ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ক্যাম্পাস-নিসর্গ থাক শিক্ষার্থীদের হাতে

গাজী এস. এম. আসমত, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২১ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১২
ক্যাম্পাস-নিসর্গ থাক শিক্ষার্থীদের হাতে

অন্যের ক্যাম্পাস নিয়ে কিছু বলবো না, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস-নিসর্গ সম্বন্ধে বলছি। বাংলাদেশের একমাত্র অকৃত্রিম নিসর্গে পূর্ণ এ ক্যাম্পাসের তুলনা অন্য কোনো কৃত্রিম ক্যাম্পাসের সঙ্গে চলে না।

ইন্দো-বার্মা বায়োডাইভার্সিটি হটস্পটের আশ-পাশে থাকায় চবি ক্যাম্পাসসহ সমগ্র চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার জীববৈচিত্র্যের সংখ্যার সঙ্গে অন্য কোনো এলাকার তুলনা হয় না। আরেকটু নজর দিলে এ ক্যাম্পাস এলাকা সারা পৃথিবীর মধ্যে অনন্য ভূখন্ড হিসেবে বিবেচিত হতে পারতো। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, নানা মনুষ্যঘটিত কারণে ক্যাম্পাস ক্রমশ: বিবান ভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। একদিকে, ইউক্যালিপটাসের মতো পরিবেশ-শত্রু গাছের বিস্তার, অন্যদিকে, চারদিকের পাহাড়ে নির্বিচার গাছ কাটা, জলাভূমি ভরাট করে ফেলা, পাহাড় ধস ও পাহাড় কাটাসহ বিভিন্ন কারণে চবি ক্যাম্পাস দারুণ সংকটে পড়েছে।

ক্যাম্পাস-নিসর্গ আরও সমৃদ্ধ করার উদ্দেশে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক শিক্ষার্থী জীববিজ্ঞান অনুষদের প্রথম ডিন মহোদয়ের কাছে পাখি সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণের একটি চমৎকার প্রকল্প জমা দিয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই প্রকল্পটি ওই শিক্ষার্থীকে ফেরত পাঠিয়ে এক জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে। শিক্ষার্থী প্রাণিবিদ্যা বিভাগের হলেও প্রকল্পটি ছিল সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষে। ক্যাম্পাস-নিসর্গ রক্ষার ধারণাটি একজন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কপ্রসূত বলে হয়তো কিছু শিক্ষকের মাথা ঘুরে গিয়েছিল। সে কারণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মতো অবস্থায় ফেলে ধারণাটি সমূলে বিনষ্ট করেছেন, অন্যদিকে নিজেরা বিভিন্নভাবে সম্মানিত হলেও ক্যাম্পস-নিসর্গ রক্ষার উপায় আজ পর্যন্ত উদ্ভাবিত হয়নি।
ক্যাম্পাস হচ্ছে মূলত শিক্ষার্থীদের; অতএব ক্যাম্পাসের প্রকৃতি-পরিবেশ সম্বন্ধে জানা এবং তা সংরক্ষণের আকুতিও ওদেরই বেশি থাকে। সম্মানিত উপাচার্যের ভবনের সামনে যে নালা (ড্রেন) আছে তার যে দূরবস্থা সে কথাটি উল্লেখ করে কোনো শিক্ষক কি এখন পর্যন্ত প্রতিকারের কথা বলেছেন? শিক্ষার্থী সাংবাদিকরা অনেক রিপোর্ট করেছে। অথচ এক সময় এ নালাটি ছিল ব্যাঙসহ জলচর প্রাণীদের অভয়াশ্রম। এমন দৃষ্টিকটু ড্রেনকে অনায়াসে দৃষ্টিনন্দন লেকে রূপান্তারিত করা সম্ভব। তবে তা শিক্ষকদের দিয়ে হবে না, চাই শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা প্রহরীদের নিরন্তর সতর্ক পাহারা। আগামী ভর্তি পরীক্ষার সময় যেন ক্যাম্পাসের এই গরিবি হাল নবাগত লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সামনে তুলে ধরে মাথা হেঁট করে রাখতে না হয়; সে ব্যবস্থা এখনই শুরুর উদ্যোগ না নিলে প্রাকৃতিক সম্পদের অমিতব্যয়ী ব্যবহার কখনওই সুফল বয়ে আনতে পারে না। লাইব্রেরি ও কলাভবনের মাঝখানে একটি নালা ছিল, কেউ এটাকে পুকুর বানাতে চেয়েছেন, পুকুর বানিয়েছেন, কেউ এটাকে কচুরিপানার বাগান বানাতে চেয়েছেন তাও বানিয়েছেন। এখন এটি পানা-বাগান হিসেবেই আছে। পানা পরিষ্কারের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসকে পরিবেশ-শত্রু গাছ উচ্ছেদে উপাচার্য মহোদয়ের সহযোগিতা চাইতে পারে। শুরু হোক নতুন যুগের।
 
