আর পাঁচটা অজপাড়াগ্রামের মতো টুঙ্গীপাড়ার ডুমুরিয়া ইউনিয়নের কোনো এক গ্রাম। সালেহা নামের একটি মেয়ে কাদাজল পেরিয়ে, প্রতিদিন কয়েক মাইল পথ পায়ে হেঁটে কলেজে পড়াশোনা করে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন।
সালেহার স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। পাশের গ্রামের চেয়ারম্যানের মেয়ে পড়ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সালেহার বাবা সাধারণ কৃষক। অনেকের কাছে সালেহার স্বপ্ন গরীবের ঘোড়া রোগের মতোই। কিন্তু সবার স্বপ্ন কিংবা চিন্তার জগৎ এক হয় না। সালেহার বাবাও ঠিক তেমনি। লেখাপড়া না শিখলেও মনের ভেতরে চাঁদের আলোর মতো মায়াবী রশ্মি কাজ করে। মেয়ের স্বপ্ন তিনি পূরণ করবেনই। প্রয়োজনে জমি বেচে হলেও।
কিন্তু গোল বেঁধেছে বাস্তবতার সঙ্গে। সারা দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে পরিমাণ প্রতিযোগিতা হয়, সেখানে একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়কে লক্ষ্য করে এগুলে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। টাকাওয়ালা অভিভাবকদের সন্তানেরা সেই কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ পর্যন্ত বাবা মায়ের ভয়াবহ চাপ এবং চতুর্মুখী সাহায্য সহযোগিতা (প্রতি বিষয়ে টিউশন, ভালো খাবার) নিয়ে বড় হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টের আগেই ভর্তি কোচিং এ যুক্ত হয়েও যেখানে তাদের ভর্তি নিয়ে সন্দেহ থাকে, সেখানে সালেহার মতো দরিদ্র কিশোরী যে কিনা জীবনে প্রাইভেট পড়ার কথা ভাবতেই পারেনি, ভর্তি কোচিং তো মঙ্গলগ্রহে যাবার মতোই অসম্ভব অবাস্তব চিন্তা, সে কি করে একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়কে লক্ষ্য করে এগুতে ভরসা পাবে!
ধরা যাক, সালেহাকে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে কম করে হলেও তিনটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে। সেই হিসেবে ধরি- ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সালেহার মতো দরিদ্র পরিবারের কয়জনের আত্মীয় আছে যে তারা ঢাকায় থাকে কিংবা থাকলেও দু’চারদিনের জন্য কোনো আত্মীয়কে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করার ক্ষমতা রাখে। সেক্ষেত্রে সালেহাকে তার বাবার সঙ্গে হোটেলে থাকতে হবে। তার মানে তাকে দুটো রুম নিতে হচ্ছে। ঘটনার এই পর্যায়ে কয়েকটি প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়াল।
প্রথম প্রশ্ন- সালেহারা নিশ্চয়ই কোনো দামী এবং নিরাপদ হোটেলে থাকার ক্ষমতা রাখে না। ঢাকা শহরে কমদামী হোটেলগুলোর যে চালচিত্র, সেখানে মেয়ে হিসেবে সালেহার নিরাপত্তা কোথায়? প্রায়ই বিভিন্ন শহরগুলোর হোটেলগুলো নিয়ে নারীঘটিত নানা কেলেংকারী এবং অপরাধের খবর চোখে পড়ে। এই যেখানে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, সেখানে সালেহার মতো সরল, শহরের মারপ্যাঁচ না বোঝা এক কিশোরীকে নারী লোলুপদের হাত থেকে বাঁচাবে কে? তার পিতা? কিভাবে? সে নিজেইতো তখন অসহায়, নানামুখী হুমকির মধ্যে। বেশি তেড়িবেড়ি করলে এক পুঁটলা হেরোইন পকেটে রেখে হাজতে পুরতে কতোক্ষণ? তাছাড়া মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে না? এখনো আমাদের সমাজে ধর্ষণকারীরা বুক ফুলিয়ে চলে। আর ধর্ষণের শিকার মেয়েদের মুখ লুকিয়ে থাকতে হয়। সেখানে কন্যাদায়গ্রস্ত সালেহার পিতা কলঙ্কের (কলংক কার? ধর্ষিতার নাকি ধর্ষণকারীর?) দাগ কাটা মেয়েকে বিয়ে দেবে কিভাবে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, হোটেলে থাকা, যাতায়াত ভাড়া, তিনবেলা (না হোক দু’বেলা) বাইরে খাবার কারণে পরিবারের ঘাটতি বাজেট কিভাবে পূরণ করবে সালেহার পরিবার?
