ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আঞ্চলিক বৈষম্যের ভিত্তি ও প্রতিকার

সাইয়েদা ফাহিমা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১২
আঞ্চলিক বৈষম্যের ভিত্তি ও প্রতিকার

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে ভাষাগত ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৬১ সালে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বৈষম্যর বিরুদ্ধে লড়াই’ নামক একটি ধারাবাহিক প্রকাশের ব্যবস্থা করেন এবং আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ৬ দফা, যার অবশ্যম্ভবী ফল ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ।

কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা আঞ্চলিক ভেদাভেদের মূল এখনো উপড়ে ফেলা যায়নি।

১৯৯৫-৯৬ সালের (আয়-ব্যয়) জরিপের পর সর্বপ্রথম আঞ্চলিক ভেদাভেদের তথ্যভিত্তিক আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়। অর্থনীতির পরিভাষায় উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদিত পণ্য নির্বিবাদে চলাচলের (স্থানান্তরের) সুযোগ থাকলে যেকোনো স্থানের বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত সুফল সংযুক্ত অন্যান্য এলাকায়ও পৌঁছানোর কথা। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে শ্রম, কাঁচামাল বা পণ্যের মতো উৎপাদনের অনেক উপকরণ (সম্পদ) সহজে চলাচল করতে পারে না এবং উৎপাদনে অপরিহার্য এ রকম কিছু সম্পদের অপ্রাপ্যতা আঞ্চলিক বৈষম্যের অন্যতম মূল কারণ।

অর্থনীতিবিদদের মতে, সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে দেশের সব অঞ্চলে সমান উন্নয়নের কথা থাকলেও দীর্ঘকাল ধরে অবহেলার শিকার হয়েছে কোনো কোনো অঞ্চল। মূলত সামাজিক অবস্থান এবং ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায়ে কোনো কোনো অঞ্চলের প্রাধান্য সৃষ্টি হওয়ায় সবদিক থেকেই এগিয়ে গেছে এই সব অঞ্চল। পাশাপাশি যখন যে অঞ্চলের মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতার মূল পদগুলোতে জায়গা পেয়েছে, তখন সে অঞ্চলে উন্নয়নের গতি বেড়েছে। ফলে স্বাধীনতার পর প্রায় চার দশক ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও বরাদ্দ রাজধানী ও ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হচ্ছে। সুপরিচিত একটি জাতীয় দৈনিকের ২৩ জুনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ স্বীকার করেছেন, বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের এলাকায় সরকারি দলের সংরক্ষিত আসনের মহিলা সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, ঐ এলাকার জনগণ কি তাদের চাহিদা মোতাবেক উন্নয়ন বরাদ্দ পাবে? আবার অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন বরাদ্দের দিকে তাকালে দেখা যায়, রাজধানীতে যাতায়াত ও জীবনযাত্রা সহজ করার জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে সব সরকারের আমলেই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মধ্যাঞ্চল। বন্দরকেন্দ্রিক বাণিজ্যিক যোগাযোগের কারণে চট্টগ্রামের ওপর ভিত্তি করে পূর্বাঞ্চল এবং বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পর উত্তরাঞ্চলেও উন্নয়নকেন্দ্রিক বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অথচ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকলেও শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় পরিকল্পনার অভাবে দেশের সব থেকে অনগ্রসর অঞ্চল এখন দক্ষিণ। তবে পার্বত্য অঞ্চলে আবার দেখা যাচ্ছে ভিন্ন দৃশ্য! ৪৮ শতাংশ বাঙালি হবার পরেও ওই অঞ্চলে সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে মাত্র ২০ শতাংশ বরাদ্দের সুবিধা ভোগ করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি ও বাঙালিরা।

উন্নয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রে এরূপ সমস্যা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়ায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে দক্ষিণাঞ্চলের তীব্র আঞ্চলিক বৈষম্য দেখা দেয়।

বিআইডিএস-এর এক জরিপ অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে কৃষি খাতে দেশের কেন্দ্র ও পূর্বাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলে মজুরির হার ছিল যথাক্রমে ২২০, ১৬৪, এবং ১৫৭ টাকা। আবার শিক্ষা খাতের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সাক্ষরতার দিক থেকে ক্রমান্বয়ে প্রথমে ঢাকা, পরে খুলনা ও বরিশালের অবস্থান। এক্ষেত্রে সাক্ষরতা অর্জন করলেও অনেকটাই পিছিয়ে দক্ষিণঅঞ্চল।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, জীবনযাত্রার মান থেকে শুরু করে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন, কর্মসংস্থানের সুযোগ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ অর্থনীতির প্রতিটি সূচকেই বরাদ্দ যথেষ্ট না হবার কারণে দেশের এক অঞ্চলের সাথে অন্য অঞ্চলের বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসনে প্রয়োজন সামগ্রিক পদক্ষেপ। সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয় এই বৈষম্য দূর করা। কেননা, আমাদের সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং সংসদ সদস্য আইন প্রণয়ন করবেন’- এই নিয়ম থাকলেও ১০ মার্চের জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রতিবেদনে দেখা যায়, একনেক স্থানীয় উন্নয়নের জন্য সংসদ সদস্যদের ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে। মূলত এই থেকেই বৈষম্য শুরু। তাই ক্ষমতার সর্বক্ষেত্রে সমন্বয়ের মাধ্যমে বৈষম্য নিরসন করতে হবে।

এছাড়া কৃষির বহুমুখিকরণ প্রচেষ্টা, জাতীয় বাজেটে অনুন্নত অঞ্চলকে প্রাধান্য দেওয়া, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রতি জোর দেওয়া, প্রশাসনিক কেন্দ্রীকরণ হ্রাস করা, এডিপি থেকে রাজনৈতিক প্রকল্প হ্রাস করা, প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি, অনুন্নত অঞ্চলের লোকসানি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে লাভজনকে রূপান্তর করা, উৎস অঞ্চলের কাছাকাছি এলাকাগুলোতে গ্যাস প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার দেওয়া, অঞ্চলভিত্তিক কর্মসংস্থান তৈরি করা, প্রয়োজনে জেলা সরকার গঠন করা, অত্যাধুনিক নীতির বদলে অঞ্চলভিত্তিক চিরায়ত নীতির প্রাধান্য দেওয়া, উন্নয়ন পরিকল্পনায় স্থানীয় নীতি অগ্রাধিকার দেওয়া, জেলাভিত্তিক বাজেট তৈরি করার মাধ্যমে বাজেট প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ করা, জাতীয় ও আঞ্চলিক বাজেটের খাত/বিভাগসমূহ আলাদা করা, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া অঞ্চলে শিল্পপার্ক তৈরির পরিকল্পনা যথা সময়ে বাস্তবায়ন করা এবং সর্বোপরি সুষম জাতীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য অধিকতর দারিদ্রপ্রবণ অঞ্চলকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রভৃতি বিষয়াবলী প্রতিকারের উপায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

আঞ্চলিক বৈষম্যর সূত্র ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখা রচিত হয়েছিল। আজ সেই স্বাধীন দেশেই আঞ্চলিক বৈষম্য লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। সুষ্ঠু সমাজ অগ্রগতির প্রয়োজনে সাধারণভাবেই অর্থনৈতিক বৈষম্য কাম্য নয়। আর বৈষম্য আঞ্চলিক ব্যাপ্তি নিলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও বিভেদমুখি ধারা প্ররোচিত হবার আশঙ্কা বাড়ে।

সাইয়েদা ফাহিমা: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগে অধ্যয়নরত যোগাযোগ: sayedafahima@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৮ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১২
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।