জরুরি ভিত্তিতে করণীয়

১.   আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবসটিকে লক্ষ্য রেখে সারা বছর জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সম্বন্ধে ক্যাম্পাসে নানা আয়োজনে শিক্ষার্থীদের উদ্বুব্ধ করতে হবে। ক্যাম্পাস যেহেতু কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় তাই ক্যাম্পাস-নিসর্গের দেখভালের জন্যেও কাউকে একা দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হবে না। তবে ছাত্র সংসদ (চাকসু) সচল না থাকায় এবং ক্যাম্পাসে বর্তমানে চবি সাংবাদিক সমিতি একমাত্র বৈধ শিক্ষার্থী সংগঠন হিসেবে সচল থাকায় ক্যাম্পাস-নিসর্গ দেখভালের দায়িত্ব তাদের হাতে দেওয়াই সমীচীন হবে বলে মনে করছি। ওদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নির্দেশে সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্মিলিতভাবে ক্যাম্পাস-নিসর্গকে সত্যিকার নৈসর্গিক ভূখণ্ডে রূপ দিতে পারবেন আশা করি। শিক্ষক হিসাবে একমাত্র উপাচার্য ছাড়া আর কেউ এ কমিটিতে থাকতে পারবেন না। কমিটি প্রয়োজনে যে কোনো শিক্ষকের পরামর্শ আহ্বান ও গ্রহণ করতে পারবে কিন্তু কমিটিতে রাখতে পারবে না। আমার ধারণা, শিক্ষকদের দিয়ে ক্যাম্পাস রক্ষা হবে না। হলে আগেই হতো।

২.   সম্পূর্ণ ক্যাম্পাসকে সরকারী অনুমতি ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুদান সাপেক্ষে বিশেষ ধরনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করে স্থানীয় মাটি-পানি-বাতাস ও লোক চলাচল অনুযায়ী গাছপালা রোপন করা।

৩.   কোনো এলাকায় বিরাট স্থাপনার কারণে গাছকাটার বিষয়টিকে ‘হৃদয়ের ক্ষত’ হিসাবে চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে তা নিরাময়ের ব্যবস্থা করা।

৪.   বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ও বিদেশি সংস্থার অর্থ ছাড়া দেশি কোনো উৎস (যেমন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় ইত্যাদি) থেকে অর্থ সংগ্রহ না করা। বনবিভাগ সংশ্লিষ্ট দূর্নীতির কথা এরই মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হওয়ায় এর ধারে কাছে যাওয়া ঠিক হবে না।

৫.   ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ঝুঁকিজনিত অংশগুলো (বর্তমান যেখানে ছিনতাই ইত্যাদি হয়) চিহ্নিত করা এবং সেখানে পর্যন্ত নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগ করা। প্রয়োজনে ক্যাম্পাসের চারকোনায় চারটি ছোট পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনা করা। নিরাপত্তা রক্ষী ও পুলিশকে তাঁদের দায়িত্ব সম্বন্ধে আগে থেকেই জানিয়ে রাখতে হবে যাতে ক্যাম্পাস-নিসর্গ রক্ষা পায় ও পুনরুদ্ধার হয়। এদিকটায় বিশেষ নজর রাখতে হবে।

