ঈর্ষা নয়। ঈর্ষণীয় হতে যেসব যোগ্যতা প্রয়োজন, তার ধারে কাছেও এরা নেই।
ব্যবসা একটি স্বীকৃত পেশা। ব্যবসায় কেউ সৎ থাকতে পারেন অসৎও হতে পারেন। সেটা ব্যবসায়ীদের নৈতিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সাধারণ মানুষ তাকে বিচার করেন তার সেই বৈশিষ্ট্য দিয়েই । কিন্তু প্রতারণা! প্রতারণা তো অসাধু ব্যবসার চেয়েও জঘন্য। ব্যবসা করলে বলে কয়েই করা উচিৎ। দেশ ও সংস্কৃতির সেবার নামে স্বার্থ হাসিলের ব্যবসা তো রীতিমত মানুষকে ধোঁকা দেয়া । মানুষকে ধোঁকা দেয়াই প্রতারণা। যে স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে সেই ধোঁকা দেয়া বা প্রতারণা , তার জন্য ধোঁকাবাজ ও প্রতারকরা মনুষ্যত্বের ন্যূনতম বৈশিষ্ট্যটুকুও হারিয়ে ফেলে। সেকারণেই প্রতারণা বা প্রতারকরা নিকৃষ্টতম, পশুর চেয়েও অধম। অবশ্য বলে রাখা প্রয়োজন, পশুদের বিবেক-বুদ্ধির অস্তিত্ব নেই। এই বিষয়টি বাদ দিলে দেখা যাবে অনেক ক্ষেত্রেই পশুরা মানুষ নামধারী অনেক আদমের চেয়ে ভালো।
সময় ও সভ্যতার বিকাশে যখন মানুষের আরো সভ্য হওয়ার কথা, সেখানে দেশ ও সংস্কৃতির নামে নিকৃষ্টতম এই প্রতারণা বেড়েই চলেছে অদ্ভুতভাবে। নিত্য নতুন নানান কৌশলে। আর যারা মান-সম্মান রক্ষা করে জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে চাই, বেঁচে থাকতে চাই মানুষের মত- তাদের দুর্ভোগ বাড়ছেই। নিরব যন্ত্রনার কাতরতায় বুকফাটা চাপা কান্না আর নিয়তির করুণ কষাঘাতই তাদের পাওনা । ‘বাস্তবতা’ বলে মেনে নিতে হচ্ছে এসব বছরের পর বছর। কিন্তু কতকাল আর এভাবে সবকিছু মেনে নিতে হবে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না।
মাছের মাথায় পচন ধরেছে। সমাজের যারা নামী-দামী গুণী সার্টিফিকেটধারী, তারাও সারিবদ্ধ হচ্ছে ঐ প্রতারক, প্রবঞ্চকদের সাথে; অবাক বিস্ময়ে শুধু দেখতেই হচ্ছে । ধোঁকাবাজিতে তাই আরো শক্তিধর হচ্ছে ঐসব চিহ্নিত প্রবঞ্চক, ধোঁকাবাজরা।
মুনাফার জন্যই ব্যবসা, তাতে কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু ব্যবসাটা যদি হয় দেশ ও দেশের মানুষের সম্ভ্রমের বিনিময়ে নিজের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করা, পকেট ভরা, সুযোগের অপব্যবহারের দম্ভে, সমাজের নিরীহ সাধারণ মানুষগুলোকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা? আত্মপ্রচারণা, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব আর বেসাতি!
