মেয়র লোকমান হোসেন। এক বীর সন্তানের নাম।
তরুণ এই জননেতা ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছাত্রজীবনে নরসিংদী সরকারী কলেজের সাবেক ভিপি ছিলেন। তিনি সে সময় নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। তারপর তিনি নরসিংদী পৌরসভার মেয়র নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। তার স্বপ্ন ছিল মাদকমুক্ত আধুনিক নরসিংদী গড়ার। তার স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবে রূপ দিতে না পারলেও শেষ পর্যন্ত তিনি দেখিয়ে গেছেন তার স্বপ্নের কয়েক ফোটা বাস্তবায়ন। নরসিংদীর বেপারীপাড়া নামক স্থানে প্রকাশ্যে মাদকের বেচাকেনা হতে। প্রথমবারের মতো মেয়র হয়েই তিনি সেই মাদকের স্বর্গরাজ্যকে ধ্বংস করেন নিজ হাতে। এছাড়া আরো বিভিন্ন সমাজসংস্কার মূলক কাজে তাকে পাওয়া যেতো সবার আগে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের নির্বাচনেও পৌরবাসীর বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।
তিনি যখন প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচনে অংশ নেন তখন তার ছাত্রজীবনে বিভিন্ন খারাপ ব্যাপারগুলো নিয়ে জনগণ বিব্রত ছিল। কথিত আছে, তিনি ছাত্রজীবনে প্রকাশ্যে গুলি করে মানুষ মেরেছেন। যাই হোক, যখন তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হন তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনার নেতিবাচক কাজগুলো আপনার প্রচরনায় প্রভাব ফেলবে কি? তিনি তখন দৃঢ়চিত্তে বলেছিলেন, কোনো নেতিবাচক কথায় নয় জনগণ মেয়র নির্বাচিত করবে প্রার্থীর যোগ্যতা আর কাজ দেখে। তিনি পৌরবাসীকে তখন কথা দিয়েছিলেন, নরসিংদীকে মাদকমুক্ত করবেন। আরো বলেছিলেন, আধুনিক নরসিংদী তৈরির মাধ্যমে সারা দেশে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করবেন। তিনি সে কাজ শুরুও করে দিয়েছিলেন। বর্তমানে কেউ যদি নরসিংদী সদরে প্রবেশ করে তাহলে দেখবে তার অনন্য সব সৃষ্টি। একটি জেলা শহরকে তিনি কতটা সৌন্দর্য্যমণ্ডিত করেছিলেন তা একমাত্র নরসিংদীতে গেলেই দেখা যাবে। কোনো কৃত্রিম ছবি দিয়ে তার কাজকে প্রকাশ করা যাবে না। এখনো তার তৈরি করা সিরামিকের ফুটপাত দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় তাকে স্মরণ করে পৌরবাসি। তিনি প্রথমবার নির্বাচনের সময় একাধিকবার বলেছিলেন, আমার এলাকার জনগণকে আমি চলন্ত রিক্সায় বসিয়ে চা খাওয়াব। এর মানে হচ্ছে, চলন্ত রিক্সায় বসে চা খেতে চাইলেও রাস্তা উঁচু নিচু হওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু তিনি তার এলাকার রাস্তেঘাটের এমন উন্নতি করেছেন যে, কেউ রিক্সায় বসে চা খেতে না পারলেও ভাঙ্গা রাস্তার ঝাঁকিতে কষ্ট পাবে না। পৌর এলাকার রাস্তা প্রশস্ত করেছেন, সঙ্গে স্যুয়ারেজের লাইন তৈরি করে দুর্ভোগ কমিয়েছেন।
এমনই একজন নেতাকে যখন ১লা নভেম্বর ২০১১ এ গুলি করে হত্যা করা হয় তখন পুরো নরসিংদীবাসি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। থেমে গিয়েছিল কান্নার ভাষাটাও। আমার কাছে যখন খবরটি আসে তখন আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। পরে তার ছোট ভাই শামীম নেওয়াজের কাছ থেকে খবরের সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হই। সেদিন রাতেই ছুটে গিয়েছিলাম নরসিংদীতে। দেখেছি মানুষের আর্তনাদ আর আহাজারি। দেখেছি নরসিংদীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জানাজা। দেখেছি ছেলেহারা মায়ের মত কাঁদতে অসংখ্য নারীকে। দেখেছি একজন নেতার মৃত্যুতে কিভাবে একটি পুরো শহর ভয়ংকর মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত হয়েছে। যে ব্যবসায়ীরা তাদের জানমালের নিরাপত্তায় কখনো অভাব বোধ করতেন না মেয়রের নেতৃত্বের কারণে সেই তারাই ভয়ে কয়েক সপ্তাহ দোকান বন্ধ করে রাখেন সন্ধ্যার পরে। কারণ, যারা লোকমান হত্যার সাথে জড়িত তারা তাদের মাঝে আতংক সৃষ্টি করেছিল। লোকমান হত্যার পরই মূলত আবারও নরসিংদী পৌর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব শুরু হয়। চুরি- ডাকাতির হারও বেড়ে যায়।
তার মৃত্যুর পর গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপি নেতা খায়রুল কবীর খোকনকে। অথচ মেয়র লোকমান এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি চাইতেন সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে নেতৃত্ব দিতে। মেয়রের মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই কামরুজ্জামান ১১ জনকে আসামি করে মামলা করেন। তারপর বহু ঘটনার জন্ম দিয়ে ঐ ১১ আসামিকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়া হয়। তখন বিভিন্ন পত্র পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ঐ ১১ আসামির অধিকাংশই সেদিন হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। অথচ ঐ চিহ্নিত ১১ আসামিকে বাদ দিয়েই চার্জশিট দাখিল করা হলো। কিছুদিন আগে এই হত্যামামলার বিচারিক কাজ চালনার সময় বিচারকের উপর হামলা করা হয়। সবকিছু কিন্তু একই সূত্রে গাঁথা। আসামিদের ক্ষমতার হাত দীর্ঘ হওয়ার কারণে হয়ত এই মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা পারেনি পৌরবাসির মন থেকে আসামিদের নাম মুছে দিতে। পারেনি মন থেকে মেয়র লোকমানকে সরিয়ে দিতে। তাই তো মৃত্যু-পরবর্তী নির্বাচনেও তার ভাইকেই নির্বাচিত করে সাবেক মেয়রের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিয়েছে মানুষ তার ভক্ত-অনুরাগী লাখো মানুষ। তাই আমি নরসিংদী পৌরবাসীর মনের কথাটা বারবার বলে যাই: “আমরা কি বিচার পাবো না?”
এস এ মাহমুদ, সাংবাদিক/ব্লগার
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com