তৃতীয় প্রশ্ন, আমরা জানি, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা এক সময়ে হয় না। ধরে নিই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পরে পাশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দু’দিন পরে হবে। তার মানে তাকে আরো দু’দিন বাড়তি হোটেলভাড়া এবং খাবার খরচ গুণতে হচ্ছে। আর যদি বেশ কয়েকদিন পরে হয় তাহলে সালেহাকে আবার গ্রামে ফিরে গিয়ে আবার আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে তাকে পুনরায় গাড়িভাড়া, হোটেল এবং খাবার খরচের টাকা গুনতে হবে। এর মাঝে সিস্টেম লসে পড়ে সালেহার বাবার গোটা সপ্তাহ কামলা খাটা বন্ধ। অর্থাৎ একদিকে শিক্ষিত হবার তাড়নায় হোটেল, যাতায়াত এবং খাবার বাবদ ব্যায়ের চাপ, অন্যদিকে একই কারণে আয় রুদ্ধ। এরপরে কবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা, যেতে হবে সেখানে। আবার সেই নিরাপত্তার প্রশ্ন, হোটেল খরচ, খাবার খরচ, যাতায়াত ভাড়ার বিষয়।
চতুর্থ প্রশ্ন, এই পরিস্থিতিতে সালেহা কি তার স্বপ্নকে জলাঞ্জলী দেবে? সালেহার জীবনের প্রশ্নের সঙ্গে কিছু সম্পূরক প্রশ্নও চলে আসে।
এক. একজন ছাত্র বা ছাত্রী সেই প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত দীর্ঘ বারোটি বছর যে অসাধ্য পরিশ্রম করে একের পর এক ভালো ফলাফল করল, লেখাপড়ার শেষ পর্যায়ে পেশা নির্ধারণী বিষয় নির্ধারণের সময় বিগত পরীক্ষাগুলোর (যেমন মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক) মূল্যায়ন নেই কেন? শুধু একটি ভর্তি পরীক্ষার সাফল্যের কাছে বিগত বার বছরের সব সাফল্য অর্থহীন হয়ে যাবে?
শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন, ভর্তি পরীক্ষার বেলায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলকে ভিত্তি ধরার জন্য। পুরোপুরি সেটা করতে গেলে অনেকে আবার আশংকা প্রকাশ করেছেন, তাহলে গ্রাম কিংবা ছোট শহরের ছাত্রছাত্রীরা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। কেননা গ্রামের অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে শহরের ছেলেমেয়েদের মতো গুণগত শিক্ষা পায় না বিধায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ নাও হতে পারে।
দুই. তাহলে এই দুইয়ের মাঝে বিকল্প পথ কি? কিভাবে সম্ভব সবার জন্য উচ্চশিক্ষার পরিবেশ তৈরিতে সাম্যতা সৃষ্টি করা? শহর এবং গ্রামের মধ্যকার শিক্ষার গুণগত পার্থক্য কমিয়ে আনা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। অর্থাৎ গ্রামের বা মফস্বল শহরে অবস্থিত স্কুল কলেজগুলোর পড়ালেখার মান উন্নয়ন করা। আবারও প্রশ্ন আসবে, কিভাবে? মূলত: এই প্রশ্নের সমাধান করতে পারলেই অনেক জটিল সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যায়। তবে একটি পরামর্শ অন্তত এই মুহূর্তে দেওয়া যেতে পারে। সব পেশার মতোই শিক্ষকদেরও একটা লক্ষ্য থাকে শহরমুখী বদলী পাবার। এই সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এনে নিয়মিত বদলীর মাধ্যমে শিক্ষকদের গ্রামমুখী করা। তাহলে গ্রামের শিক্ষার্থীরাও ভালো শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে থেকে গুণগত শিক্ষা পেতে পারে।
তিন. মেধাবী ছেলেমেয়েদের যদি ভালো পেশায় এনে পেশার গুণগত মান সর্বোচ্চ রাখার উদ্দেশ্য থাকে, তবে ‘পোষ্য কোঠার’ নামে একটা ‘সুবিধাবাদী শ্রেণী’ তৈরির প্রচেষ্টা কেন? এটা উত্তারাধিকার রাজনীতির মতোই নেতার ছেলেমেয়েকে নেতা বানানোর মতোই আরেকটি হীন প্রক্রিয়া। দেশের সকল নাগরিক সমান বিধায় বাবা মায়ের চাকরির বদৌলতে তাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে বাকি সব নাগরিকের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। ‘কোটা পদ্ধতি’ থাকতে হবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের জন্য। বাবা মায়ের চাকরির সুবাদে তার সন্তানদের জন্য কেন?
সালেহার মতো দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে ‘সামাজিক প্রতিবন্ধকতা বা সামাজিক দুষ্টচক্র’ সৃষ্টিকারী কারা এবং তাদের উদ্দেশ্যই বা কি?