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মানুষ্যত্বের ন্যূনতম গুণাবলিকে ত্যাগ করে হীনস্বার্থ হাসিল করার অর্থই অন্যের সর্বনাশ। সমাজের ধ্বংস ডেকে আনা আর দেশের ও দেশের মানুষের সম্ভ্রমহানি করা। আগেই বলেছি ধোঁকাবাজ, প্রতারক প্রবঞ্চকরা একাজটিই করে থাকে। সেকারণেই সমাজে এরা নিকৃষ্টতম, নর্দমার কীট পতঙ্গসম।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ধোঁকাবাজ. প্রবঞ্চক, প্রতারকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই সাধারণের খালি চোখে তাদের চিহ্নিত করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।
প্রবাসে নিজেদের মাতৃসম দেশ ও সংস্কৃতিকে বিকিয়ে নানান ব্যবসা পেতেছে এসব ধোঁকাবাজ, প্রবঞ্চক, প্রতারকরা । বিশেষ কোনো মেলা বা তথাকথিত অ্যাওয়ার্ড এমনকি অর্থ না বুঝে কন্ফারেন্স, কনভেনশন ইত্যাদির নামে ব্যবসার ফাঁদ পাতে এরা। অথচ দেশ ও সংস্কৃতি উদ্ধারে (!) এসব তথাকথিত আয়োজনে কোনো প্রতিষ্ঠানিক তো দূরের কথা সামাজিক স্বীকৃতিও নেই। আছে শুধু সাড়ে তিনশো (৩৫০) ডলারের একটি ‘সাইনবোর্ড’ ঝোলানোর ইনকর্পোরেশন লাইসেন্স। নিজের মা, মাটি, দেশ, সংস্কৃতি আর বন্ধনের অমূল্য আবেগে সহজ সাধারণ মানুষগুলো হৃদয়ের আকুল আকাঙ্ক্ষায়- বুক ভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে ছুটে যায় এসব তথাকথিত আয়োজনে । অতঃপর প্রতারিত হয় সহজেই।
দেশের ও সমাজের কিছু শিল্পী নামীদামী-গুণী সার্টিফিকেটধারীরা, প্রতারক প্রবঞ্চকদের প্রতারণার পথ আরো সুগম করে দেন। বড় বড় রঙিন বিজ্ঞাপনে স্থান করে নেয় এসব ‘ঢাকার অতিথিরা’। স্বপ্নের আমেরিকায় প্রবেশানুমতিতে তাদের জীবনের সবচেয়ে মহামূল্যবান (!)‘ভিসা’, সাথে অজানা উৎসের অর্থে অথবা খয়রাত বা চাঁদাবাজিতে ব্যবস্থা করা একখানা বিমানের টিকেটে বিক্রি হয়ে যান চরিত্র সমেত এসব তথাকথিত শিল্পী, নামীদামী গুণী(!) জনেরা । আর আমেরিকার মাটিতে স্পর্শ করেই গোগ্রাসে ঝাঁপিয়ে পড়েন দু’টাকার সস্তা রঙিন পানির ফোয়ারায়।
তারপর মনোরঞ্জনের সবকিছুর সন্ধানে মরিয়া হয়ে ওঠেন। লিঙ্গভেদে আবার এদের বিপরীত কর্মকাণ্ড ও ওপেন সিক্রেট। ‘ধন্য করেন জীবন’ সবাই। দু’পয়সা উপার্জনও করে কেউ কেউ। অথচ এসব নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হলে কথা বলেন যেন ‘ধোয়া তুলসি পাতা’। কিছুই জানেন না, বোঝেনও না। মানুষকে বোকা বানানোর ব্যর্থ অপচেষ্টার বিকৃত মানসিকতায় বলতে সামান্য সংকোচও বোধ করেন ‘এসব তো জানি না, জানলে আসতাম না। ’
দেশের ভিতরে কোথাও যেতে তারা অনুসন্ধান করে সবই জানেন - কেবল, লন্ডন, আমেরিকা, জার্মানি, কানাডা-তে যেতে তারা কিছুই জানেন না, বোঝেনও না। কিন্তু সুযোগ পেলেই আসেন বারবার। ন্যূনতম, নীতি নৈতিকতা বোধকে বিসর্জন দিয়ে এসব গুণী (?) জনেরা যতটা না ধন্য করেন ঐসব প্রবঞ্চক প্রতারকদের, তার চেয়েও বেশি যেন নিজেরা ধন্য হন। তাদেরকে ব্যবহার করলে যেন কিছুই এসে যায় না । ভাবখানা এমন-তারা মহামানব হয়ে বিতর্কের উর্ধ্বে চলে গেছেন।
প্রবঞ্চক, প্রতারকরা এসব আয়োজনের মাধ্যমে শুধু নির্বিঘ্নে ব্যবসাই করেন না, জাতে ওঠারও চেষ্টা করেন ।
ভিসার ব্যবসা, এমনকি ভিসা পেতে আমন্ত্রণপত্রের ব্যবসাও এখন যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে- এমন অভিযোগ এখন সর্বত্রই। এসবই যেন গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে আমাদের। তাই যদি হয়, তাহলে আর বসে থাকা কেন- আসুন না, আমরাও সবাই কোমর বেঁধে নেমে পড়ি একই ব্যবসায়। রাতারাতি উন্নতি (!) নিশ্চিত। বলা যায় না নতুন ‘সামাজিক ব্যবসা (!)‘ হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূসকে ডিঙ্গিয়ে হয়তো নোবেলও মিলে যেতে পারে ভাগ্যে!
* নিউইয়র্ক করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১২
এমএমকে