৬.  বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব এলাকা সীমানা দিয়ে সুচিহ্নিত করে নিতে হবে। দখল হয়ে যাওয়া জমি পুনরুদ্ধারে আইন অনুষদকে দায়িত্ব দিয়ে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি জমি পুনরুদ্ধারে উৎসাহিত করতে হবে। ক্যাম্পাসের জমি দখলমুক্ত করতে নিসর্গ-কমিটি প্রয়োজনে র‌্যাব-এর মতো বাহিনীর সহায়তা নিতে পারবে।

৭.   ব্যাঙের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র হিসাবে ক্যাম্পাসের সমস্ত নালা-নর্দমা-খালের অবস্থান অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশে প্রয়োজনে পুনর্খননের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করতে হবে।

৮.  নালা-নর্দমাগুলোতে সারা বছর যেন মশা ও মশার লার্ভাভুক মাছ পালন করা যায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।

৯.   কাজের উদ্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী ও গবেষক ছাড়া আর কেউ পাহাড়ে উঠতে পারবে না, কিংবা পাহাড়ের ওপরে-গায়ে-পাদদেশে চাষাবাদ বা গৃহ-নির্মাণ করতে পারবে না।

১০.  টোকাই বা ভিক্ষুক শ্রেণীর কেউ যেন ক্যাম্পাসের পাহাড়ে উঠে পাতা কুড়ানোর নাম করে পাহাড়ের খোড়ল থেকে বন্যপ্রাণীর শাবক-ডিম ইত্যাদি চুরি করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে অনুষদ ও হলসংলগ্ন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক প্রচারণা ছাড়াও নিরাপত্তারক্ষীদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।

১১.  প্রতি ৩ মাস পর একবার করে নিসর্গ-কমিটি সাংবাদিক সমিতি কার্যালয়ে সাফল্য-ব্যর্থতা, সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরবেন।

১২.  বহিরাগত কেউ ক্যাম্পাসের প্রাণী ও পরিবেশ নিয়ে গবেষণা-পর্যবেক্ষণ করতে চাইলে নিসর্গকমিটি অনুমতি দানের বিষয় বিবেচনা করবে। বহিরাগতদের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপে চবি ক্যাম্পাস জীববৈচিত্র্যহীন হয়ে যেতে পারে।

১৩.  ক্যাম্পাস-নিসর্গকে অকৃত্রিম রূপ দিতে চাইলে বিলবোর্ড বা ব্যানার টানানো নিষিদ্ধ করতে হবে। নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও সাইনবোর্ড/বিলবোর্ড/ব্যানার টানানোর অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে না। বিষয়টি প্রক্টর অফিস ও নিসর্গ কমিটি সম্মিলিতভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে বলে মনে করি।

১৪.  বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস একটি বিশাল এলাকা নিয়ে নির্মিত। সারা বছরই টুকটাক নির্মাণকাজ চলে। তাই বলে এসব কাজ দৃষ্টিকটুভাবে করা ঠিক নয়। গত কয়েক বছর ধরে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবন নির্মাণ কালে যেভাবে লোহা-লক্কর-টিন-বাঁশ সামগ্রী ফেলে রেখে প্রদর্শিত হয়েছে তার তুলনা দেওয়া অসম্ভব। বিষয়টি প্রকৌশল বিভাগকে সব সময় ভেবে দেখতে হবে।

১৫.  ক্যাম্পাসের রাস্তাগুলো জালের মতো ছড়িয়ে আছে। আপাতদৃষ্টিতে নীরব মনে হলেও এসব সড়কে গাড়িচাপায় বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর সংখ্যা কম নয়। নিসর্গ কমিটি গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়টি অবশ্যই বিষয়টি খেয়াল রাখবে আশা করি।

বিভিন্ন জীবগোষ্ঠী ও প্রকৃতিসংক্রান্ত কমিটির কার্যক্রমে সারা বছর চবি ক্যাম্পাস মুখরিত, আরও সচল ও গতিময় হোক তা কে না চায়? আমার ধারণা, গ্রাম থেকে আসা বা গ্রামকে অন্ততঃ নিজ চোখে দেখেছে এমন প্রত্যেক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস-নিসর্গ রক্ষায় অবশ্যই এগিয়ে আসবে।

গাজী এস. এম. আসমত: অধ্যাপক,, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।