অবশ্যই এই প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে ‘এলিট শ্রেণীমুখী’ সরকারের ভূমিকা আছে। মূলত সালেহাদের স্বার্থ দেখার কোনো প্রয়োজন তাদের নেই। শুধু পাঁচ বছরে একবার ভোট দেবার ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য ভাবার সময় আমাদের কোনো সরকারের নেই। একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সালেহাদের মতো দরিদ্র পরিবারের কোনো উচ্চবিত্ত বা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আত্মীয় থাকে না। যদিও কালেভদ্রে কেউ থেকে থাকে তবে শ্রেণী উত্তরণের কারণে সে পিছনকে ভুলে যায়; অর্থাৎ সে নিজেকে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
এ কারণে অতীতে বারবার লেখা সত্ত্বেও ভর্তি পরীক্ষায় এখনো কোনো পরিবর্তন আসেনি। যদিও আমাদের বর্তমান জোট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী একটা বাহবা পাবার মতো কাজ করে ফেলেছেন। তিনি স্কুলে ভর্তির সময়ে কোনো শিশুর ধর্মের পরিচয় জানা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। শুধু ধর্ম কেন, যে কোনো পরিচয়ের সূত্রে বিভাজন অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর এই কাজের প্রায়োগিক দিক কোথায়?
মোহাম্মদ রহমান শেখ বললে যেমন যে কেউ বলতে পারবে যে সে মুসলমান কিংবা রমাপদ রায় নাম বলতেই যে কেউ ধরে ফেলবে তার ধর্মের পরিচয়। কিন্তু যে কাজ করলে গ্রামের এই সকল পিছিয়ে পড়া মোহাম্মদ কিংবা রমাপদদের উপকার হবে, সামাজিক দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারবে, সে ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাইনি।
এর আগে বহুবার বলা হয়েছে, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা একসাথে ব্যবস্থা করার জন্য। মেডিকেল কলেজগুলোতে করতে পারলে এখানে নয় কেন। পাশাপাশি পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে, যাতে সালেহাদের মতো খেটে খাওয়া পরিবারের সন্তানদের ভর্তি পরীক্ষার জন্য ঢাকা, খুলনাতে দৌড়াতে না হয়। গোপালগঞ্জের মতো জেলা শহরগুলোতে একটি করে কেন্দ্র রাখলে ক্ষতি কি? এভাবে এক সাথে পরীক্ষার ব্যবস্থা করলে শিক্ষকদের একটা বড় অংশ নাখোশ হবেন। কারণ তখন খাতা দেখার বাড়তি টাকা থেকে তারা বঞ্চিত হবেন। কাল্পনিক হিসেবে ধরা যাক, দেশের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ ছাত্রছাত্রী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। একসাথে পরীক্ষা হলে খাতাও হবে ২ লাখ। কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলে ইউজিসির ৩৭তম বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী একজন ছাত্র বা ছাত্রী গড়ে প্রতি বছর ভর্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৬ থেকে ১০টি ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। এবার হিসেব করুন তাহলে শিক্ষকদের পকেটে কতো টাকা ঢুকছে বর্তমান ভর্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এর বাইরে পরীক্ষা সংক্রান্ত দুর্নীতি তো আছেই। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এক সাথে করলে সেটার হার অনেক কমে যাবে।
শিক্ষকদেরই বা দোষ দেই কি করে! যে দেশে মন্ত্রীর সামান্য এপিএসের গাড়িতেই থাকে এককালীন ত্রিশ লাখ টাকা সেখানে প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোনো শিক্ষক সারা জীবন তার পেশার আয় থেকে এক সঙ্গে ত্রিশ লাখ টাকা দেখার সৌভাগ্য হয় না। অধ্যাপক আবু সায়ীদের সঙ্গে সরকারি এমপিদের দ্বন্দ্বের কারণে জানতে পেরেছি একজন জাতীয় স্বনামধন্য শিক্ষকের অর্থনৈতিক অবস্থা কতো করুন! তার মতো ব্যক্তিত্ববান তো সবাই নন! জীবনের কাছে কি নেতা, কি শিক্ষক অনেকেই তাই পরাজিত হন। কেউ লোভের কারণে, কেউ টিকে থাকার প্রশ্নে। জনগণের কোটি কোটি টাকা যে সব নেতারা মেরে খাচ্ছেন, সেটা অতি লোভের কারণে। আর খাতা দেখে টাকার মুখ দেখতে গিয়ে শিক্ষকরাও শোষন করছেন সালেহাদের মতো দরিদ্র অথচ মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের। সামাজিক দুষ্টচক্রের সূচনা এভাবেই।
সবাইতো অধ্যাপক আবু সায়ীদ নন যে লোভের উর্ধ্বে থাকতে পারবেন!
পাদটীকা: সালেহা কোনো বাস্তব চরিত্র নয়। কিন্তু সারা দেশে অসংখ্য দরিদ্র মেধাবী কিশোর কিশোরী যারা স্বপ্ন দেখে উচ্চশিক্ষা নিয়ে জীবন বদলানোর, সেই অগণিত বাস্তব চরিত্রের সম্মেলন এই লেখার চরিত্র সালেহা। কাজেই সালেহার চরিত্র কাল্পনিক হলেও বাস্তব।
mahalom72@msn.com
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১২
এজে