগী ট্রেন ব্যবস্থাপনা। যেখানে কোনোরকম বসার সু-ব্যবস্থা  ছিল না, ভাঙাচোরা সিট। ট্রেনের ভেতরে ভুতুরে অন্ধকার, লাইটিংয়ের ব্যবস্থা ছিল না। দরজা-জানালা নষ্ট, জরাজীর্ণ, অপরিষ্কার, যাত্রী কম্পার্টমেন্টে মালামাল তুলে দেওয়া, যত্রতত্র মলমূত্র পরে থাকা, মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য, যাত্রীদের নিরাপত্তা ঝুঁকি, আবার চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়া ও গন্তব্যে পৌঁছার মধ্যে কোনোরকম সময়জ্ঞান না থাকা— এ ধরনের প্রচুর সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে এই রোডে যাতায়তকারী ট্রেন যাত্রীদের। মূলত এসব কারণে সাধারণ যাত্রীরা ট্রেন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন।

অথচ এমন একটা সময় ছিল বোয়ালখালী, পটিয়া, চন্দনাইশ উপজেলার মানুষদের যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছিল ট্রেন যোগাযোগ। আজ থেকে ৩০ বছর আগে ২ টাকা, ৩ টাকা এবং সর্বশেষ ৫ টাকার টিকিট ক্রয় করে চট্টগ্রাম শহরে এসেছি। রেলওয়ের সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণে সেদিনটি কোথায় যেন হারিয়ে গেল! আজ আবার নতুন করে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সফল রাষ্ট্রনায়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রবল আকাঙ্ক্ষার কারণে ১১ নভেম্বর থেকে আবার সেই আমার শৈশবের পুরনো পথ ধরে ট্রেন যাবে কক্সবাজারে। এরচেয়ে বড়ো পাওয়া আর কিছু হতে পারে না। এতদঅঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষ আবার ফিরে পাবে রেলের সেই নিরাপদ বাহন। এটি ভাবতে নিজের মধ্যে কী যে আনন্দ লাগছে, ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

১৯৩১ সালে ব্রিটিশের করা পুরনো জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচলে যে সন্দেহের দানা বেঁধে ছিল, পুনঃনির্মাণের মধ্যে দিয়ে সে ভয় আতংক উপড়ে ফেলেছে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইনটি ২০১০ সালের ৬ জুলাই এ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। কাজ ধরতে গিয়ে জমি অধিগ্রহণ এবং অন্যান্যখাতে বহুপরিমাণ ব্যয় বেড়ে যায়। এ জন্য মাঝখানে কয়েকবছর প্রকল্পের কাজ থমকে দাঁড়ায়। ২০১৭ সাল নাগাদ পুনঃবাজেট অনুমোদন লাভ করলে প্রকল্পটি গতি ফিরে পায়। ২০১৮ সালে রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কাজটি ২০২২ সালের ৩০ জুন শেষ করার কথা থাকলেও মাঝখানে কয়েকবছর করোনার কারণে আবারো ধীরগতিতে চলতে শুরু করায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রকল্পের কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ সম্পন্ন করা হয়। ৫ নভেম্বর পরীক্ষামূলক প্রথম পরিদর্শন ট্রেন কক্সবাজার গমন করেন।

ট্রেনে যাওয়ার পথে মানুষের কী যে বাঁধভাঙ্গা উচ্চাস তা বর্ণনাতীত। কেউ কেউ নেচে গেয়ে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে মোবাইলে সেল্ফি তুলে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করেছে। এই প্রথম কক্সবাজার অভিমুখে ঘন ঘন ট্রেনের হুইসেল বাজিয়ে যাওয়ার পথে ঘরবাড়ি ছেড়ে মানুষরা তখন ট্রেনের রাস্তায় ওঠে আসে নতুন অতিথিকে সাদরে বরণ করতে। এ যেন বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার! অনেকে এই অতিথিকে এভাবে দেখবে কল্পনাতেও ভাবেনি তাই অকস্মাৎ ছুঁয়ে চোখেমুখে আনন্দ অশ্রু বর্ষণ করেছে। দর্শনার্থীদের ভিড়ের কারণে সেদিন পরিদর্শক টিম অনেক জায়গায় ঠিকমতো পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালাতে হিমসিম খেয়েছে, আবার অনেক জায়গায় করতেও পারেনি।  

১১ নভেম্বর ২০২৩ এক মাহেন্দ্রক্ষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার আইকনিক ষ্টেশনে উপস্থিত হয়ে রেলপথ উদ্বোধনের পর পুরোদমে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। এর মধ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের অধিবাসীদের দীর্ঘবছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে। আমি বলবো, এ প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার সার্থক প্রতিফলন। তাঁর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই।

রেললাইন, স্টেশন, সেতু, কালভার্ট নির্মাণে সর্বমোট ব্যয় হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নযন ব্যাংক (এডিবি) সহায়তা দিয়েছে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। বাকি ৪ হাজার ১১ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দিয়েছে। নতুন এই রেললাইন চালু করতে গিয়ে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১ হাজার ৩৬৩ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুনভাবে স্টেশন করা হয়েছে ৯টি।  নতুন স্টেশনগুলো হলো— দোহাজারী স্টেশন, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও সর্বশেষ কক্সবাজার আইকনিক স্টেশন। আর চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত আগের রেলস্টেশনগুলো ছিল— ঝাউতলা, ষোলশহর, জানালীহাট, গোমদন্ডী, বেঙ্গুরা, ধলঘাট, খানমোহনা, পটিয়া, চক্রশালা, খানমোহনা, হাসিমপুর, দোহাজারী।

সম্প্রতি কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মিত হয়েছে। এই দুই রোডই  দক্ষিণ চট্টগ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং একই সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পোন্নয়নে বিপুল অবদান রাখবে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা সুদূঢ় কক্সবাজার-টেকনাফ পর্যন্ত সরকার এবং ব্যক্তি মালিকানায় প্রচুর বড় বড় প্রকল্প ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে বোয়ালখালি, পটিয়া, আনোয়ারা, সাতকানিয়া ও বাঁশখালিতে বৃহৎ বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। কক্সবাজারে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত তো আছেই। এছাড়া চকরিয়া চিংড়ি প্রজেক্ট ও লবণ শিল্পের জন্য বিখ্যাত। মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গড়ে তোলা হচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর, বিদুৎকেন্দ্র। আছে চুনতী অভায়রণ্য, ডুলাহাজারা খ্রিষ্টীয়ান হাসপাতাল, চন্দনাইশে বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, বাঁশখালিতে ইকোপার্ক, বিদুৎকেন্দ্র, যোগাযোগ ব্যবস্থার অমূল পরিবর্তনের ফলে টেকনাফ, কক্সবাজার, চকরিয়া, মহেশখালী থেকে খুব সহজে পণ্যসামগ্রী চট্টগ্রাম শহর হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়বে।

এছাড়া আনোয়ারা উপজেলায় কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার (কাফকো), চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার (সিইউফল), পারকি বিচ, কর্ণফুলী উপজেলায় কেইপিজেড ও ইয়ংওয়ানের মতো বিশ্ববিখ্যাত শিল্পপ্রতিষ্ঠান শতাধিক ফেক্টরি খুলেছে যেখানে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। পটিয়া ও বোয়ালখালিতেও বহু সংখ্যক গার্মেন্ট শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং টেকনাফ, কক্সবাজার পর্যন্ত বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না। তাই কর্মরত শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তা, দক্ষিণ চট্টগ্রামের শিক্ষার্থী এবং চট্টগ্রাম শহর তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামে ব্যবসায়ী ও অফিস-আদালতে কর্মরতদের সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করতে হতো। এই ট্রেন যোগাযোগের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও নতুন নতুন শিল্পায়নে গতি ফিরে পাবে।


বিপ্লব বড়ুয়া: লেখক, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০২৩
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।