ঢাকা : ভুল করে ফেললে তার ক্ষতি থেকে বাঁচতে ক্ষমা চাওয়ার চাইতে সহজ উপায় আর কি হতে পারে? একবাক্যে বেঁচে যাওয়ার অমূল্য সূ্ত্রের নাম ‘দুঃখিত’।
এমন একটি শব্দ আমাদের অভিধানে আছে বলে আমরা অনেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ থেকেও পার পেয়ে যাচ্ছি হরহামেশা।
জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ‘দুঃখিত’ শব্দটির সর্বোচ্চ ব্যবহারে আমাদের কোনো কার্পণ্য নেই। কেমন মায়া আর কোমলতা দিয়ে শব্দটিকে ‘লালন’ করছি প্রতিনিয়ত। ঘুম থেকে ওঠা, ফের ঘুমুতে যাওয়ার আগে কতশতবার এই শব্দটি মুখে আওড়াতে হয়, ইয়ত্তা নেই। তবে আজকাল শব্দটির অবাধ ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে অনেক কিছু। যত্রতত্র ‘দুঃখিত’র আচমকা প্রয়োগ সহজ, সরল অবলা মানুষগুলোকে ‘বোকা’ বানানো ছাড়া আর কোনো উপকারেই আসছে না।
ক’দিন ধরে ঘটতে থাকা গল্পটির কথাই ধরা যাক। মেধাবী আর মননশীলদের অনন্য চারণক্ষেত্র বলে খ্যাত বুয়েটে বিরাজ করছে এক উত্তাল পরিস্থিতি। একদিকে গদি কামড়ে ধরে অনড় হয়ে আছেন ভিসি-প্রোভিসি আর অন্যদিকে গদি থেকে এ দু’ব্যক্তিকে সরানোর আন্দোলনে অদম্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। চলছে আন্দোলন। ক্রমাগত বাড়ার আশংকা (সহজ সমাধান আমাদের কাম্য)। পরিস্থিতি কোনদিকে হঠাৎ করে মোড় নিবে, আগে থেকে বলা দায়।
বুয়েটের এমন পরিস্থিতিতে কেউই লাভবান হচ্ছেন না। উভয়পক্ষই এক ধরনের ক্ষতির পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে শেষটা কার দিকে যাবে, সে অপেক্ষায় সবাই। হয়তো বিদায় নিতে হবে ভিসি আর প্রোভিসিকে। কিন্তু বিদায় নিতে (কিংবা পদত্যাগ করতে) বড্ড দেরি করে ফেলবেন তারা। ততোদিনে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে হারিয়ে যাবে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু দিন। হয়তো লেগে যাবে মস্ত একটা জট। এক্সাম পেছাবে, পেছাবে অন্যান্য একাডেমিক কার্যক্রম। তখন শিক্ষার্থীদের জন্য আর কিছুই বলার থাকবে না। কেবল নোটিশ বোর্ডে বড় করে লেখাটি ঝুলবে “সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত”।
আরেকটি ঘটনার কথা বলা যেতে পারে। সিএনজি অটোরিকশা চালকরা রাজধানী জুড়ে ধর্মঘট ডেকেছেন। কোত্থাও কোনো অটোরিকশা চলাচল করতে পারবে না বলেও কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। অনেক দাবি ওদের। আর ওদিকে দাবি মানবেন না বলে শপথ করেছেন মালিক আর সরকার পক্ষ। কি আর করা? সাধারণ মানুষ তো চিরজীবনই ‘বলির পাঁঠা’ হয়ে আসছে। এক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
ধর্মঘটের তৃতীয় দিন। শুক্রবার বিকেলে বারডেমের সামনে একজনকে দিগভ্রান্তের মত ছুটোছুটি করতে দেখে এগিয়ে গেলাম। খানিকপরেই দেখতে পেলাম লোকটি ধপাস করে মাটিতে বসে পড়লেন। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে কেবল তাকানো ছাড়া তার মুখে কোনো কথা বেরুচ্ছিল না। দু’জন মানুষ নিজেদের চোখ মুছতে মুছতে লোকটিকে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমিও পিছু চললাম। জানতে পারলাম, লোকটির পরম স্বজন ‘মা’ খানিক ক্ষণ আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। রাস্তায় লোকটির ছুটোছুটির কারণ জানতে পারি তখন। তার মা’কে জরুরি ভিত্তিতে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। অ্যাম্বুলেন্স ছিল না বলে অটোরিকশা ডাকতে এসেছিলেন। কিন্তু চালকরা যে ধর্মঘট ডেকে বসেছেন? সে কথা লোকটির জানা ছিল না। মনে মনে আমিও লোকটির জন্য বলে এলাম, “এইতো দু’একদিন পরে ধর্মঘট তুলে নেওয়া হবে (শনিবার রাতে মন্ত্রীর অনুরোধে শেষতক তারা ধর্মঘট তুলে নিয়েছেন)। আজকের এই সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। ”
রাস্তায় দীর্ঘ যানজটে যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকি, তখনও কোথাও না কোথাও হলুদ রঙের ওপর কালো অক্ষরে লেখা থাকে “সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত”। বিদ্যুতের অভাবে দিন আর রাতের পার্থক্য কিংবা উষ্ণ আর শীতল আলাদা করে দেখার অনুভূতি যখন হারিয়ে ফেলি তখনও শোনা যায় এই একই কথা। কোথায় নেই এই কথার ব্যবহার? ট্রেনের অপেক্ষায় স্টেশনে পুরো একদিন কাটিয়ে দেওয়র পর গভীর রাতে মাইকে ঘোষণা আসে- সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। নদীতে কয়েশ যাত্রী নিয়ে লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পরে বেহায়া মালিকের মুখে, সড়কে বেপরোয়া যানের চাপায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির মৃত্যুতে কর্তৃপক্ষের কাছে, বানের পানিতে গ্রামের পর গ্রাম ভেসে যাওয়ার পর তথাকথিত ত্রাণ বণ্টনকারীদের গলা থেকেও একই কথা বেরিয়ে আসে। কেবল আমরা যারা এই কথা প্রতিনিয়ত হজম করে যাচ্ছি, তারাই কেবল কথাটি বলতে পারি না। বলতে পারি না নিজেদের সাময়িক আর স্থায়ী অসুবিধার কথাগুলোও।
বুয়েটের গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম। শেষও করতে চাই এই সূত্র ধরে। অন্তত এই বিদ্যাকেন্দ্রকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিতে রাষ্ট্রপক্ষ ‘ওই’ কথাটির ব্যবহার করবেন না। তড়িৎগতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করবেন না। শিক্ষার্থীরা জীবনের সোনামাখা দিনগুলো হারিয়ে আর একটিবারও শুনতে চায় না “সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত”।
বাংলাদেশ সময় : ১৬৩৫ ঘণ্টা, ১৫ জুলাই, ২০১২
এমএ/সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর